অনিল কুণ্ডু – গঙ্গাসাগর
মকর সংক্রান্তির স্নানকে কেন্দ্র করে সরগরম গঙ্গাসাগরের মেলা প্রাঙ্গন। রয়েছে যাত্রীদের ভীড়। রবিবার সন্ধ্যার পর কুয়াশায় ঢেকেছে গঙ্গাসাগরের আকাশ। তাপমাত্রার পারদও নামছে। একটু উষ্ণতার জন্য মেলা প্রাঙ্গনের বিভিন্ন জায়গায় আগুন জ্বেলেছেন যাত্রীরা। সকলেই পূণ্য স্নানের অপেক্ষায় রয়েছেন। রাত পোহালে শীতের ঠান্ডাকে উপেক্ষা করেই সাগরের জলে ডুব দেবেন লক্ষাধিক মানুষ। এদিন সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী মুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে রয়েছেন গঙ্গাসাগর অভিমুখী বহু মানুষ। রাতের জোয়ারে নদী পেরোবেন তাঁরা। কার্যত সারা রাত ধরে আরো বহু মানুষ মেলাপ্রাঙ্গনে পৌঁছবেন।
গঙ্গাসাগর মেলায় প্রতি বছরই মানুষের ভীড়, সমাগম ঘটে। রাজ্য সরকারের তরফে মেলায় আসা মানুষের পরিসংখ্যানকে যেভাবে তিলকে তাল করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মেলায় আসা যাত্রী থেকে সাগরদ্বীপের বাসিন্দারা। শনিবার রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস দাবি করে বলেছিলেন ৪৫ লক্ষ লোক এসেছে। ২৪ ঘন্টা পর তিনিই দাবি করলেন সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬৫ লক্ষ। দীর্ঘদিন ধরে গঙ্গাসাগর মেলা কভার করতে আসা এক সাংবাদিক বন্ধু মন্ত্রীর কথা শুনে তাঁর পাশে বসা এক সাংবাদিকের উদ্দেশ্যে বলেই ফেললেন, ‘‘এতো দেখছি জলে দুধ মেশাচ্ছে। প্রতি বছরই মেলায় আসা যাত্রীর সংখ্যা যেভাবে এই সরকার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়াচ্ছে তাতে এবারের মেলা শেষে না বলে বসে এক কোটি মানুষ মেলায় এসেছেন। এই জন্য এদের কথা মানুষ আর বিশ্বাস করে না। ভেসেলের টিকিট বিক্রির হিসাব এরপর সরকার মেলাবে কি করে। সে দিকে বোধহয় মন্ত্রীদের খেয়াল থাকে না। গঙ্গাসাগর মেলা প্রাঙ্গনে কত মানুষ আশ্রয় নিতে পারেন সে সম্পর্কেও বোধহয় কোন ধারণা নেই’’। প্রবীণ ওই সাংবাদিকের কথায়, খুব বেশি হলে ১০-১২ লক্ষ মানুষের সমাগম হয় গঙ্গাসাগর মেলায়।
মেলা প্রাঙ্গনের বিভিন্ন জায়গায় আগুন জ্বেলেছেন যাত্রীরা।
এদিন সন্ধ্যায় মেলা প্রাঙ্গনের ইনফর্মেশন টাওয়ার থেকে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করা হয় কেউ বাড়ি ফিরতে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাবেন না। মেলা প্রাঙ্গণে ঘোরাফেরা করুন। কচুবেড়িয়ায় ভেসেল চলাচল বন্ধ আছে। এদিনও ভাটায় মুড়িগঙ্গা নদীর চরে আটকায় যাত্রী বোঝাই ভেসেল। প্রায় ৬ ঘন্টা পর জোয়ার শুরু হলে আবার চালু হবে ভেসেল চলাচল। কাকদ্বীপ লট এইটে, কচুবেড়িয়ায় যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। একইভাবে নামখানা, বেণুবন জেটিঘাটেও দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয় যাত্রীদের।
গঙ্গাসাগর মেলা আছে চিরাচরিত গঙ্গাসাগরেই। সারা ভারত বর্ষের নানান ভাষা, ধর্মের, বর্ণের, মানুষ মিলে মিশে একাকার মেলা প্রাঙ্গণে। নেই জাতপাতের কোন ভেদাভেদ। সকলেরই লক্ষ্য পূণ্যস্নান। এটাই ভারতবর্ষ। ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত উদাহরণ গঙ্গাসাগর মেলা। মেলায় আকবর মোল্লার দোকান থেকে ফুল, নারকেল, নকুলদানা কিনে মন্দিরে পুজো দিতে গেলেন উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা বাসন্তী দেবী, নদীয়ার বাসিন্দা শুচিস্মিতা ভট্টাচার্য, সোনারপুরের গৃহবধূ রুমকি দাস, ক্যানিংয়ের আসমাতারা বিবি। সাগর স্নানের পর বৈতরণী পেরোতে সমুদ্র সৈকতে এদিন দুপুরে হোসেন গাজীর বাছুরের লেজ ধরলেন ভীন রাজ্য থেকে আসা যাত্রীরা।
রবিবার রাত ১২টা ১৩ মিনিটে শুরু পূণ্যস্নানের যোগ। চলবে সোমবার রাত ১২টা ১৩ মিনিট পর্যন্ত। শুভ মূহুর্তে সাগরের জলে ডুব দেওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন মেলায় আসা যাত্রীরা। বেণারসের ধাঁচে এবারও গঙ্গাসাগর মেলা উপলক্ষে ৩দিন সাগর আরতি’র আয়োজন করেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন। এদিন জেলা প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে সাগর মেলায় আসার পথে ২ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা হলেন উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা প্রহ্লাদ সিংহ (৬৯) ও রাজস্থানের বাসিন্দা মোহন লাল প্রজাপতি (৫৭)। ময়নাতদন্তর পর তাঁদের মৃতদেহ পরিবার পরিজনদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এখনো পর্যন্ত গঙ্গাসাগর মেলায় আসা ৬ জন অসুস্থ যাত্রীকে এয়ার লিফটের মাধ্যমে কলকাতায় বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
ছবিগুলি তুলেছেন রবীন গোলদার।
Comments :0