ড. সুবিমল সেন
আমাদের দেশ এক সঙ্কটময় সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অত্যন্ত সংগঠিত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, যারা রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী, তারা আমাদের দেশকে মধ্যযুগের অন্ধকারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তেও নির্লজ্জ অসত্য প্রচার ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের মহান সমাজ সংস্কারক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংগ্রাম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, তা আজ বিপন্ন। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা যে সীমিত গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তাও ক্রমাগত আক্রমণের মুখে। বাক্ স্বাধীনতা এবং ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার যেকোনও গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যমত প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই মৌলিক অধিকারগুলো নির্মমভাবে দমন করা হচ্ছে এবং ভিন্নমত পোষণকারীদের হেনস্তা করা হচ্ছে, জেলে পাঠানো হচ্ছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আমাদের দেশ ইস্পাত, কয়লা, রাসায়নিক সার ও ওষুধ, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ভারী শিল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের সুবিধাও প্রসারিত করার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল আমাদের দেশে। ব্যাঙ্ক এবং বিমা ক্ষেত্রও ধীরে ধীরে উন্নত হয়েছে। স্বনির্ভরতা আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এর সম্পূর্ণ বিপরীতে চলে, আমাদের জাতীয় সম্পদ এখন বিদেশি এবং কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। গবেষণার জন্য তহবিল এবং ফেলোশিপের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে কমানো হচ্ছে। ভয় ও পক্ষপাতিত্ব ছাড়া বিজ্ঞানীদের গবেষণা করার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ায় বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ‘নতুন শিক্ষা নীতি’-র নামে, তরুণ প্রজন্মের মনকে আমাদের বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে অসত্য নির্মাণ করে বিদ্বেষপূর্ণ মনন তৈরির চেষ্টা চলছে।
আলোচনা হোক, বিতর্ক হোক এবং ভিন্নমত আসুক, তারপর নির্ধারিত হবে কোনটা সঠিক বা ভুল। সত্যে পৌঁছানোর এই সহজ পদ্ধতি আধুনিক বা প্রাচীন যেকোনও শিক্ষিত সমাজের বৈশিষ্ট্য। একটি অনুসন্ধিৎসু মন শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, কিছু ক্ষেত্রে আরও জটিল সামাজিক ঘটনাও বোঝার চেষ্টা করে। কোনও পূর্বকল্পিত ধারণা, অন্ধ বিশ্বাস, রাষ্ট্র, কোনও ধর্মগ্রন্থ বা তথাকথিত ‘জ্ঞানী’ ব্যক্তি- যে কোনও কর্তৃত্বের আদেশের কাছে আত্মসমর্পণ, শুধুমাত্র বিজ্ঞানের বিকাশই নয়, মৌলিক মানবিক মূল্যবোধের বিকাশেও বাধা দেয়। এমনকি আমাদের ছোট্ট পারিবারিক জীবনের ক্ষেত্রেও এই ধরনের মনোভাব একটি সুস্থ পারিবারিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বাধাই সৃষ্টি করে না, অনেক ক্ষেত্রেই বিপর্যয়ও ডেকে আনে।
আমরা ২১ শতকে বাস করছি, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতির সাক্ষী। অথচ এই সময়ে কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস এবং গোঁড়ামির বিরুদ্ধে আমাদের দেশবাসীর মধ্যে বৈজ্ঞানিক মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য বিজ্ঞান মনস্কতা ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলতে হচ্ছে। আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে যুক্তিহীনতা, অন্ধ বিশ্বাস এবং ভিন্ন মত, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন খাদ্যাভ্যাস বা ভিন্ন পোশাক পরিধানকারীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা-ঘৃণা সভ্য মানুষের পরিচয় নয় বরং এগুলি মৌলিক মানবিক মূল্যবোধের বিরোধী। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের সেই ‘যুক্তিবাদী ভারত’ কোথায়? অথচ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শৈশবাবস্থায় প্রাচীনকালেও ভারতীয় সভ্যতায় অনুসন্ধিৎসু মন ছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে, পশ্চিমী বিশ্ব ‘অন্ধ বিশ্বাস’-এর ‘অন্ধকারের যুগ’ কে পিছনে ফেলে ‘যুক্তির যুগে’ প্রবেশ করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে, শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নয়, সব ক্ষেত্রেই মানব জ্ঞানের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটেছিল। মানবিক দুর্দশা, বৈষম্য এবং অন্যান্য অসুস্থতা কোনও ঐশ্বরিক শক্তির দ্বারা নির্ধারিত নয়, প্রচলিত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিরিখে সেগুলো বোঝার চেষ্টা করেছিল মানুষ সেই সময়ে। তৎকালীন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন এনে অনেক উন্নত সমাজ গঠনের স্বপ্নও দেখেছিল মানুষ। এর মানে এই নয় যে, অন্ধ বিশ্বাস, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকারী প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের শক্তি সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়েছিল। তারা পিছিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ধ্বংস হয়নি।
মানব সভ্যতার অগ্রগতি কখনোই মসৃণ ছিল না। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, একটি নতুন মতাদর্শ, সমাজতন্ত্রের বিজয় দেখা যায়, একটি মতাদর্শ যা সবচেয়ে যুক্তিবাদী এবং মানবিক। আবার প্রায় একই সময়ে জার্মানিতে হিটলার এবং ইতালিতে মুসোলিনির উত্থান ঘটে। নাৎসিবাদ যুক্তিবাদী অনুসন্ধান এবং মৌলিক মানবিক মূল্যবোধের বিরোধী ছিল। এর পরেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে নৃশংস এবং অমানবিক কর্মকাণ্ডের সাক্ষী হয় এই পৃথিবী, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দেখা নৃশংসতা এবং ধ্বংসযজ্ঞকে ছাড়িয়ে যায়। শেষে, ফ্যাসিস্তরা পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু তাদের মতাদর্শ কি সত্যিই মুছে গিয়েছিল?
আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীর অবিভক্ত বাংলার কিছু সামাজিক ঘটনার দিকে নজর দেওয়া জরুরি। সেই শতাব্দীর প্রথম দিকে, অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত একটি জঘন্য প্রথা, ‘সতীদাহ’ বিলুপ্ত করার জন্য নিরলসভাবে লড়াই করেছিলেন। এই প্রথায় মৃত স্বামীর সাথে বিধবাকে একই চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। প্রতিটি কুসংস্কার শুধু বিজ্ঞানবিরোধী অযৌক্তিক নয়, মানবতারও বিরুদ্ধে।
প্রাচীন ভারতে, বিশেষ করে চিকিৎসা, রসায়ন এবং অন্যান্য সব বিষয়, তত্ত্ব ও পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের একটি মহান ঐতিহ্য তৈরি হয়েছিল, যা আধুনিক বিজ্ঞানেরও দুটি স্তম্ভ। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হিস্টরি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’-তে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন, কিভাবে মনু প্রচলিত বর্ণবিভাগপ্রথা এবং শঙ্করাচার্যের ‘মায়া’ (ভ্রান্তি) দর্শনের জোড়া আক্রমণে সেই ঐতিহ্য প্রায় ধ্বংসের প্রান্তে পৌঁছেছিল। তাই যখন পশ্চিম ইউরোপে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম হয়, তখন ভারত ছিল কেবলমাত্র এক দর্শক। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের পর আধুনিক বিজ্ঞান ভারতে আসে। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু এবং আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে বাংলায় নিষ্ঠাবান বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের সংস্কৃতি শুরু হওয়ার আগেই, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকেই অনুসন্ধান, যুক্তিবাদের চেতনা বনাম প্রাচীন কুসংস্কার এবং অন্ধ বিশ্বাসের বিরোধ বিকশিত হতে শুরু করে। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলার বিভিন্ন অংশে নারী শিক্ষার প্রসারের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। হিন্দু বিধবাদের দুর্দশা দেখে, যাদের অধিকাংশই ছিল নিতান্ত শিশু, তাদের পুনর্বিবাহ প্রবর্তনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র 'তত্ত্ববোধিনী'-র সম্পাদক অক্ষয় কুমার দত্ত ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ প্রচারের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি, অনুসন্ধানের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেন। হিন্দু দেবতাদের পূজা করার সময় পুরোহিতরা সংস্কৃতে মন্ত্র ও স্তোত্র পাঠ করেন, যা অধিকাংশ মানুষ বোঝেন না, সম্ভবত পুরোহিতরাও বোঝেন না। এই কথা উল্লেখ করে তিনি রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘আমি এমন কাউকে সর্বশক্তিমান হিসাবে গ্রহণ করতে পারি না, যিনি শুধুমাত্র একটি ভাষা বোঝেন।’
পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত মেডিক্যালের ছাত্র হিসাবে ১৮৩৬ সালে প্রথম ভারতীয় যিনি শবব্যবচ্ছেদ করেন, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের আদেশকে উপেক্ষা করেই। এর প্রায় তিরিশ বছর পর, মধুসূদন দত্ত তার মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ রচনা করেন, রাবণ পুত্র মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিতের বীরত্ব এবং তার করুণ মৃত্যু চিত্রায়িত করে। তাঁর মহাকাব্যে, রাম ও লক্ষ্মণের প্রাচীন বর্ণনাকে পালটে দিয়ে রাবণ ও মেঘনাদ চরিত্রকে খলনায়কের পরিবর্তে নায়ক রূপে চিত্রিত করেন। এটি প্রকাশের পর, নিন্দার পরিবর্তে, মহাভারত বাংলায় অনুবাদকারী কালীপ্রসন্ন সিংহের নেতৃত্বে তৎকালীন বাঙালি সমাজের অভিজাতরা তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। ১৮৭০ সালে, প্রাচীন ভারতের একজন বিশেষজ্ঞ এবং এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি রাজেন্দ্রলাল মিত্র ‘প্রাচীন ভারতে গোরুর মাংস খাওয়া’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন। এখানে তিনি দেখান, গোরুর মাংস প্রাচীন ঋষিদের এবং সাধারণ মানুষের কাছে খুব প্রিয় ছিল এবং তারা তাদের সম্মানিত অতিথিদের গোরুর মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘পূজারিণী’ কবিতায় উল্লেখ করেছেন, গৌতম বুদ্ধের অনুসারী রাজা বিম্বিসারের পুত্র, অজাতশত্রু রাজা হওয়ার পর হিন্দু ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রক্তপাতের মাধ্যমে তাঁর পিতার ধর্ম, বৌদ্ধধর্মকে মুছে ফেলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থসমূহ আগুনে পুড়িয়ে দেন। কারোরই কখনও মনে হয়নি, রবি ঠাকুর হিন্দু বিরোধী ছিলেন বলেই এই কবিতাটি লিখেছেন। এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য, মধ্যযুগে বিজয়ী রাজার দ্বারা অন্যান্য ধর্মের মন্দির ও ধর্মগ্রন্থ ধ্বংস করা একটি সাধারণ প্রথা ছিল। খুব কম মানুষই আছেন যারা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোট গল্প ‘মহেশ’ পড়েননি। এক দরিদ্র মুসলিম কৃষক এবং তার পোষা ষাঁড় ‘মহেশ’-এর দুর্দশার উপর ভিত্তি করে এই গল্প লেখা। বাঙালি মননে কখনো এটা আসেনি, কেন একজন মুসলিম তার পোষ্য ষাঁড়ের নাম 'মহেশ' রাখলেন, যা হিন্দুদের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় দেবতাদের মধ্যে একজন। বেগম রোকেয়া, একজন অত্যন্ত বিদূষী মহিলা, তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনকালে (১৮৮০-১৯৩২), মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য নিরলসভাবে লড়াই করেছিলেন। নারী অধিকারের জন্য লড়াইয়ের অগ্রদূত হিসাবে, তিনি স্পষ্টভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থকে নারীদের দাসত্বের জন্য দায়ী করেছিলেন।
প্রশ্ন হলো, তারা কীভাবে তাদের ‘বৈপ্লবিক’ কর্মকাণ্ড চালাতে পেরেছিলেন? তাদের সময়ে কি অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অযৌক্তিকতার প্রবক্তারা ছিল না? অবশ্যই ছিল। বরং তারা প্রচুর সংখ্যায় ছিল, কিন্তু তারা আজকের রাজনৈতিক দলের মতো সুসংগঠিত শক্তি ছিল না, বা তারা অর্থ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সমর্থনও উপভোগ করত না। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের কাছে এমন কোনও উন্নত প্রযুক্তি ছিল না, যার মাধ্যমে তারা প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নির্লজ্জ মিথ্যা, মনগড়া গল্প, কুসংস্কার ছড়াতে পারত।
এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ঊনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের বাংলায় জন্মগ্রহণ বা সক্রিয় জীবনযাপন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারা যদি বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে তাদের কী হতো? এটা নিশ্চিত যে ‘সতীদাহ’ এবং ‘বিধবা পুনর্বিবাহ’-এর মামলা দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে যেত। এখনকার পরিস্থিতিতে, হিন্দু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রাচীন কুসংস্কার এবং ‘বিশ্বাস’গুলিকে নস্যাৎ করে অসহায় নারী ও তরুণীদের দুর্দশা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতো কী না, বলা মুশকিল। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত, পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত, কবি মধুসূদন দত্ত, বেগম রোকেয়া এবং রাজেন্দ্রলাল মিত্রের পরিণতি হয়ত নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, কালবুর্গি এবং গৌরী লঙ্কেশের মতোই হতো। অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা এবং রোহিত ভেমুলার নাম একই বন্ধনীর মধ্যে রাখতে হতো। উল্লেখ্য, অধ্যাপক সাহার নামের আগে 'আচার্য' শব্দটি কখনও ব্যবহার করা হয়নি, সম্ভবত এই কারণে যে তিনি তথাকথিত 'নিম্ন' বর্ণের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং কাজী নজরুল ইসলামের মতো অনেকের লেখাই হয়ত নাৎসি জার্মানির মতোই প্রকাশ্যে পুড়িয়ে দেওয়া হতো।
এটা শুধু অবিভক্ত বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের সংবিধানের জনক ড. বিআর আম্বেদকর, সাবিত্রী বাঈ ফুলে, জ্যোতি রাও ফুলে, ‘দক্ষিণ ভারতের সক্রেটিস’ হিসাবে পরিচিত রামস্বামী নাইকার এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য মহান ব্যক্তিত্ব এবং সমাজ সংস্কারকদের অবদান আমাদের দেশকে মধ্যযুগের অন্ধকার থেকে তুলে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। হিন্দি সাহিত্যে মুন্সী প্রেমচাঁদের গল্পগুলো মানবিক আবেদনের জন্য আজও আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়। দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনেক ধর্মীয় নেতা এবং লোক-সঙ্গীতশিল্পীও ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমতার পক্ষে দৃঢ়ভাবে বক্তব্য রেখেছিলেন। তারা যদি আজকের ভারতে জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে তাদের পরিণতি কল্পনা করা খুব কঠিন নয়। আমাদের উচিত আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এই মহান ব্যক্তিত্বদের জীবন ও সংগ্রাম সম্পর্কে স্মরণ করানোর জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো।
পরিস্থিতির এই আকস্মিক পরিবর্তন কেন ঘটল? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্তদের একটি যুদ্ধে হারানো গিয়েছিল, কিন্তু তাদের মতাদর্শ ধ্বংস হয়নি। উপযুক্ত পরিবেশের জন্য অপেক্ষা করছিল, যাতে আবার মাথা তুলতে পারে। তথাকথিত বিশ্বায়ন সেই সুযোগ করে দিয়েছে। অভূতপূর্ব অনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক শোষণ, যার ফল অপরিসীম বৈষম্য, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি, ধর্মীয় ও জাতিগত অসহিষ্ণুতা, চরম স্বার্থপরতা এবং নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। সাধারণ মানুষের বসবাসের জন্য বর্তমান বিশ্ব পরিণত হয়েছে একটি বিপজ্জনক কঠিন জায়গা, কিন্তু যুক্তিবাদ বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি এবং মৌলিক মানবিক মূল্যবোধের শত্রুদের বিকশিত হওয়ার একটি আদর্শ ক্ষেত্র তৈরি করেছে তথাকথিত বিশ্বায়ন। এই মতাদর্শের প্রবক্তারা অত্যন্ত সংগঠিত এবং প্রভুত অর্থ ও রাষ্ট্রীয় সমর্থন এদের সঙ্গে আছে। তারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের বিপজ্জনক মতাদর্শ প্রত্যন্ত প্রান্তেও প্রচার করতে খুবই দক্ষ। দুঃখজনক ভাবে, যারা সাম্য, যুক্তিবাদ, বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি, ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনে বিশ্বাস করে, তারা এই দুষ্ট শক্তির বিরুদ্ধে গুরুতর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। তবে হতাশার কোনও কারণ নেই। তারা হয়তো আজ সক্ষম হয়নি, তবে সর্বদা একটি আগামীকাল থাকে।
আমাদের দেশবাসীর মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি প্রচারের সামনের সারিতে থাকা বিপুল সংখ্যক মানুষ এই দুষ্ট শক্তির কাছ থেকে কঠোর প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। এই বিপজ্জনক দর্শন থেকে মানুষকে জয় করার জন্য প্রতিদিন আরও জোরালো প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যুক্তিবাদী বিজ্ঞান মনস্ক সংগঠকরা উপযুক্ত উদাহরণ সহ আমাদের ঐক্য ও বৈচিত্রের সংস্কৃতি এবং সমাজ সংস্কারকদের ভূমিকা, ধর্মীয় এবং স্থানীয় লোক-সঙ্গীতশিল্পীদের ভূমিকা তুলে ধরতে পারে, যারা স্থানীয় জনগণের মধ্যে যুক্তিবাদ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মনে রাখা দরকার, এই যুদ্ধ, আমাদের পরিবারের ভেতরে এবং কিছু ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের বিরুদ্ধেও চালাতে হবে। একটি যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, একসাথে বসবাসের আনন্দ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করার জন্য, আধুনিক প্রযুক্তিকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করতে হবে। এই সঙ্কটময় সময়ে জনগণের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়ার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্ভাবনী পদ্ধতি তৈরি করতে হবে।
Comments :0