ধীরাজ মুক্তিকামী, অযোধ্যা
স্বাধীনতার কিছু সময় পর থেকেই তো অযোধ্যা লাগাতার আলোচনার বিষয় হয়ে থেকেছে। কিন্তু এই আলোচনার নয়া ডানা লেগেছে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর। আর ‘বিকাশ’ সেই অসংখ্য শব্দের একটি যা ২০১৪ সালের পর থেকে বিশেষ ভাবে আমাদের দৈনিক শব্দকোষের অংশ হয়ে উঠেছে।
অযোধ্যা আর তার বিকাশের কথাই যদি আসে, তাহলে বিশেষভাবে গত ২বছরে প্রধান সড়কগুলির প্রসারণ, রেল স্টেশন, বাস স্টেশন, বিমান বন্দর এবং পরিকাঠামোগত কাজের জন্য জমি অধিগ্রহণ, প্রধান সড়কের উপরের বাড়িগুলিতে একইরকম নকশা, একই রং, প্রধান সড়কের দোকানগুলিতে একই রকম ডিসপ্লে বোর্ড, মাটির নিচে নিয়ে নিকাশি নালা করার জন্য গলি গলি পর্যন্ত খুঁড়ে ফেলা, প্রতিদিন কোনও না কোনও ভিআইপি’র সফর এবং তাদের প্রবচন, আর এই সবের জন্য প্রতিদিন রুট ডাইভার্সন এবং যাতায়াতের নিয়মের গুঁতোয় শহরবাসীর কিছু অতি জরুরি অথবা অনাবশ্যক কাজ হামেশাই বরবাদ হচ্ছে।
অনেক আগে আমার এক অধ্যাপক বলেছিলেন, প্রত্যেক বিকাশের নিজের একটি মূল্য হয়, সেই সময়ের লোকেদের তার দাম মেটাতে হয়। সেই দাম এখন অযোধ্যার বাসিন্দাদের মেটাতে হচ্ছে। অযোধ্যার বাসিন্দারা এই উন্নয়নের জন্য কী কী মূল্য দিচ্ছেন, তার তালিকা দীর্ঘ করা যায়। আমি শুধু একটি উদাহরণে সীমিত রাখছি।
‘বিকাশ’-এর জন্য এই মূল্য চোকানোর তালিকায় একটি হলো সরকারি ইন্টার কলেজ, ফৈজাবাদ। যা এক সময়ে গোটা উত্তর প্রদেশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সরকারি কলেজ বলে মানা হতো। (ইন্টার কলেজ অর্থাৎ হাইস্কুল) ২০১৪ সালের পর থেকে যেখানে শুধু নির্বাচনী কার্যালয়, দুর্গা পূজা শোভাযাত্রার ডেরা, আধা সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প অথবা রাজনৈতিক মহোৎসব ইত্যাদির আয়োজনের জন্য বিনি পয়সার ‘রেওয়াড়ি’র মতো অবস্থা হয়েছে। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত স্কুলের চত্বরে বইমেলা করার অনুমতি দিতেও প্রশাসনিক আধিকারিকদের নানারকম সমস্যা হতো। অথচ এখন হঠাৎ কোনও অনুষ্ঠানের জন্য এবং রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য ঘোষিতভাবে দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করাই আছে। ইন্টার কলেজের মূল্যবান খেলার মাঠ খুঁড়ে খুঁড়ে বরবাদ করে দেওয়া হয়েছে। এর প্রধান ভবনের দেওয়ালের সঙ্গেই অস্থায়ী শৌচালয় তৈরি করা হয়েছে লাগাতার এই সব কর্মসূচি সম্পাদন করার জন্য। ইন্টার কলেজের সীমানা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে ‘বিকাশ’ এর ওভারব্রিজ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। একদা এর বিজ্ঞানের গবেষণাগার উৎকৃষ্টতার জন্য পরিচিত ছিল। যা আজ মরণাপন্ন স্থিতিতে পৌঁছে গেছে। ইন্টার কলেজের ‘আচার্য নরেন্দ্র দেব ছাত্রাবাস’ যা তুলনায় নতুন আর নানাবিধ সুবিধার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল, এখন কোনো ভূতুড়ে বাড়ির মতো অবস্থা হয়েছে। একসময়ে এই স্কুলের স্কাউট-গাইড প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ছাত্রদের সেনাবাহিনীতে সরাসরি নিয়োগের যোগ্য মনে করা হতো।
স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র এবং মানবাধিকার ও সামাজিক কর্মী আফাক উল্লাহ বললেন, ‘‘আগে এই স্কুলে কতরকমের খেলাধুলা হতো, তার জন্য শিক্ষক থাকতেন। সমস্ত খেলার খেলোয়াড় নির্বাচনের জন্য বেশ কিছুদিন ধরে ট্রায়াল হতো। ৮-১০টি স্কুলের সঙ্গে খেলা হতো। এর ফলে মণ্ডল এবং রাজ্য স্তর পর্যন্ত খেলায় এই স্কুলের ছাত্ররা পৌঁছে যেত। এর একটা সামাজিক গুরুত্ব ছিল। স্কুল জীবনেই এই ছেলেরা নিজের বৃত্তের বাইরের অন্য স্কুলের বা অন্য এলাকার ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পেত। যা তাদের জাতি, ধর্মের মতো সীমানা অতিক্রম করতে সাহায্য করত। এখানে কাস্ট-কলা এবং পুস্তক-কলার মতো দুটো বিষয়ও ছিল। পড়ুয়ারা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এর একটা বিষয় নির্বাচন করত। নিজেরা বই বানাতো। বাইন্ডিং করত। বই মেরামত করত। কাঠের কাজও একইভাবে শিখত ছেলেরা। যা সমাজের এই জীবিকার মানুষের প্রতি সম্মানের মনোভাবও তৈরি করত।’’
বর্তমান সময়ে রাজনীতি-প্রেরিত আড়ম্বরের মধ্যে শুধু এই একটা সরকারি ইন্টার কলেজ নয়, আরও অসংখ্য সরকার-পোষিত স্কুল-কলেজ এবং অন্য সংস্থা যারা নিজেদের দুর্দশার কথা কারোকে জানাতে পারে না, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এবং প্রশাসনিক আধিকারিকদের পাশে এখন আর এত সময় নেই যে তাঁরা এত গভীর বিষয়ে কোনও বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ থেকে এখনই মুক্ত না করলে এবং সরকার এইধরনের সরকার পোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব না নিলে সাধারণের শিক্ষার এই কেন্দ্রগুলির পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
-------------------------------------
লেখক ফ্রিল্যান্স কলাম লেখক।
Comments :0