সুদীপ্ত বসু
শিশুর নাম অভি সিং (পরিবর্তিত)। ঠিকানা মমতা ব্যানার্জির বিধানসভা ও অভিষেক ব্যানার্জির বাসস্থান হরিশ মুখার্জি রোডে। জন্ম ২০১২-র ডিসেম্বর। তার ১৩ বছর পরে ২০২৫-র মে মাসে সেই নবজাতকের জন্ম শংসাপত্র ইস্যু হয়েছে দার্জিলিঙ জেলার খড়িবাড়ি গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে!
মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা থেকে অভিষেকের লোকসভা কেন্দ্র এমনকি গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ, টালিগঞ্জের ঠিকানার একাধিক নবজাতকের জন্ম শংসাপত্র থেকে মৃত্যুর শংসাপত্র ইস্যু হচ্ছে উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত এক সরকারি হাসপাতাল থেকে! তাও আবার এক দশকের বেশি পুরানো তারিখে। এমন ৮৭০ জনের তালিকাও রয়েছে নাম ধরে ধরে।
এক সংগঠিত চক্র। দার্জিলিঙ জেলার খড়িবাড়ি গ্রামীণ হাসপাতালে এই ভুয়ো জন্ম-মৃত্যুর সার্টিফিকেট তৈরি করা হচ্ছিল। শুধু এরাজ্য নয় এই বেআইনি চক্রের কারবার ছড়িয়েছে সিকিম থেকে বিহারে। এবং কী আশ্চর্য! এতেও সরাসরি তৃণমূলী যোগ! জালিয়াতি চক্রের অন্যতম পান্ডা ডেটা এন্ট্রি অপারেটর তৃণমূলের সক্রিয় কর্মীকে পার্থ সাহা। গ্রেপ্তারের আগে নেপাল গা ঢাকা দিয়েছিল। মহিলা তৃণমূল কংগ্রেসের দার্জিলিঙ জেলার সভাপতি পপি সাহার পুত্র এই পার্থ সাহা।
গঙ্গার উৎসস্থল গঙ্গোত্রী হিমবাহ। গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন ভাগীরথী এবং অলকানন্দা নদী দেবপ্রয়াগে মিলিত হয়ে গঙ্গা নামে প্রবাহিত হয়। এরাজ্যে গত দেড় দশকে দুর্নীতির উৎসস্থলও তৃণমূল। হরিশ মুখার্জি থেকে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কালীঘাট থেকে ক্যামাক স্ট্রিট— শিক্ষক নিয়োগ থেকে কয়লা, গোরু পাচার, রেশন কেলেঙ্কারি, রেগার টাকা লুট থেকে মিড ডে মিল, লুটের পঞ্চায়েত হয়ে এমনকি জন্ম-মৃত্যুর জাল শংসাপত্রের চক্র। অসংখ্য শাখা-উপ শাখায় বিভক্ত হয়ে এরাজ্যেকে তারা নিঃস্ব করছে প্রতি মুহুর্তে।
কাজের আকাল, ভারী শিল্প নেই, গ্রামীণ সঙ্কটের ক্যানভাসে দুর্নীতি হয়ে উঠছে মূলস্রোতে আয়ের অংশ। এটাই সব থেকে বিপজ্জনক প্রবণতা। যার প্রভাব পড়ছে সমাজ জীবনে। সরকারি মদতে দুর্নীতি সামাজিক বৈধতা পাচ্ছে। উন্নয়ন হলে একটু তো টাকা পয়সা নয় ছয় হবেই! গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে এমন ধারণা, এই বাংলায়। একটি বেসরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের ৪৬ শতাংশ বাসিন্দা স্বীকার করেছেন যে, তারা তাদের কাজ করাতে ঘুষ দিয়েছেন। এর মধ্যে ৩৬শতাংশ একাধিকবার ঘুষ দিয়েছেন এবং ১০শতাংশ এক বা দুইবার ঘুষ দিয়েছেন। সামাজিক ভাবে দুর্নীতিকে সহজবোধ্য করে তুলেছে শাসক তৃণমূল যা আসলে ধান্দার ধনতন্ত্রেরই অন্যতম উপসর্গ।
আর তাই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার চার চারটে চার্জশিটে বর্ণিত ‘নিয়োগ দুর্নীতির অন্যতম মাস্টারমাইন্ড’, একদা তৃণমূলের মহাসচিব, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ৪০ মাস পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বেমালুম হাসি মুখে মিডিয়ার সামনে প্রতিক্রিয়া দিলেন- ‘দুর্নীতি হয়েছে তো কী! দুর্নীতি কোনও ইস্যু নয় পলিটিক্সে’! সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে তদন্তকারী সংস্থার আইনজীবী বলেছিলেন- এটা নিছক টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রির দুর্নীতি নয়। সামাজিক ক্ষত তৈরি করেছে এই দুর্নীতি, একটা প্রজন্ম জানলো স্রেফ মন্ত্রী বা তাঁর পারিষদকে টাকা দিয়ে ফেল করে, খালি খাতা জমা দিয়েও শিক্ষক হওয়া যায়! আর সেই শিক্ষকদের হাতে পড়ে আরও কত প্রজন্ম ধ্বংস হবে’।
কোনও নিরামিষ সুপারিশ নয়, সংগঠিতভাবে কোটি কোটি টাকার খেলা চলেছে। জেলায় জেলা রীতিমত এজেন্ট চক্র গড়ে উঠেছিল।রীতিমত রেট কার্ড ধরে টাকা তোলা হয়েছে। প্রাইমারির ক্ষেত্রে একরকম, উচ্চ প্রাথমিকের ক্ষেত্রে একরকম টাকা। কোনটারই পরিমাণ ৫ লক্ষের কম নয়। টাকা যারা দিয়েছে তাঁদের পৃথক তালিকা তৈরি হয়েছে। সেই তালিকা এজেন্টদের মাধ্যমে গেছে শাসক তৃণমূলের প্রভাবশালী মহলে। সেখান থেকে মন্ত্রী, শীর্ষ আধিকারিকরদের কাছে। শুধুমাত্র প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিকেই কেলেঙ্কারির বহর দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। গ্রূপ ডি’পদেও কেলেঙ্কারির বহর কয়েকশো কোটি টাকা। নিয়োগ দুর্নীতির বারোটি মামলায় সিবিআই তদন্ত চলছে। যদিও ভোটের আগে এখন চলছে জামিন-পর্ব। সেটিং আর দুর্নীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
বান্ধবীর ফ্ল্যাটে নগদ ৪৯ কোটি ৮০ লক্ষ! পার্থ চ্যাটার্জি থেকে কুন্তল ঘোষ, মানিক ভট্টাচার্য থেকে তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা, শান্তনু ব্যানার্জি থেকে তাপস মণ্ডল- যেন গোটা বাংলা জুড়ে শাখা প্রশাখা ছড়িয়েছে একটি সংগঠিত, নিয়ন্ত্রিত দুর্নীতির কুৎসিততম চেহারা। টাকা দিয়ে চাকরি না পেয়ে মেদিনীপুরে দুটি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। দুর্নীতি এতটাই সংগঠিতভাবে হয়েছিল যে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের ওয়েবসাইট নকল করেই তৈরি করা হয়েছিল আরেকটি ওয়েবসাইট।
হাজার হাজার বেকার, যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে এই ভয়াবহ প্রতারণার পরেই মুখ্যমন্ত্রীর নির্বিকার সাফাই- দশটা কাজ করতে গিয়ে একটা ভুল হলে সেই ভুলটাকে আরও বেশি করে দেখানো হচ্ছে। ‘রাইট টু মেক ব্লান্ডার্স’ একথা ত নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছিলেন। ভুল করার অধিকার, সেটাও একটা অধিকার। বিপদে পড়লেই ‘আমি জানতাম না’ বলে বেবাক দাবি করে বসেন মুখ্যমন্ত্রী। অথচ ২০১১ সালে সরকারের আসার পর থেকে এরাজ্যের বুকে সবকটি বড় দুর্নীতিতেই কোনও না কোনোভাবে ওনার ‘অনুপ্ররণা’র স্বাদ-গন্ধ-স্পর্শ সবই মিলেছে।
সরকারের মনোভাব কী? সম্প্রতি তথ্যের অধিকার আইন প্রয়োগ করে প্রশ্ন করে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে শুধু মামলায় (বিশেষত দুর্নীতি মামলায়) রাজ্য সরকার উকিলদের পিছনে ৬৫ কোটি টাকা খরচ করেছে! ‘ব্যক্তির স্বার্থরক্ষায় একটা সরকার কেন সুপ্রিম কোর্টে আসবে?’ প্রশ্ন তুলেছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। গত লোকসভা ভোটের মাঝেই রাজ্য সরকার ছুটে গিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের দরজায়। কেন? রাজ্যকে বঞ্চনা করা হচ্ছে কেন, ১০০ দিনের বকেয়া টাকা দিতে হবে বলে স্লোগান তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু আদালতের দরজায় পৌঁছেছেন ‘ন্যায়ের দাবি’ আদায়ে? উত্তর, না। তাহলে সুপ্রিম কোর্ট বলল কেন, রেগার বকেয়া বরাদ্দ থেকে মমতা ব্যানার্জির সরকারের কাছে অনেক ‘গুরুত্বপূর্ণ’ শেখ শাহজাহান। সন্দেশখালি জুড়ে শাহজাহানের সাম্রাজ্য রক্ষায় তৎপর মমতা ব্যানার্জির সরকার। তাই শাহজাহানকে স্বস্তি দিতে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল সরকার। সরকারের অগ্রাধিকার-ই সরকারের পরিচয়।
ওদিকে সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশনের সুপারিশ সত্ত্বেও শুভেন্দু অধিকারির বিরুদ্ধে দুর্নীতি বিরোধী মামলার আইনি প্রক্রিয়া শুরু করার সম্মতিটুকু মিলছে না কেন্দ্রীয় কর্মীবর্গ, জন-অভিযোগ মন্ত্রকের তরফে। ছয় বছর হতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর হাতেই রয়েছে সেই মন্ত্রক।
তাই যত্ন করেই বাইনারি সাজানো হচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই থেকে জনজীবনের ইস্যু— কৃষকের ফসলের ন্যূনতম দামের অধিকার থেকে বিলগ্নির মুখে পড়া কারখানার শ্রমিকের লড়াই, ভাঙনে সর্বস্ব হারানো মানুষের যন্ত্রণা থেকে বিড়ি শ্রমিকের মজুরি, হকের লড়াইয়ে এই বাংলার আলপথ। ১ হাজার কিমি সেই আলপথেই বাংলার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের ডাক। শাসকের ভাষ্য ভেঙে জনগণের বিকল্প ভাষ্য তৈরিই সময়ের দাবি।
Comments :0