দীপাঞ্জনা দাশগুপ্ত দে
মোল্ডিং মেশিন বা পগমেল দিয়েই এখানে শ্রমিকরা পলি মাটির সঙ্গে সাধারণ মাটি মেশান। তবে মাটির পাহাড়ে কাজ করার সময় হামেশাই বিপদে পড়েন শ্রমিকরা(Labour)। অনেক সময় মাটি চাপা পড়ে যান তাঁরা। বহু ক্ষেত্রে মৃত্যুও ঘটেছে। এমনই জীবন ইটভাটায়।
এ রাজ্যে বিভিন্ন ইটভাটায় শ্রমিকদের সুরক্ষার দাবিতে লাগাতার আন্দোলন করে যাচ্ছে সিআইটিইউ’র টালি ইটভাটা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন। শ্রমিকদের সুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিনের লড়াই তাদের। বহু ক্ষেত্রে ইটভাটার মালিকরা দাবি মানতে চায় না তবুও আন্দোলন পর আন্দোলন করে অবশেষে কিছু দাবি মেটে।
ইট মাটি দিয়ে তৈরি হয়। নির্মাণের সঙ্গে, সভ্যতার সঙ্গেও তার সম্পর্ক গভীর। তাই নদীর পারেই ইট ভাটাগুলি গড়ে ওঠে। সহজে মাটি পাওয়াও একটি বিশেষ কারণ। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার সারা বছর ভাটাগুলিতে ইট উৎপাদন হয় না। বর্ষার সময় অর্থাৎ মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মাস বন্ধ রাখা হয় ইটভাটা। কারণ বছরের ওই সময়টায় নদীর জল বিশেষ ভাবে খাল কেটে ভাটার কাছে জমা করা হয়। তার কারণ ওই সময় নদীর জলের সঙ্গে প্রচুর পরিমানে পলি ঢোকে। ওই পলি মাটিই ইট তৈরির মূল উপকরণ। বর্ষা চলে গেলে জল নেমে যায়, পলিমাটি থেকে যায়। তার সঙ্গে বাইরে থেকে মাটি কিনে এনে মেশানো হয়।
এই প্রসঙ্গে সিআইটিইউ(CITU) দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা সম্পাদক দেবাশিস দে বলেন, ‘‘ একেক ভাটায় শ্রমিকদের একেকরকম সমস্যা আছে। শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিন লড়াই করেছে সিআইটিইউ। এখনও বহু ভাটা মালিক শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা দেয় না। চিকিৎসার খরচ দিতে চায় না। সেক্ষেত্রে আন্দোলন করেই আদায় করে নিতে হয়।’’
এ রাজ্যে বিভিন্ন ভাটায় দীর্ঘ লড়াইয়ের পড়ে শিশুশ্রম বন্ধ হয়েছে। সেই সঙ্গে ভাটায় শিশুদের পড়ানোর ব্যবস্থাও হয়েছে।
ইট শিল্পে তিনটি মূল উপকরণ হলো মাটি, বালি ও কয়লা। এই বালি ও কয়লা নিয়ে বিপুল কালোবাজারি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। বালি মাফিয়ারা, কয়লা মাফিয়ারা দিন-দুপুরে লুঠ চালাচ্ছে তৃণমূলের মদতে। ফলে রাজ্যের বাজারে ব্যাপক দামে বিক্রি হয় বালি-কয়লা। আর চড়া দামে সেই বালি, কয়লা কিনছে ভাটা মালিকরা। যার ফল পক্ষান্তরে ভোগ করতে হয় শ্রমিকদের। হয় মালিকরা উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছেন। তখন উৎপাদন কমালে কাজ থাকছে না। আবার কোথাও শ্রমিকদের মজুরি কমিয়ে দিচ্ছে মালিকপক্ষ। সঙ্কটে পড়ছেন সেই শ্রমিকরাই।
মাটি, বালি নিয়ে কাজ হওয়ায় ইটভাটাগুলি খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধুলোয় কার্যত ভরে থাকে। এই ধুলোর ভয়ঙ্কর প্রভাবও পরে শ্রমিকদের শরীরে। ব্যাপক মাত্রায় ফুসফুসের সমস্যা হয়। পেটের রোগও হয়, চামড়ার রোগও হয়। দিনের পর দিন এসব রোগের চিকিৎসা হয় না অনেকেরই।
এক একটি ভাটাতে বহু ধরনের শ্রমিক আছেন। যাঁরা কাঁচা মাটিকে ইটের ফর্মায় ফেলেন, তাঁদের বলা হয় পাথাই কর্মী। তাঁরা মেশিন থেকে মোল্ডিং হয়ে আসা মাটির সঙ্গে বালি মিশিয়ে ফর্মায় ফেলে ইটের প্রাথমিক আার দেয়। তারপর ‘রেজা’ (মহিলা) ও ‘বাঁকি’ (পুরুষ) কাঁচা মাটির ইট নিয়ে চেম্বারে থরে থরে ইট সাজান। থাকেন লোডিং মিস্ত্রিও। তৈরি হওয়া ইট বাছাই করার জন্য তাকে ‘সর্টিং মিস্ত্রি’। ভাটার চিমনিতে যারা লাগাতার কয়লা দিয়ে আগুন জ্বালান তাঁদের বলা হয় ফায়ার ম্যান। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা মজুরি হয় শ্রমিকদের। তবে সব থেকে বেশি মাইনে পেয়ে থাকেন ফায়ারম্যানরা। ভাটার চিমনিতে নিরন্তন কয়লা দিয়ে থাকেন এই ফায়ারম্যান। যেহেতু কাজের মরশুমে একবারও চিমনি বন্ধ হয় না তাই চক্রাকারে ফায়ারম্যানরা কাজ করে যান।
ভাটা চালু হলে এক একটি চেম্বারে প্রায় ২ থেকে আড়াই লক্ষ ইট জ্বলে ২০ থেকে ২২ দিন ধরে। একটি চেম্বার বন্ধ হয়ে গেলে জ্বলন্ত ইট ঠান্ডা হতে সময় লাগে প্রায় ৮ থেকে ১০ দিন। তখন দ্বিতীয় চেম্বারটি জ্বালানো হয়। সেখানেই একই পদ্ধতিতে তৈরি হয় ইট। তারপর ভাটায় থাকে রাধুনি, ভাটার ম্যানেজার। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে লিখিত অলিখিত ভাবে মোট ১০,০০০ হাজারটি ভাটা রয়েছে। তাতে শ্রমিক সহ অন্যান্য কর্মীর সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় ১০-১২ লক্ষ। যদি কোনও ভাবে ইটভাটা গুলো বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এই বিশাল সংখ্যক মানুষ শুধু পশ্চিমবাংলায় কর্মহীন হয়ে পড়বেন।
সিআইটিইউ রাজ্য সম্পাদক সুভাষ মুখার্জি এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘ইটভাটা ক্ষেত্রই সঙ্কটে পড়েছে। তৈরি হওয়া ইটের ওপরে ১২ শতাংশ জিএসটি (12% GST)চাপানের ফলে ও কয়লা, মাটি, বালি সব কিছুর দাম বাড়ায় সমস্যা বেড়েছে। মালিকরা এই নিয়ে সরকারে সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করছে কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এখন পর্যন্ত আলোচনায় বসেনি।’’ তিনি বলেন, ‘‘মাটির ইট তৈরিতে পরিবেশ ও শ্রমিক স্বাস্থ্য একটি সমস্যা। কিন্তু সরকার প্রস্তাবিত ফ্লাই অ্যাশ দিয়ে তৈরি হওয়া ইট কি পরিবেশ বান্ধব, বা তাতে কি দুষণ ছড়াবে না? সিমেন্ট পিলার বা ফ্লাই অ্যাশের তৈরি নির্মাণ নিয়েও প্রশ্ন আছে। সর্বোপরি ভারতের মতো দেশে এতো মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে তার দায় কি সরকার নেবে? এই সমস্ত বিষয় নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। কিন্তু সেটাই সরকার করছে না।’’
সমস্যা যাই হোক, পরিবেশ বা শারীরিক অথবা সরকারি নীতি, কোপ পড়বে শ্রমিকদের ওপর। দু’বেলা দুটো খাওয়ার জন্য ইটভাটায় ধুলো, মাটি, কাদা গায়ে মেখে নিরলস ভাবে কাজ করে যান ‘ওঁরা’। দিনের শেষে আন্দোলন করে পাওয়া ভাটার মধ্যেই একচিলতে ঘর। সেখানেই চার থেকে পাঁচ জন চাটাই পেতে কোনও রকমে ঘুমিয়ে পরের দিন ফের ভোর থেকে কাজ করতে যান।
হাত পায়ের নখ কালো, মাথার চুল ধূসর গায়ের চামড়ার ওপরে ধুলোর আস্তরণ। জীর্ণ পোশাক, তাঁদের কথা ভাবার কি সময় আছে আদানি-আম্বানিদের সরকারের! সেই সব শ্রমিক যাঁরা লকডাউনের সময় পায়ে হেঁটে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গিয়েছিলেন, দেশের সরকার ভাবেনি তাঁদের কথা। সেই শ্রমিক যাঁদের গায়ে ব্লিচিং জল দিয়ে স্নান করানো হয়েছিল। সেই চিত্র বিজেপি সরকার দেখেনি! এরা সেই শ্রমিক যাঁদের ট্রেনকে ‘করোনা স্পেশাল’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন স্বয়ং এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। এঁরা সেই শ্রমিক যাঁরা না থাকলে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ডটাই হয়তো ভেঙে যেত।
কিন্তু তাঁদের কথা সরকার ভাববে না কেন, সেই প্রশ্নই তুলছে সিআইটিইউ।
Comments :0