অশোক তিওয়ারি
জেলা সম্পাদক, সিপিআই
সুপ্রিম কোর্টের আদেশে তৈরি মন্দির নির্মাণ ট্রাস্টের মন্দির তৈরি করার কথা। মন্দির তৈরির সেই ধার্মিক কাজকে সঙ্ঘ এবং বিজেপি রাষ্ট্র প্রযোজিত ঘটনায় পরিণত করেছে। উত্তর প্রদেশ সরকার সমস্ত জেলাশাসক এবং মণ্ডল আধিকারিকদের নির্দেশ পাঠিয়ে বলেছে, ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’র আগে সমস্ত মঠ-মন্দিরে সরকারের উদ্যোগে ধার্মিক অনুষ্ঠান করতে হবে। সরকারের আদেশের পরে মকর সংক্রান্তি থেকে মন্দিরে মন্দিরে সরকারি উদ্যোগে পুজোপাঠ চলছে। এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ সংবিধান বিরোধী। আসলে লোকসভা ভোটের আগে এই মন্দিরকে ঘিরে হিন্দুত্বের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। সেই কাজ করার জন্য কেন্দ্র-রাজ্যের দুই সরকার সমস্ত সাংবিধানিক মর্যাদা তছনছ করে গোটা প্রশাসনকে মন্দির নির্মাণের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।
ধর্মকে ব্যবহার করে ভোট জোটানোর কাজে দুই সরকার পুরো প্রশাসনকে লাগিয়ে দিয়েছে অথচ অযোধ্যার মানুষের সাধারণ সমস্যাগুলির কোনও সমাধান হচ্ছে না। অযোধ্যায় স্বাস্থ্য পরিষেবা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সারা দুনিয়ায় দেখানো হচ্ছে অযোধ্যায় উন্নয়নের জোয়ার বইছে। বিমান বন্দর, রেল স্টেশনে নয়া পরিসর, ফ্লাইওভার, চওড়া সড়ক ইত্যাদি দেখানো হচ্ছে। অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত অযোধ্যা ফৈজাবাদে ডেঙ্গু প্রায় মহামারীর অবস্থায় ছিল। এখন ঘরে ঘরে শ্বাসকষ্ট এবং হৃদরোগ জনিত সমস্যা। মন্দিরকে ঘিরে গত তিন-চার বছর ধরে চারদিকে বুলডোজার চালিয়ে ভাঙচুর, পাথর খোদাই এবং অন্যান্য কাজের জেরে দূষণের মাত্রা দিল্লি-নয়ডা-গুরগাঁওকে ছাপিয়ে গেছে বলে বারে বারে খবর হয়েছে বিভিন্ন হিন্দি সংবাদ মাধ্যমে। তার পিছু পিছুই হৃদরোগ আর শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা স্থায়ী অসুখে পরিণত হচ্ছে অযোধ্যার বাসিন্দাদের। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ, অন্যান্য উপকরণ, টেকনিসিয়ানের অভাব ইত্যাদির সঙ্গে যুঝছে। আর বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সাধরণের নাগালের বাইরে।
সরকারি হিসাবে ৩৬ হাজার কোটি টাকা এখানে সরকার খরচ করছে বিভিন্ন পরিকাঠামোর কাজের জন্য। সরকার সড়ক, সেতু, বিমানবন্দর, রেল স্টেশন মিলিয়ে যে বিশাল পরিকাঠামো নির্মাণের কাজ করছে তাতেও হাজারো মানুষের জমি নেওয়া হয়েছে। মন্দিরকে ঘিরে পর্যটনের আশায় এবং এই বিপুল পরিকাঠামো দেখে রিয়েল এস্টেট কারবারি এবং জমি মাফিয়ারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে অযোধ্যায়। শুধু অযোধ্যা শহরটুকু নয়, আশপাশের গ্রামীণ এলাকার জমিও আর রাখতে পারছেন না মানুষ। সরকার প্রশাসন শাসক দল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এই কাজে। যেখানে মন্দির নির্মাণ হচ্ছে, সেই রামকোট অঞ্চল- যা অযোধ্যার ধার্মিক মাহাত্ম্যের ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সেখানে মন্দির নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর তৈরি করে দেওয়া ট্রাস্ট বেপরোয়া জমি-মন্দির দখল করেছে।
আগে তো সরকার জমির পাট্টা দিত ৯৯ বছরের জন্য। সেই জমি ব্যবহার বা বিক্রি করা যেত। ৯৯ বছর বাদে যখন পাট্টা শেষ হয়ে গেল তখন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, পাট্টাদারকে ‘ফ্রি হোল্ড’ করে দেওয়া হোক কিছু টাকা নিয়ে। পয়সা জমা করার পরেও ফ্রি হোল্ড বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এখন যখন রাস্তা চওড়া করার নামে বাড়িঘর, দোকান ভেঙে দিচ্ছে, তখন ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার জন্য বলছে জমি তো নজুলের অর্থাৎ সরকারি। ক্ষতিপূরণের টাকা দিচ্ছে না। জমি যদি সরকারেরও হয়, বাড়ি ভাঙার জন্য তো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারকে। সেটাও দেওয়া হচ্ছে না, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কোনও নীতিই নেই। যাদের জমি নেওয়া হচ্ছে, তারাও দাম পাচ্ছে না। জমির সার্কেল রেট যা ছিল সেটা বাড়ায়নি। কাগজে কলমে যা দাম সেটা দিচ্ছে অথচ বাজার দরে দিচ্ছে না। ফলে অনেক কম দাম পাচ্ছে লোকে। কৃষকদের কিছু করার ছিল না। কেউ প্রতিবাদ করলেই জেল, বুলডোজার, গুন্ডা আইন। বহু লোক একান্তে বলছেন, বন্দুকের মুখে তাদের জমি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সামনে বলার কারো হিম্মত নেই। রামমন্দির নির্মাণের নামে সঙ্ঘ-বিজেপি এবং কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারের ঢক্কানিনাদের মাঝে পিষছে অযোধ্যার আম-জনতা।
এরমধ্যেই জেলাশাসক অন্য জায়গায় আধিকারিকদের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া, দাবি জানানোর মতো কাজ করেছে সিপিআই সহ বামপন্থীরাই। একদা বামপন্থীদের শক্তিশালী জায়গা অযোধ্যায় এখন ক্ষীণ হয়ে গেছে বামপন্থীরা। সেই সুযোগ নিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা। কারণ উত্তর প্রদেশের প্রধান বিরোধী শক্তিগুলি অযোধ্যার এই দুরবস্থা নিয়ে কোনও আন্দোলন, লড়াই-সংগ্রাম করেনি। সামান্য শক্তি নিয়ে বামপন্থীরা মানুষের কথাগুলি বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু যে সরকার সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির ন্যূনতম পরোয়া করে না, সেখানে দাবি জানানো কার্যত অনর্থক হয়ে গেছে।
Comments :0