Editorial

বালিকা খুন ধর্ষিতা মুখ্যমন্ত্রী ব্যস্ত ডান্ডিয়া নাচে

সম্পাদকীয় বিভাগ

মুখ্যমন্ত্রী এখন ব্যস্ত প্যান্ডেল উদ্বোধনে। সময় নেই নিঃশ্বাস ফেলার। এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন প্যান্ডেল উদ্বোধনে। সর্বত্র পৌঁছাতে পারবেন না, তাই ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করছেন শয়ে শয়ে প্যান্ডেল। কলকাতায় বসে বলছেন, আর উদ্বোধন হয়ে যাচ্ছে প্যান্ডেল, কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ। এবার উদ্বোধনে একটু বিঘ্ন ঘটল তাঁর এই মহৎ উৎসবের জনসেবায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ বিচারের দাবিতে রাস্তায়, তিনি তাই ২০ দিন আগেই হুকুম জারি করেছেন– অনেক হয়েছে, আর আন্দোলন নয়, এবার উৎসবে মাতুন। আর জি করে নির্যাতিতার বাপ-মা অন্ধকার ঘরে নীরবে চোখের জল ফেলছেন, ফেলুন। আপনারা উৎসবে মাতুন। বিষ্ণুপুরের ধর্ষিতা খুন হয়ে যাওয়া খেতমজুর মহিলার স্বামী-মেয়ে শোকে পাথর, তাতে কি, উৎসবে ফিরুন! মালবাজারের চা বাগানে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার তরুণী তীব্র অপমানের জ্বালায় জ্বলছে জ্বলুক, মুখ্যমন্ত্রী ব্যস্ত ডান্ডিয়া নাচে।  
আর জি করের ধর্ষণ-খুনের ঘটনার বিচার চেয়ে প্রতিবাদের আগুন যখন রাজ্যজুড়ে দাউদাউ জ্বলছে, তার মধ্যেই ১৩ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্টের মধ্যে ১৭টি নথিবদ্ধ ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে এরাজ্যেই। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ ঘটনায় ধৃত অথবা অভিযুক্ত শাসক দলেরই বাহিনী। থানায় অভিযোগ দায়ের করতে পারেনি এমন ঘটনাও ঘটেছে, যা সামনে আসেনি। এই সময়ে শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গেই ১০-৩১ আগস্টের মধ্যে আরও ১৮টি ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে। আর সেপ্টেম্বর মাসে নথিবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ৮টি। চার বছরের শিশুকন্যা থেকে প্রতিবন্ধী তরুণী অথবা পরিযায়ী শ্রমিকের স্ত্রী থেকে আইএএস অফিসারের স্ত্রী, বাদ যাচ্ছেন না কেউই। কুলতলীর মহিষমারীতে ৯ বছরের এক ফুটফুটে বালিকার ক্ষতবিক্ষত দেহ যেদিন উদ্ধার হচ্ছে, সেদিন সন্ধ্যায় ব্যস্ততম মানবিক মুখ্যমন্ত্রী প্যান্ডেল উদ্বোধনে ডান্ডিয়া নাচে মেতে উঠছেন। মহিষমারীর গ্রাম যখন শোকে পাথর, ৯ বছরের বালিকার খুবলে খাওয়া ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধারে রাজ্যবাসী যখন স্তম্ভিত, তখনই কয়েক কোটি টাকা খরচ করে রাজ্যের মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদ সহ তৃণমূলী ছোট বড় মেজো নেতাদের প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে কাঁচি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। ফিতে কাটছেন নাকি এরাজ্যের নারীদের গলা কাটছেন! 
যেদিন পার্কস্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডের মূল অপরাধীদের ধরার অপরাধে আইপিএস অফিসার দময়ন্তী সেনকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছিল, সেদিনই রাজ্যের সব অপরাধী বুঝেছিল, এই সরকার তাদের। জুন ২০১৩, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কামদুনি গ্রামে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এক কলেজ ছাত্রীকে গণধর্ষণ ও খুন করা হয়। অপরাধের নৃশংসতা পুরো দেশকে হতবাক করেছিল। পুলিশ এমনভাবেই অভিযোগ সাজায় যাতে দোষীরা ছাড়া পেয়ে যায় এবং সেটাই হয়। রাজ্যের অপরাধীরা আবারও বোঝে এই সরকার তাদেরই। ২০১৩, অক্টোবর, উত্তর ২৪ পরগণা জেলার মধ্যমগ্রামে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীকে দু’দিনে দু’বার গণধর্ষণ করা হয়েছিল। অভিযোগ দায়ের করার পর, নির্যাতিতা ও তার পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয় এবং পরে সেই কিশোরীকে পুড়িয়ে হত্যা করে দুষ্কৃতীরা। পুলিশ মেয়েটির ট্যাক্সিচালক বাবার কাছ থেকে মৃতদেহ ছিনিয়ে নিয়ে পালাবার চেষ্টা করে। সেক্ষেত্রে সফল না হলেও, ভয়ে মেয়েটির বাবা-মা নিজেদের রাজ্য বিহারে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। সেই ঘটনায় প্রকৃত দুষ্কৃতীদের ধরেনি পুলিশ, কারোরই শাস্তি হয়নি। অপরাধীদের কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়, এই সরকার তাদেরই রক্ষাকর্তা।
১৩ বছর ধরে এসব দেখতে দেখতে রাজ্যের মানুষের মনে ধিকিধিকি ক্ষোভের আগুন জমতে থাকে। আর জি কর কাণ্ডের নৃশংসতা এবং অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টায় সেই আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ। এই আগুনকে উৎসবের জল ছিটিয়ে নেভাতে তৎপর এখন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এবার তা হচ্ছে না। জুনিয়ার ডাক্তাররা অনশনে, কুলতলীর মহিষমারীতে আগুন জ্বলছে। আন্দোলনের এই আগুনেই শুদ্ধ করতে হবে রাজ্যে ১৩ বছরে জমা সব রক্ত-ক্লেদ-দুর্নীতির কাদাকে। সেই শপথেই অনড় থাক রাজ্যবাসী।
 

Comments :0

Login to leave a comment