EDITORIAL

ছন্নছাড়া অবস্থা

সম্পাদকীয় বিভাগ

যেমন আশঙ্কা করা গিয়েছিল বাস্তবে তেমনটাই হয়েছে। মনোনয়ন জমার প্রথম দিনেই রাজ্যের সর্বত্র চূড়ান্ত অব্যবস্থা, বিশৃঙ্খলা, হয়রানি, ভোগান্তির শেষ ছিল না। পাশাপাশি শাসক দল তাদের চরিত্র অনুযায়ী গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করেছে, বিরোধীদের বাধা দেবার চেষ্টা করেছে। তার জেরে কোথাও কোথাও দু-পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয়েছে। যথারীতি পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। প্রথমদিন শাসক দলের পক্ষে দলগতভাবে মনোনয়ন জমা দেবার কর্মসূচি ছিল না। তবে অনেকেই নিজ নিজ উদ্যোগে বা গোষ্ঠীগত উদ্যোগে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন।
প্রায় সপ্তাহ খানেক রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ শূন্য থাকার পর নতুন কমিশনার নিয়োগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ঘোষণা করে দেওয়া হল পঞ্চায়েত নির্বাচন। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে যায় আদর্শ আচরণবিধি। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই মনোনয়ন শুরু সকাল এগারোটা থেকে। নতুন কমিশনার শাসক দল তথা সরকারের (সহজ করে বললে পিসি-ভাইপো) কথা মত ধরেই নিয়েছেন কলকাতায় বসে নির্বাচনের বোতাম টিপে দেবেন সঙ্গে সঙ্গে জেলা, মহকুমা ও ব্লক স্তরে গোটা প্রশাসন যন্ত্রের মত চালু হয়ে যাবে। জেলা শাসকদের সঙ্গে বৈঠক করে সুবিধা-অসুবিধা বোঝার দরকার নেই। মহকুমা শাসকদের সঙ্গে কথা বলা বা ব্লকে ব্লকে প্রস্তুতি কোন স্তরে খোঁজ নেবারও প্রয়োজন নেই। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। অতএব ঘোষণা করে দাও। তারপর যা হবার হবে। রাজ্যটা যেন তৃণমূলের জমিদারি। তাদের খেয়ালেই চলবে সব কিছু।


মানসিকতা যদি দল দাসত্বের হয় তাহলে যোগ্যতা ও দক্ষতার স্বাধীন বিকাশ হয় না। এরাজ্যের অধিকাংশ আমলাই দলদাসত্বের মানসিকতার ঘেরাটোপে। তাই তাদের কাছ থেকে বেশি কিছু আশা করা বৃথা। নতুন নির্বাচন কমিশনারও যে সেই গোত্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেল। কিন্তু সেই বার্তা সার্কুলার আকারে সব স্তর পর্যন্ত পৌঁছায় নি। কীভাবে মনোনয়নপত্র গ্রহণ হবে সেই প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি ভোটকর্মীদের। তাদের বলা হয়েছে সকাল ৯টার মধ্যে অফিসে ঢুকতে। ৯টা থেকে ১১টা প্রশিক্ষণ হবে। তারপর মনোনয়ন। বাস্তবে দেখা গেছে কর্মীরা হাজির হলেও প্রশিক্ষকরা সময়মত হাজির হতে পারেননি। সর্বত্র পৌঁছায়নি মনোনয়নের ফরম। আসেনি জামানতের টাকা জমার ট্রেজারি রশিদ। অর্থাৎ কোনও আয়োজন সম্পূর্ণ না করে, প্রস্তুতির কাজে ঘাটতি চিহ্নিত করে তা পূরণের ব্যবস্থা না করে ঘোষণা করে দিলে যা হয় সেটাই হয়েছে। কমিশনার প্রথমদিনই বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি কতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারেন।
স্বাধীন সাংবিধানিক দায়িত্ব প্রাপ্ত কমিশনার নিজে থেকে সব যাচাই না করে নিরাপত্তার প্রশ্নটি পুরোপুরি সরকারের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। প্রায় ৬৩ হাজার বুথে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার জন্য ন্যূনতম সংখ্যক পুলিশ কোথা থেকে কীভাবে আসবে তিনি ভাবার প্রয়োজন মনে করেননি। প্রতি বুথে কম করে দু’জন সশস্ত্র পুলিশ দিতে গেলেও তো কম করে এক লক্ষ ৩০ হাজার সশস্ত্র পুলিশ লাগে। রাজ্য ও কলকাতা পুলিশ মিলিয়েও সেই পুলিশ নেই। তাছাড়া সবাইকে তো বুথে পাঠানো যায় না। নির্বাচন সংক্রান্ত অনেক কাজে পুলিশ দরকার। ভোট ছাড়াও সাধারণ নিরাপত্তার কাজে পুলিশ দরকার। সব থানা-ফাঁড়িতে পুলিশ রাখতে হয়। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য মজুত বাহিনীও রাখতে হয়। অর্থাৎ ভোটের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনের অর্ধেক পুলিশও রাজ্যে নেই। এই অবস্থায় নিরাপত্তার দায় এড়িয়ে ভোট ঘোষণা করে দিলেন কমিশনার।


কেউ যদি শাসক দলের আজ্ঞা বহন করতে এই পদে বসে থাকেন তাহলে অন্য কথা। কিন্তু যদি সংবিধান ও আইন মেনে সত্যি সত্যি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয় তাহলে নিজেকে সমস্ত বিষয় একেবারে গভীরে গিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে। যেকোন কাজ শুরুর আগে যাবতীয় প্রস্তুতি ঠিকঠাক হয়েছে কিনা দেখতে হবে। সম্ভাব্য সমস্যার জন্য আগাম প্রস্তুতি সেরে রাখতে হবে। যদি সত্যি সত্যি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হয় তাহলে বিরোধীদের প্রতিটি অভিযোগ, পরামর্শ, দাবি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। সরকারের উপর এবং শাসক দলের উপর অন্ধ বিশ্বাসে চোখ বুঝে বসে থাকলে চলবে না। নজর রাখতে হবে পুলিশের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর। নিরপেক্ষ অবস্থান তারা নিচ্ছে কিনা এবং প্রতিটি ঘটনায় সময় মত হস্তক্ষেপ করছে না। এই সবটাই কমিশনারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

Comments :0

Login to leave a comment