EDITORIAL

আমেরিকা-চীন-ভারত

সম্পাদকীয় বিভাগ

দু’দিনের চীন সফরের শেষদিন চীনের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক সেরে আমেরিকার বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন যখন জানিয়ে দেন এক চীন নীতিতে আমেরিকার অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি এবং স্বাধীন তাইওয়ানও সমর্থন করেন না ঠিক তার পরদিনই আমেরিকার সঙ্গে সামরিক ও স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে আমেরিকা রওনা হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মোদীর অভ্যর্থনার জন্য বি‍‌শেষ আয়োজন হয়েছে ওয়াশিংটনে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বেড়ে ওঠা চীন যখন সবচেয়ে শক্তিমান আমেরিকার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে তখন উদ্বিগ্ন আমেরিকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে নতুন কিছু সহযোগী শক্তির সাহায্য যারা চীনের মোকাবিলায় সামনের সারিতে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে আমেরিকার প্রথম এবং প্রধান পছন্দ ভারত। এক্ষেত্রে আমেরিকার অতিরিক্ত সুবিধা হয়ে গেছে মোদীর নেতৃত্বে ভারতে আরএসএস-বিজেপি ক্ষমতায় আসার ফলে। উগ্র জাতীয়তাবাদী এই অতি দক্ষিণপন্থী শক্তি ভারতকে জনকল্যাণকামী উদার গণতান্ত্রিক দেশ থেকে সামরিক শক্তি নির্ভর আগ্রাসী দেশে রূপান্তরিত করতে চায়। মোদী জমানায় তাই ভারতকে সামরিক শক্তিতে শক্তিধর করা অগ্রাধিকার পেয়েছে। বিদেশ নীতিতেও গুরুত্ব পেয়েছে সামরিক সম্পর্ক ও লেনদেন এবং সামরিক জোট গঠন। বাণিজ্য নীতিতে জোর দেওয়া হয়েছে সামরিক পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে। সর্বোপরি শিল্পনীতিতে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিতে সর্বাধিক জোর দেওয়া হয়েছে সামরিক উৎপাদনে। বিদেশি বিনিয়োগের, যৌথ উৎপাদনে সামনের সারিতে আছে সাময়িক পণ্য উৎপাদন। দুনিয়াদারির লক্ষ্যে আমেরিকা এমন দেশগুলিকে বেশি বেশি কাছে চায়। তাদের স্বপ্ন দেখায় দেশের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের বদলে অস্ত্রশক্তিতে শক্তিধর করার জন্য।


বহুদিন ধরেই এশিয়ায় বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর এলাকায় চীনের প্রভাব ঠেকাতে আমেরিকা সহযোগী খুঁজছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইনস আগে থেকে মার্কিন সহযোগী থাকলেও চীনের মোকাবিলায় তারা যথেষ্ট নয়। দরকার ভারতের মত সম্ভাবনাময় বিকাশমান শক্তির। মোদী ক্ষমতায় আসার পর নানা কৌশলে ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে তাতিয়ে দু’দেশের সম্পর্ককে তলানিতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এখন চীন-মার্কিন সম্পর্কের থেকেও চীন-ভারত সম্পর্ক বেশি খারাপ। ঠিক এটাই চেয়েছিল আমেরিকা।


এদিকে একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে বিগত কয়েক বছরে চীন ও আমেরিকার সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ জায়গায়। নানা নিষেধাজ্ঞায় জড়ানো হয়েছে চীনকে। তাইওয়ানকে সামনে রেখে সামরিক সংঘাত তীব্র আকার নিয়েছে। এই লড়াইয়ের আড়ালে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে অর্থনীতির। ক্ষতি আমেরিকারও কম হচ্ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে গোটা ইউরোপকে নামিয়ে আমেরিকা ইউরোপের অর্থনীতির নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছে। এই অবস্থায় পশ্চিমী দুনিয়া মনে করছে চীনের সংঘাত টিকিয়ে রাখলে আরও ক্ষতি অনিবার্য হয়ে উঠবে। তাই আমেরিকা উদ্যোগ নিয়েছে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা হ্রাস করতে যাতে অর্থনীতির ক্ষতি মেরামত করা যায়। তার জন্যই ব্লিঙ্কেনের চীন সফর। একই সময়ে চীনের প্রধানমন্ত্রী ও জার্মানির চ্যান্সেলার বৈঠকে বসেছেন। দু’দেশের ধসে যাওয়া অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে। অর্থাৎ যাদের ছকে মোদী সরকার চীনকে সবচেয়ে বড় শত্রু চিহ্নিত করে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করছে তারা নিজেদের স্বার্থে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে উদ্যোগী হলেও ভারত কিন্তু সেটা উপলব্ধি করতে পারছে না। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির কথা ভাবতেই পারছে না। আমেরিকার সাজানো দাবার বড়ে হিসাবে ভারত নিজের ক্ষতি করে আমেরিকার স্বার্থসিদ্ধি করছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment