১৯৬৬ সালে যৌথ পরিবারে বড় হওয়া আমি বাড়িতে বান্দাকাকার ঘরে বসে রেডিওতে বিবিসি-তে বিশ্বকাপের ধারা বিবরণী শুনতে শুনতে কখন যেন হারিয়ে গেছিলাম ছোটবেলার স্বপ্নের নায়ক পেলের বিরুদ্ধে বিপক্ষের অন্যায় আচরণের আর সেটাই স্বচক্ষে দেখা পর্দার মাধ্যমে প্রাক্তন প্রয়াত ভারতীয় ফুটবল প্রশিক্ষক অমল দত্তর বিশ্বকাপের খেলা দেখানোতে। সেদিন ভাবতে পারিনি ১৯৯০ সালে অলিম্পিকের থেকেও বর্ণময় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে যাব। আমি ও মোহনবাগান ক্লাবের প্রাক্তন অধিনায়ক নিমাই গোস্বামী রোমে যাই। যেহেতু দু’জনেই তখন ক্লাব কোচিং করতাম অনেক সাংবাদিকদের সাহায্য পাই। এছাড়া মিশেল প্লাতিনি, বেকেনবাওয়ার, রুটি ভয়লার, ইংল্যান্ড কোচ রবসন, ইউসেবিও, ফিফা প্রেসিডেন্ট হ্যাভালের সঙ্গে পরিচিত হই। রোমে মিডিয়া সেন্টারে পরিচিত হয়েছিলাম ১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপের (উরুগুয়েতে) প্রথম গোলদাতা মঁসিও লুসিও লোঁবেটের সাথে। ওনাকে ভারতীয় ফুটবল সম্বন্ধে বলতে পেরেছিলাম। একজন ভারতীয় স্ট্রাইকার হিসাবে এটা বড় প্রাপ্তি। এরপর ১৯৯৪ সালে আমেরিকা, ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপ গিয়েছিলাম। আজ ২০২২ নভেম্বরে এশিয়া মহাদেশের কাতারে শুরু বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ কাতারের সঙ্গে ইকুয়েদরের খেলা দিয়ে। সম্ভবত এই প্রথমবার জুন-জুলাই বাদ দিয়ে নভেম্বরে বিশ্বকাপ। কাতারের আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এই মরশুম বেছে নেওয়া হয়।
বিশ্বকাপের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে প্রতি বিশ্বকাপ জন্ম দিয়েছে নতুন নতুন ফুটবল তারকাদের যাঁরা তাদের দেশকে গর্বিত করে এসেছেন। হাঙ্গেরির পুসকাস, রাশিয়ার লেভ ইয়াসিন, ব্রাজিলের গ্যারিঞ্চা, ভাবা, ডিডি, পেলে, ইংল্যান্ডের ববি মুর, ববি চার্লটন থেকে গ্যারি লিনেকার, ইতালির পাওলো রোসি, হল্যান্ডের রুদ গুলিট, বাস্তেন, ফ্রান্সের প্লাতিনি, তিগানা, দিদিয়ে দেঁশ (বর্তমান কোচ) জিদান, আর্জেন্টিনার লুকে, ফেমেন্স, সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিয়াগো মারাদোনা, জার্মানির রুমেনিগে, লোথার ম্যাথুজ, বেকেনবাওয়ার, পর্তুগালের ইউসেবিও। আজকের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্ট্রাইকার ক্রিশ্চিয়ান রোনাল্ডো যার সঙ্গে একমাস ধরে তুলনা চলবে আর্জেন্টিনার শ্রেষ্ঠ সম্পদ লিও মেসির ও ব্রাজিলের নেইমারের। আরেক প্রতিভা এমবাপে ইতিমধ্যে বিশ্বকাপ জিতেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির কারণে তাঁরা এখনও বিশ্বকাপ জেতেননি। খানিকটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাচ্ছে তাঁদের অসামান্য ফুটবল জীবন।
এবারে কাতারের ৮টি স্টেডিয়াম, দোহার হার্মাদ আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট সাজানো হয়েছে ফুটবল পরিমণ্ডলকে ঘিরে। যাঁরা দেখবার সুযোগ পাচ্ছেন তাঁরা দেখবেন এক অসাধারণ ফুটবল পরিমণ্ডল। প্রতিযোগী ৩২টি দল পৌঁছে গেছেন কাতারে এবং সব দলই খেলে নিয়েছেন বেশ কিছু প্রস্তুতি ম্যাচ।
আরব আমরশাহির বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার ৫ গোলে জয় দলকে অনেকটা উদ্বুদ্ধ করবে। কোচ স্কালোনিও, অধিনায়ক মেসিও তৃপ্ত দলে সেইরকম বড় চোট আঘাত নেই। শেষ মুহূর্তে অবশ্য ফরওয়ার্ড নিকোলাস গঞ্জালেসের আঘাত থাকায় বিকল্প নিতে হয়েছে। ব্রাজিলে দলকে তিতে নিজের মতন করে সাজিয়েছেন, কিছু বেশি বয়সী খেলোয়াড়কে দলে নেওয়ায় সমালোচনা হয়েছে। এটাই নিয়ম। কোচেদের মাথা ঠান্ডা রেখে দলকে পরিচালনার উপর সাফল্য নির্ভর করে। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবারেও অন্যতম দাবিদার। কোচ দেঁশকে আমি তিনটি বিশ্বকাপেও খেলতে দেখেছি মাথা ঠান্ডা রেখে অনেকটা জায়গা নিয়ে খেলতেন। কোচিংটা সাফল্যের সঙ্গে করে চলেছেন।
ফুটবল জীবনে আসার পর থেকে দেখেছি ৫০-এর দশক থেকে ৮০ দশক পর্যন্ত লাতিন আমেরিকার ও ইউরোপের দলগুলির প্রাধান্য ছিল। কিছু ব্যতিক্রম হয়েছিল। ১৯৬৬-তে এশিয়ার উত্তর কোরিয়া দারুণ ফুটবল দেলেছিল। পর্তুগালের সঙ্গে ইউসেবিও’র অসাধারণ খেলার জন্য ৪-৩ গোলে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। তারপর আফ্রিকা মহাদেশের উত্থানে নাইজিরিয়া, স্যামেরুন, ঘানা দেশগুলি মাঝে মধ্যেই ধাক্কা দিয়ে গেছে। ১৯৯০ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বিশ্বকাপ সামনে বসে দেখার। প্রিয় দলগুলির আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, দলের অনুশীলন দেখার।
একটা কথা লিখতে বাধ্য হচ্ছি, বর্তমান বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়েরা স্পেনের লিগ, ইতলি লিগ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলে থাকেন। গত দু’বছর ধরে সারা বিশ্বের ফুটবল মারণ রোগের কারণে ব্যাহত হয়েছে। খেলোয়াড়দের মধ্যে সংযোগ হারিয়েছে। কোচেদের, ক্লাবগুলির চিন্তা ভাবনার বিচ্যুতি ঘটেছে। জানিনা এই বিশ্বকাপে তার প্রভাব পড়বে কি না। যদিও প্রফেশনাল খেলোয়াড়রা এই সব কাটিয়ে উঠে থাকেন। বিভিন্ন লিগে খেলা খেলোয়াড়েরা যখন দেশের জার্সিতে মাঠে নামেন তখন অনুভূতি আলাদা হয়। প্রতীক্ষা করে থাকবে সারা পৃথিবী এইবার কোচদের মস্তিষ্কের খেলা হবে না পেলে মারাদোনার মতো প্রতিভাধর কোনও কোনও খেলোয়াড় তিনি এমব্যা পে হোক বা নেইমার-মেসি, রোনাল্ডো হউন বা অন্য কোনও দেশের জুনিয়র কোনও খেলোয়াড় যাদের হাত ধরে বিশ্বকাপ তাদের দেশে যাবে। দেখব ১৯৬৬ উত্তর কোরিয়ার মতন অন্য কোনও দেশ কোনও অঘটন ঘটায় কিনা এই বিশ্বকাপে।
২০২২ বিশ্বকাপ অভাববোধ করবে শুরুতে মাঠে থাকবেন না ফুটবলের দুই প্রবাদ ব্রাজিলের পেলে (অসুস্থতার জন্য) ও মারাদোনা যিনি বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে।
Comments :0