প্রজাদের রুটি কেনার ক্ষমতা নেই, এতটাই গরীব তাঁরা। এই পরিস্থিতি শুনে ফ্রান্সের সাম্রাজ্ঞী মারি আঁতোয়ানেতকে ১৭৮৯ সালে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘রুটি খেতে পাচ্ছ না তো কি হয়েছ? কেক কিনে খাও!’’
এই মন্তব্য ফরাসি বিপ্লবের সলতে’তে শেষ স্ফূলিঙ্গের ভূমিকা পালন করেছিল। জনতার রোষে গিলোটিনে মাথা খোয়াতে হয়েছিল মারি আঁতোয়ানেত সহ গোটা ফ্রান্সের সামন্ততন্ত্রকে। কিন্তু ইতিহাস থেকে ক্ষমতাশালীরা যে শিক্ষা নেন না, তার প্রমাণ মিলল ২০২৪ সালের আমেরিকায়।
এই মুহূর্তে মূল্যবৃদ্ধির আগুনে গোটা পশ্চিমী দুনিয়ার মতোই জ্বলছে আমেরিকা। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম ক্রমেই দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় মার্কিন বহুজাতিক খাদ্য প্রস্তুতকারক সংস্থা কেলগ্সের সিইও গ্যারি পিলনিক বলেছেন, ‘‘মূল্যবৃদ্ধির জন্য মানুষ রাতের খাবার জোগাড় করতে পারছেন না তো কি হয়েছে? তাঁরা ১ বাটি করে কেলগ্স কর্নফ্লেক্স কিনা খান।’’
পিলনিকের এই মন্তব্যে কার্যত জনরোষ তৈরি হয়েছে আমেরিকা জুড়ে। ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ টিকটকের মত সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন। ঠিক হয়েছে, পিলনিক’কে উচিত শিক্ষা দিতে ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন অবধি ৩ মাস ব্যাপী কেলগ্স বয়কটের প্রচার চলবে টিকটক জুড়ে।
একজন টিকটক ব্যবহারকারী বলেছেন, ‘‘আমাদের বিপদে ফেলা ছাড়া কেলগ্স’র অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই। তাই ইচ্ছেমত দাম বাড়িয়েছে। এখন আমাদের দুরবস্থা নিয়ে রসিকতা করছে।’’
এই ভিডিওটি ইতিমধ্যেই ২০ লক্ষ মানুষ দেখেছেন এবং ৩ লক্ষ মানুষ লাইক দিয়ে সমর্থন করেছেন।
অপর এক টিকটক ব্যবহারকারী বলেছেন, ‘‘ প্রথমে বলা হল আমাদের দুরবস্থার জন্য দায়ী আমাদের অত্যধিক কফি পানের অভ্যাস, তারপর বলা হল অ্যাভোকাডো ফলের টোস্ট খাই বলে আমরা গরীব। এখন কেলগ্স’র সিইও বলছেন, তুমি ডিনার জোগাড় করতে পারছে না? কেনও ব্যাপার নয়। তুমি কেলগ্স কিনতে থাকো। আমরা এই ব্যবস্থা পালটে ছাড়ব।’’
এই ভিডিওটি ৬ লক্ষের বেশি ভিউ এবং ১ লক্ষের বেশি লাইক কুড়িয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহে মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল সিএনবিসি’র একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন কেলগ্স’র সিইও গ্যারি পিলনিক। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সিরিয়াল পণ্য বা খাদ্যশস্য থেকে তৈরি পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের আয়ত্বের মধ্যে। আর্থিক চাপের মুখে পড়লে অন্য খাবারের বদলে আমাদের সিরিয়ালগুলি খাওয়া উচিত সাধারণ মানুষের।’’
তিনি হিসেব কষে দেখান, একবাটি কেলগ্স সিরিয়াল ফল ও দুধ সহ খাওয়ার খরচ ১ ডলারের কম।
যদিও উপভোক্তা আন্দোলনের কর্মীদের বক্তব্য, ‘‘গত ২ বছরে যেই সংস্থাগুলি সবথেকে বেশি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়েছে, কেলগ্স তাদের মধ্যে অন্যতম।’’
আমেরিকার উপভোক্তাদের অধিকার রক্ষার লড়াই করা একটি সংস্থার তরফে লিজ জেলনিক ইয়াহু ফাইন্যান্সকে বলেছেন, ‘‘মার্কিন বাজারে জিনিসের দাম বাড়িয়ে মুনাফার পরিমাণ আরও বাড়ানোর চক্রান্ত করেছে কয়েকটি কর্পোরেট সংস্থা। এরফলে শ্রমজীবী অংশের মানুষ সমস্যায় পড়েছেন। বাজার চালিত এই সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে কেলগ্সের বিক্রি এবং স্বাভাবিক ভাবে মুনাফা আরও বাড়ানোর ছক কষেছেন পিলনিক।’’
লিজ জেলনিকের বক্তব্য, ‘‘উপভোক্তাদের এই ধরণের কষ্টকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার কথাই তো ছিলনা। শুধুমাত্র মার্কিন সংসদ বা কংগ্রেস খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে না বলেই এই সঙ্কট।’’
মিনিয়াপোলিস স্টার ট্রিবিউনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের অক্টোবরের তুলনায় ২০২৩ সালের অক্টোবরে কেলগ্সের প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে গড়ে ১৭.১ শতাংশ হারে।
এই মুহূর্তে ৪০ বছরে সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধির মুখোমুখি হয়েছে মার্কিন অর্থনীতি। জিনিসের দাম বাড়লেও বাড়েনি শ্রমিক, কর্মচারী সহ সাধারণ মানুষের ন্যূনতম বেতন। তারফলে মার্কিন জনতার একটা বড় অংশ দ্রুত দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাচ্ছেন।
Comments :0