Brazil

ক্যানারির বিদ্রোহ, ১৩ নম্বর জার্সি পরবেন লুলা

খেলা

১৩ নম্বর জার্সি পরবেন লুলা দ্য সিলভা। ব্রাজিলের ভাবী রাষ্ট্রপতি, নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে যিনি দায়িত্ব নেবেন। বিশ্বকাপের ময়দানে এই জার্সি থাকবে দানি আলভেসের শরীরে। কিন্তু লুলা ‘ ১৩’ বেছেছেন নির্বাচন কমিশনের কাছে তাঁর দল ওয়ার্কার্স পার্টির ক্রমিক সংখ্যার বিচারে। 
হলুদ-সবুজ জার্সি, আদর করে যাকে ‘ক্যানারিনহো’ ডাকেন ব্রাজিলের মানুষ, ছোট্ট হলুদ ক্যানারি পাখি, সাম্প্রতিক সময়ে জড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক মেরুকরণে। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি জায়ের বোলসোনারো নিজে ও তাঁর সমর্থকরা এই জার্সি পরেই ঘুরে বেড়িয়েছেন, নির্বাচনী প্রচার করেছেন। ২০১৫ থেকেই এই প্রবণতা চলতে থাকে, তা বেড়ে ওঠে সাম্প্রতিক সময়ে। এমনকি বোলসোনারো রাষ্ট্রপতি ভোটে হেরে যাওয়ার পরেও তাঁর উগ্র সমর্থকদের একাংশ দেশে যে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তা ওই জার্সি পরেই। ব্রাজিলের সবচেয়ে মর্যাদার প্রতীককে আত্মসাৎ করে দক্ষিণপন্থীরা। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে প্রগতিশীল, উদারবাদী, এক কথায় অতি-দক্ষিণপন্থা বিরোধীরা ওই জার্সি পরাই বন্ধ করে দেয়। অথচ আগে ব্রাজিলের ম্যাচ মানেই গোটা দেশ ওই জার্সি পরে থাকত। এবারের বিশ্বকাপের আগেও ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যমে মানুষের একটি বড় অংশই জানিয়েছেন, দক্ষিণপন্থীদের চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে ওই জার্সি, ওই পোশাক না পরেই খেলা দেখব। 
এই কারণেই লুলার জার্সি পরার ঘটনা নতুন তাৎপর্য পেয়ে গেছে। লুলা বলেছেন, ‘হলুদ-সবুজ কোনও প্রার্থী নয়, কোনও দলের সম্পত্তি নয়। ২১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষের রং, এই দেশের যারা অধিবাসী, এই দেশকে যারা ভালোবাসে তাদের রং।’ 
ব্রাজিলে বোলসোনারোর উত্থান এক বিকৃত জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করেই। প্রাক্তন সামরিক কর্তা, খোলাখুলি বৃহৎ পুঁজির সমর্থক, অ্যামাজন অরণ্যকে অবাধ দখলদারির জন্য খুলে দেওয়া, পদে পদে গণতন্ত্রের ওপরে আঘাত নামিয়ে আনা, রক্ষণশীল মূল্যবোধের কট্টর প্রচারক বোলসোনারো দেশে মেরুকরণ যে করতে সক্ষম হয়েছেন, তা বাস্তব। এবারের ভোটেও বামপন্থী লুলা যখন তাঁকে হারিয়েছেন তখনও প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ২২লক্ষের বেশি নয়। 
ফুটবলও জড়িয়েছে এই মেরুকরণে। এই প্রথম তা নয়। যে দেশে ফুটবল জীবনের অনেকটা জুড়েই সেখানে সামরিক স্বৈরশাসক থেকে প্রতিবাদীরা—সকলেই ফুটবলকে হাতিয়ার করেছেন। এবারের মেরুকরণে খানিকটা হলেও জড়িয়েছিলেন ফুটবলাররাও। ভয়ে বা ভক্তিতে নেইমারের মতো নক্ষত্র বোলসোনারোর প্রচার ভিডিও’তে তাঁকে সমর্থনের কথা বলেছিলেন। দানি আলভেস, প্রাক্তন ফুটবলার রোমারিও, রোনাল্ডিনহোও একই পথের শরিক হয়েছিলেন। আবার রিচার্লিসনের মতো বিরুদ্ধতার স্বরও শোনা গেছে। জর্জিনহোর মতো প্রাক্তন ফুটবলার নেইমারকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘ভুলে যেও না আমরা কোথা থেকে এখানে পৌঁছেছি। লুলা কিন্তু সেখানেরই লোক।’ ফাভেলা বা বস্তি, জীর্ণ-দীর্ণ শ্রমিক মহল্লার ছেলেরাই ব্রাজিলের ফুটবলে দাপট দেখিয়েছে চিরকাল। 


এই মেরুকরণ যে রয়েছে, তা জেনেই কাজ সবচেয়ে কঠিন হয়েছে কোচ তিতের। দেশে মেরুকরণের ঝোড়ো বিতর্কের সময়ে সংযত তিতে বলেছিলেন, ‘সামাজিক দায়িত্ব’ এবং ‘বৃহত্তর সমতার’ কথা। জাতীয় দলকে মেরুকরণে টেনে আনার বিপদের কথাও বলেছেন। এই কথা যে বোলসোনারোর পক্ষে যায় না, তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। বিশ্বকাপে ব্রাজিলের শিবিরে কি রাজনৈতিক কথাবার্তা বলা নিষিদ্ধ? তিতেকে প্রশ্ন করেছিল এক ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম। তিতে বলেছেন, ‘মোটেই নয়, এভাবে গণতন্ত্র হয় না। একে অন্যের মতকে সম্মান জানানো উচিত, গণতন্ত্র তাই বলে।’ 
দলে এই মেরুকরণের প্রভাব পড়বে না হয়তো, কিন্তু বিভাজিত ব্রাজিলকে ঐক্যবদ্ধ করার এক সুযোগ সামনে, একথা বিলক্ষণ জানেন তিতে। ব্রাজিল এবার শক্তিশালী দল। অন্যতম ফেভারিট। ‘হেক্সা’, ষষ্ঠবার বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। গোটা দেশকে এক জায়গায় আনতে পারেন নেইমাররাই। হলুদ-সবুজ জার্সিই হতে পারে এই ঐক্যের প্রথম ধাপ। ১৯৫০ থেকে ব্রাজিল এই জার্সি পরে খেলছে। কিন্তু ১৯৭০-এ প্রথম রঙিন লাইভ সম্প্রচারে এই জার্সি পরে ফুটবল শিল্পীদের ম্যাজিক জার্সিকেই বিশ্বজোড়া এক নতুন মর্যাদা এনে দেয়। 
দক্ষিণপন্থার হাত থেকে জার্সি উদ্ধার ব্রাজিলের এক নতুন যুদ্ধ। কাতারে নয়, ব্রাজিলের পাড়ায় পাড়ায় এই যুদ্ধ হবে। কেউ কেউ ১৯৫৪ সালের সেলেকাও জার্সির ওপরে লাগিয়ে নিয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির লাল তারাও। ‘রিভোল্টা ক্যানারিয়া’ নামে দক্ষিণপন্থা বিরোধী জার্সির ব্র্যান্ডও তৈরি হয়ে গেছে। 
ব্রাজিল শেষবার বিশ্বকাপ জিতেছে ২০০২-এ। লুলাও প্রথম বার রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন ওই বছরে। হয়তো বছর কুড়ি পরে ইতিহাস ফিরছে, এমন আশাও রয়েছে পথে প্রান্তরে।

 

Comments :0

Login to leave a comment