Modi-Erdogan

মোদি, এরদোগান এবং গণতন্ত্রের বিপদ

জাতীয় আন্তর্জাতিক

সৌরভ গোস্বামী

 

প্রথম রাউন্ডেই বাধা টপকে যেতে পারেননি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। তুরস্কের রাষ্ট্রপতি ভোটে ৫০ শতাংশের গণ্ডি পেরতে পারেননি অল্পের জন্য। কুড়ি বছর ধরে রাষ্ট্রপ্রধান তিনিই। ২৮ মে ‘রান অফ’, এরদোগানের সঙ্গে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর। যাঁর থেকে প্রায় ৬ শতাংশ ভোটে এগিয়ে এরদোগান। নির্বাচনের আগে পরে, ভারতে কেবল নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এরদোগানের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির সাদৃশ্য।  


মে মাসের শুরুতে, ঠিক ছিল তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের গণভোট-পরবর্তী প্রথম নির্ধারিত বিদেশ সফর ছিল ভারতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করার জন্য। ‘স্বাধীন কাশ্মীর’-র স্লোগানে পাকিস্তানের ভাষ্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রচার করেছেন এরদোগান। তবে মোদী-এরদোগান সম্পর্কের উষ্ণতা তাতে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। দু’দেশের বাণিজ্য দ্বিপাক্ষিক লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এমনকি একাধিক ক্ষেত্রে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। গত বছরে সেপ্টেম্বরে মোদী-এরদোগান বৈঠকে তা নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। 
পর্যবেক্ষকরা অনেকেই বলছেন, মোদী এরদোগান মিল চোখ এড়ানোর নয়। দু’জনেই ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছেন। দু’দেশেরই ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্রকে পিছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। বস্তুত দু’জনের সমর্থনে যে রাজনীতি সোচ্চার, প্রকাশ্যেই তা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী। বিরোধী নাগরিক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যেরও। 


নির্বাচনের আগে এরদোগানের বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন পেঁয়াজের চড়া দাম নিয়ে। বস্তুত নাজেহাল অর্থনীতি তুরস্কে, কমেছে জাতীয় মুদ্রার দাম। এরদোগানের সমর্থকরা বলেছেন, পেঁয়াজের দাম নিয়ে এই ভোট নয়। তুরস্কের গৌরব ফিরিয়ে আনা, তুর্কিদের গৌরব প্রতিষ্ঠার লড়াই করছেন এরদোগান। অটোমান সাম্রাজ্যের ‘মহান তুরস্ক’ ফিরিয়ে আনার প্রচার এরদোগানের অন্যতম হাতিয়ার। মোদী-আরএসএস-বিজেপি’র আর্য যুগের ‘অখণ্ড ভারত’ স্লোগানের সঙ্গে মিলও রয়েছে। এরদোগানের রাজনীতি কুর্দ জনগোষ্ঠীকে ‘শত্রু’ বানায়, মোদীর রাজনীতি যেভাবে মুসলিমদের দেখে।  
দু‘দেশেই বহুত্ববাদী সংস্কৃতিক সমাজের ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা করে। দুজনেই ‘শক্তিশালী‘ ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন করেছেন যা তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা তাদের দেশের দীর্ঘ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ‘‘অভিজাত’’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং জনপ্রিয়তাবাদী (Populism) নীতির প্রচার করে। দুই নেতার প্রবল সাদৃশ্য নজরে পড়ার মতো।
তুরস্ক কিন্তু পশ্চিমী জোট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ‘ন্যাটো’-র সদস্য। ‘ন্যাটো’ ছাড়া দূর, বরং বোঝাপড়া শক্তিশালী করেছে এরদোগানের বিদেশনীতি। যেভাবে চীন বিরোধী মার্কিন নেতৃত্বাধীন চার দেশের জোট ‘কোয়াড’ ভারতের নীতি ঠিক করে দিচ্ছে। 


এরদোগান তুরস্কের রাজনৈতিক ইসলামের (Political Islam) একটি বাইপ্রোডাক্ট, যেটিকে কয়েক দশক ধরে পূর্বের ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের অধীনে পশ্চাতে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। জাতির চরিত্র পরিবর্তনের উচ্চাভিলাষী আদর্শ নিয়ে তিনি ক্ষমতায় আসেন এবং ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তার লক্ষ্য অর্জন করেছেন।
তার দল, একেপি বা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি  (Justice and Development Party) নির্বাচনে ব্যাপক জয় লাভ করে এবং ২০১৪ সালে তিনি একটি গণভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তারপর থেকে, তুরস্ক একটি ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী দেশে পরিণত হয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপরীত দিকে চলে গেছে। নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন করা থেকে এবং দেশে আগের চেয়েও বেশি মেরুকরণ হয়েছে। নির্বাচনকালীন সময়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা বৃদ্ধি একটি উদাহরণ মাত্র।


মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছিল, "হিন্দুত্ব" এর এজেন্ডাকে সামনে রেখে। এই ধারণা অনুসারে ভারত শুধুমাত্র হিন্দুদের আবাসভূমি। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, বিশেষ করে মুসলিম, দলিত ও খ্রিস্টানরা নিয়মিত আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। ভারত ও তুরস্ক উভয় দেশেই এই দুই নেতার স্বৈরাচারী প্রবণতা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিবাদের মুখে পড়েছে। রাজনৈতিক বিরোধী, সমাজকর্মীরা কর্তৃত্ববাদের শিকার। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের তীব্রতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। 
তুরস্কে, ২০১৬ সালের জুলাইয়ে অভ্যুত্থানের চেষ্টার পর থেকে, মানবাধিকার লঙ্ঘন আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। ক্যু ভেস্তে দেওয়ার সাথে সাথে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল (এটি এখন প্রায় এক বছর হয়ে গেছে)। জরুরি ফতোয়া জারি করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে যে কোনো ধরনের বিরোধীতা থেকে দূরে রাখতে।  শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদদের তাদের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে, গ্রেপ্তার বা কন্ঠ রোধ করা হয়েছে। মিডিয়াকে শাসনের অনুগত থাকার জন্য ক্রমাগত চাপ দেওয়া হচ্ছে। 


ডেমোক্রেসি ওয়াচডগ ফ্রিডম হাউস তুরস্ককে একটি "আংশিক মুক্ত" দেশ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে যেখানে কোনও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই, অন্যদিকে এটি ভারতকে একটি মুক্ত দেশ হিসেবে মনে করে যেখানে আংশিক মুক্ত সংবাদমাধ্যম রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেসি ইনডেক্স অনুসারে, তুরস্ক একটি হাইব্রিড শাসন ব্যবস্থা যেখানে ভারতকে একটি ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এরদোগান এবার ভোটের প্রচারে নামার ঠিক আগে দু’টি প্রতিরক্ষা বিমান চালু করেন। ড্রোনবাহী ‘টিসিজি আনদোলু’ এবং প্রতিরক্ষা বিমান ‘কান’ গণসমাবেশ করে সামনে আনা হয়। সামরিক উর্দিতে অংশ নেন এরদোগান।

Comments :0

Login to leave a comment