শমীক লাহিড়ী
আমরা আসছি আপনার কাছে। হ্যাঁ, আপনারই কাছে।
আপনি কি সেই ৪০ লক্ষ হতভাগ্য পাটচাষিদের মধ্যে কেউ? আপনিও কি সরকারি বিক্রয়কেন্দ্র খুঁজে না পেয়ে বাধ্য হয়েছেন ফড়ে দালালদের কাছে কম দামে পাট বিক্রি করতে? চাষের টাকায় আর সংসার চলছে না!
আপনি তো চান অন্তত চাষের খরচ উঠে কিছু টাকা ঘরে নিয়ে যেতে। এটা শুধু আপনার একার কথা নয়। আমরাও আছি।
উত্তরবঙ্গের চাষির যন্ত্রণা নিয়েই আমরা পৌঁছে যাবো চটকলের শ্রমিক লাইনে। আপনি মাসে ১০ দিন কাজ পান চটকলে? লকআউট নাকি ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক আপনি? অবসরের পরেও পিএফ-গ্র্যাচুইটির টাকার জন্য মাথা খুঁড়ে মরছেন? কোচবিহারের পাটচাষি অথবা কামারহাটির শ্রমিক— যন্ত্রণা একই।
একইভাবে ফড়ে-দালালদের হাতে লুট হচ্ছে কৃষকের ফসল— ধান থেকে সবজি। এই জন্যই কোচবিহার থেকে কামারহাটি – হাজার কিলোমিটার পথ বেয়ে আমাদের যাত্রা, শুধু আপনাদের যন্ত্রণার শরিক হতেই নয়, আগামীতে দিন বদলের দাবিতে একসাথে আন্দোলনে নামাই আমাদের লক্ষ্য।
আপনার সন্তান, আমার বন্ধু, আপনার স্বামী পেটের তাগিদে বাংলা ছেড়ে অন্য রাজ্যে কাজের খোঁজে গেছেন? বাপের খোঁজে শিশু সন্তান কাঁদছে, আর আপনি স্বামীকে কাছে না পেয়ে গুমরে কাঁদছেন? অসহায় বৃদ্ধ বাপ-মা পথ চেয়ে বসে আছেন! আপনি মালদা মুর্শিদাবাদ বীরভুম নাকি ২৪ পরগনা – কোথায় থাকেন? আমরা আসছি আপনার কাছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ— আমাদের পথ অতিক্রম, আপনার কাছে যাওয়ার জন্যই। পালটাতেই হবে আমাদের বাংলাকে।
এখানেই চাই ১০০ দিনের কাজ, এখানেই চাই ফসলের ন্যায্য দাম, ফড়ে দালাল মুক্ত বাজার। আসুন আমরা হাত মেলাই— আমাদের এই মাতৃভূমির নির্বাসিত সন্তানদের ফিরিয়ে আনতে।
তৃণমূলের দুর্নীতির বন্যায় আপনি চাকরি হারা? শিক্ষক নেই, তাই আপনাদের গ্রামের স্কুলে তালা? সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাবে, এই দুশ্চিন্তা রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে আপনার? আমরা আসছি আপনার কাছে। ফেরাতেই হবে শিক্ষার হাল। নতুন করে আবার বাংলা গড়বো আমি-আপনি-সবাই মিলে। আবার স্কুল-কলেজের ক্লাস ঘরগুলো ভরে উঠবে ছাত্র-ছাত্রীদের কলতানে। এই বাংলাকেই আপনি ফিরে পেতে চান নিশ্চয়ই। আমরাও আপনার সাথে হাত মিলিয়ে এই বাংলাই গড়তে চাই।
আপনার গ্রামে নীল-সাদা রঙের স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, কিন্তু ডাক্তার, ওষুধ নেই? চিকিৎসার অভাবে নিজের মাকে বাঁচাতে পারেননি? আপনার সন্তানের জন্য ওষুধ পাচ্ছেন না? শুধু আপনার এলাকারই নয়, এটাই চেহারা গোটা রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার। রমরমা বেসরকারি নার্সিংহোম আর ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে জমি-বাড়ি বেচতে হয়েছে? আমাদের কাছে প্রতিটি জীবন মূল্যবান— এই কথা নিয়েই আমরা আসছি, আপনারই কথা শুনতে, জীবন বাঁচানোর স্বপ্ন নিয়ে নতুন বাংলা গড়তে।
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসের ১৫ তারিখ রাত থেকে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি আলিপুরদুয়ারের জয়গাঁও-এর বছর সাতেকের ফুটফুটে এক শিশুর বাপ-মা। তাদের আদরের ‘গোলাপ’-এর ছোট্ট ফুলের মতো দেহটাকে জ্বলতে দেখেছিলেন তাঁরা। কুলতলির মহিষমারি গ্রাম— সেখানেও এক হতভাগ্য বাপ-মা তাঁদের আদরের ১০ বছরের সন্তানকে হারিয়েছেন এমনিভাবেই। ২০২৪ সালের ৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় টিউশন পড়ে আর বাড়ি ফেরেনি সে। কামদুনি থেকে কাকদ্বীপ, নদীয়া থেকে তুফানগঞ্জ– হাজারো মেয়ের ইজ্জত লুট হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন প্রতিরাতে।
২০১২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পার্ক স্ট্রিটের আলো ঝলমলে রাতকে যে ভয়ঙ্কর অন্ধকার ডেকে দিয়েছিল, তারপর থেকে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ– প্রতিটি কন্যা সন্তানের বাপ-মা আর শান্তিতে ঘুমোতে পারেন না। সুজান সুজেট থেকে অভয়া – কেউ বিচার পায়নি, দুই শাসকের যোগসাজশে।
২০২৪ এরই ৯ আগস্ট অভয়ার ধর্ষণ-হত্যার পরেই ভেঙেছিল মানুষের সহ্যের সীমা, জ্বলে উঠেছিল এই বাংলা। মায়েরা-মেয়েরা দখল নিয়েছিল রাস্তার। দিদি-মোদী’র কারসাজিতে বিচারের বাণী নীরবেই কেঁদেছে। দুর্বৃত্তরা ভাবছে এভাবেই তারা বারবার বেঁচে যাবে দিদির আঁচলের তলায় থেকে! নারী নির্যাতন, পাচার আর সুরক্ষার অভাব আজ বাংলার মেয়েদের জীবনকে এক রুদ্ধ কারাগারে পরিণত করেছে। আমরা আসছি আপনার পাশে দাঁড়াতে — যাতে এই সমাজে মেয়েরা নির্ভয়ে নিশ্বাস নিতে পারে, নির্ভয়ার ভূমি আবার নিরাপদ হয়।
নতুন করে সুদখোর-মহাজনদের রাজ ফিরে এসেছে ‘মাইক্রোফিন্যান্স’-এর নাম করে এই বাংলায় শাসকেরই মদতে। আপনিও কী ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছেন? সুদ গুনতে নিঃস্ব আপনি? এদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই নতুন বাংলা গড়তে হবে, তাই আপনার কাছে আমরা আসছি হাজার কিলোমিটার পথ উজিয়ে।
আপনি ডোমকলের বিড়ি শ্রমিক? ঝালদা, রানিবাঁধ, বসিরহাট বা বর্ধমানের ভ্যান চালক? বীরভুম বা বালুরঘাটের পরিবহণ বা নির্মাণ শ্রমিক? যেদিন সময়ের সাথে সাথে শরীরের পেশিগুলো শিথিল হয়ে যাবে, সেদিনের কথা ভেবে আপনি আতঙ্কিত – তাই তো? সমগ্র যৌবনের শ্রম নিংড়ে আপনি কাজ করেছেন, বয়সকালে সামাজিক সুরক্ষা পেনশন তো আপনার হকের পাওনা। হ্যাঁ আমরা আসছি আপনার হকের কথা নিয়ে। আমাদের স্বপ্নের নতুন বাংলায় আপনি সহ সব শ্রমিকের আত্মমর্যাদা নিয়েই ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিকে আপনি-আমি-সবাই মিলেই বাস্তবায়িত করব।
ভূতনীর চরের গঙ্গায় যার সব তলিয়ে গেছে, গোসাবা-হিঙ্গলগঞ্জের নদীবাঁধ ভেঙে সব হারানোদের চোখের জল কী সত্যিই মুছিয়ে দেওয়া যায় না? ফি বছর দামোদরের জলে বানভাসিদের যন্ত্রণার কী শেষ নেই? আবাস যোজনায় নতুন করে এদের, আর বাকি সব কাঁচাবাড়ির পাকা ছাদ তো অন্তত করা যেত! কেন হলো না? গরিবের ঘরের ছাদ কেড়ে নিয়ে এই নির্লজ্জ লুটপাট মেনে নেবেন আপনি? আমরা আসছি এই দুর্নীতি বন্ধের শপথ নিয়ে, যাতে আপনার মাথার ওপর ছাদ পাওয়ার অধিকারকে ঘুষের বিনিময়ে আর কিনতে না হয়। সেই বাংলা গড়াই আমাদের লক্ষ্য।
উত্তরবঙ্গের বঞ্চনা আরও গভীর ও প্রকট। সংকোশ নদীর জল ছুঁয়ে, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সাক্ষী রেখে আপনার কাছেই আমরা যাবো। আপনি— মানে চা শ্রমিকের মহল্লায়। সোনালি চায়ের গরম ধোঁয়ার আড়ালে চাপা পড়ে আছে বাগানের বস্তির অসহনীয় জীবন। সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা আর মালিকদের সাজিশে সঠিক মজুরি-বোনাস না পাওয়ার হতাশা পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে আছে। ধোঁকা নয়, আপনার কাছে আমরা আসছি কথা বলতে। কথায় কথায় নিশ্চয়ই উঠে আসবে সমস্যা সমাধানের পথ।
পাহাড়, নদী আর অরণ্যের এই নন্দনকানন আজ বনদস্যুদের জিম্মায়। শুধু উত্তরেরই নয়, দক্ষিণের সুন্দরবনও এদের বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। পাহাড় আর সুন্দরবন যদি না বাঁচে তাহলে এ রাজ্যটাই বাঁচবে না— আমি-আপনি কেউই নয়।
আপনার পাড়ায়, গ্রামে ১৫ বছর আগেও অল্প বর্ষায় জল জমেনি, আজ কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে জমা জল হপ্তাভর সরেও না, নড়েও না! কেন? পাড়ার পুকুর, রাস্তার নয়নজুলি খাল - প্রোমোটার-জমির দালাল-শাসকদের যোগসাজশে অবলুপ্তির পথে। এজন্যই কাঠফাটা গরম বাড়ছে আর মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে পাহাড়-সমতল ভেসে যাচ্ছে। রক্ষা করতেই হবে আপনার পাড়া-মহল্লা-বস্তি-গ্রাম। এই ধ্বংসলীলা বন্ধের হুঁশিয়ারি দিতে, প্রকৃতি আর মানুষের জীবন রক্ষায় আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই।
আপনার গ্রামে, আপনার পাড়ায় শাসকের মদতে নেশাচ্ছন্ন যুবকদের সংখ্যা বাড়ছে? শাসকের সিন্ডিকেটের অত্যাচারে আপনি অতিষ্ঠ? বালি-পাথর-কয়লা মাফিয়ার ভয়ে তটস্থ আপনি? মাফিয়া রাজের এই আতঙ্কের বিরুদ্ধে কে বলবে, কে লড়বে? আসুন ঐক্যবদ্ধ হই আপনি-আমি-সবাই। এই মাফিয়া-সিন্ডিকেট রাজ খতম করতেই হবে, নতুন বাংলা গড়তে।
কাজ না পেয়ে আপনার সন্তান হতাশ? অথবা হঠাৎ ধনী হবার আশায় শাসক দলের মদতপুষ্ট ডিয়ার লটারি বা জুয়ার খপ্পরে আরও সর্বস্বান্ত হচ্ছে? বাঁচার রাস্তা খুঁজে না পেয়ে নেশায় আচ্ছন্ন? সন্তানের মতিগতিতে আপনি দিশাহারা বাপ-মা? নেশা বা জুয়া বাঁচার রাস্তা নয়— এই বার্তা নিয়েই সব যুবকের কাছে আমরা যাচ্ছি বাঁচার নতুন গান নিয়ে। নতুন বাংলায় নতুন করে বাঁচার গান– যেখানে আবার ফিরে আসবে কল-কারখানা। কারখানার চিমনি আর আইটি’র বহুতল, আকাশে আঁকবে নতুন স্কাইলাইন।
শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে কে লড়বে? ১২/১৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করে দিনের শেষে ৪০০/৫০০ টাকা নিয়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত-অবসন্ন চেহারায় বাড়ি ফিরে ঘুমোতে পারো না তুমি নিশ্চিন্তে, কারণ তুমি জানো না, পরের দিন আর কাজ পাবে কি না! তোমার পোশাকি নাম ‘গিগ শ্রমিক’। চলবে এমনই? আমরা আসছি তোমার কাছেও, আলাপ-আলোচনায় নিশ্চয়ই বের হবে লড়াইয়ের পথ।
এই রাজ্যে এই দেশে দুর্নীতি-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অধিকারের দাবি আজ নিষিদ্ধ। এমনকি ভোটের অধিকারও কেড়ে নিচ্ছে শাসক দুই দল। স্কুল-কলেজ থেকে সমবায়, পঞ্চায়েত পৌরসভা থেকে সব ভোটই লুট হয় এ রাজ্যে। আপনার অধিকার ফিরিয়ে দিতে, গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে আমরা আসছি। আপনার-আমার-সবার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধই পারে এই অধিকার ফিরিয়ে আনতে।
আসানসোল থেকে বসিরহাট, কালিয়াচক থেকে ক্যানিং— বারবার দাঙ্গার আগুনে পুড়েছে গত ১৪ বছরে। কার ক্ষতি হয়েছে— হিন্দুর না মুসলমানের? ক্ষতি হয়েছে সাধারণ গরিব মানুষের, দাঙ্গার আগুনে জ্বলেছে এদেরই ঘর-দোকান। আপনি-আমি জাত-ধর্মের নামে ঝগড়া করছি, মারপিট করছি— আর সেই সুযোগে লুট হয়ে যাচ্ছে দেশের খনি, ব্যাঙ্কে রাখা আমাদেরই টাকা, বাড়ছে জিনিসের দাম, পেটমোটা হচ্ছে আদানি-আম্বানি আর পিসি-ভাইপোর দলের। এদের বাড়ি-দোকান কিন্তু পোড়ে না দাঙ্গার আগুনে।
দিনের শেষে আমরা সবাই একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই। শীতের দিনে, ঠান্ডার রাতে সম্প্রীতির বন্ধনে সবাই আবদ্ধ হয়ে হৃদয়ের উষ্ণতাকে ভাগ করে নিতে চাই। জাতের নামে বজ্জাতি সব, জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া— এই জালিয়াতদের হুঁশিয়ারি দিতেই উত্তর থেকে দক্ষিণ – বাংলা জুড়ে আমাদের এই যাত্রা। আপনিও আসুন, যাতে একই সাথে সন্ধ্যার শাঁখের ধ্বনি আর আজানের আওয়াজে বেঁচে থাকে এই বাংলার সম্প্রীতির ঐতিহ্য।
আমরা কি দাঙ্গাবাজ আর লুটেরাদের হাতে বাংলাকে এইভাবে তিলতিল করে মরতে দেব, নাকি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই বাংলাকে আবার বাঁচার পথ দেখাবো? আমরা হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিচ্ছি একটাই আবেদন নিয়ে— আর নীরবতা নয়।
আসুন সবাই একসাথে সোচ্চারে আওয়াজ তুলি— বাংলা বাঁচাও, জীবন বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও!
কোচবিহারের প্রান্তর থেকে শুরু করে উত্তর ২৪ পরগনার কোলাহলপূর্ণ রাজপথ, সিপিআই(এম)’র হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে 'বাংলা বাঁচাও যাত্রা' - আমার এবং আপনার, সবার মনে জমে থাকা ক্ষোভ, যন্ত্রণা আর ন্যায্য অধিকারের দাবিকে একসূত্রে বেঁধে ফেলার লড়াইয়ের প্রথম ভাগ।
Comments :0