Post Editorial on communal politics

ইকবাল গাওয়া যাবে না, রবীন্দ্রনাথও না?

সম্পাদকীয় বিভাগ

দীপঙ্কর সিংহ
কলকাতায় এখন মঞ্চে মঞ্চে গান মেলা চলছে। গত কয়েকদিন ধরে এই দেশেরই আর এক প্রান্তে পাঠ্যসূচির অন্তর্গত একটি পুরানো প্রার্থনা সঙ্গীত ক্লাসে ছাত্রদের নিয়ে সমবেতভাবে গাওয়ার জন্য শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছেন গত শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২। অধ্যক্ষ ছুটিতে ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে কট্টর হিন্দুবাদী সংগঠনের অভিযোগ তামিল করে। আজ গান আখ্যায়িত হচ্ছে ধর্মের ভিত্তিতে। আর যদি সেটা সংখ্যালঘুর ধর্মের কোনও শব্দের উল্লেখ থাকে তো ফ্যাসিবাদী বাহিনী ঝাঁ‍‌পিয়ে পড়ছে ‘দেশদ্রোহী’ গান বলে। সংখ্যাগুরুর ধর্মে নাকি ঐ শব্দের জন্য আঘাত লাগছে, সে এতই ঠুনকো। পুলিশ অভিযোগ দায়ের করতে গি‍‌য়ে বলছে এই গান গেয়ে নাকি দাঙ্গা বাধানোর উদ্দেশ্য ছিল। ভাবতে হবে যে পাঠ্যসূচির একটি কবিতা গান গাইলে দাঙ্গা বেধে যেতে পারে বলে মনে করছে একটি রাজ্যের প্রশাসন। গান মানুষকে উদ্দীপ্ত করে, সচেতন করে, আনন্দ দেয় জানতাম। কিন্তু ফ্যাসিস্তদের পাল্লায় পড়ে সে দাঙ্গার অনুঘটক হয়ে যায়। চার্চের সঙ্গীত আয়োজক মার্টিন নিমোলার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন হিটলারের নাৎসিপন্থার বিরোধিতা করার জন্য। নিমোলার একসময়ে হিটলারের সমর্থক ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি সেই বিখ্যাত ফ্যাসিবাদ বিরোধী কবিতা, ‘একদিন ওঁরা যখন এসেছিল’ লিখেছিলেন। প্রখ্যাত সঙ্গীতকার হ্যান্স এইস্লাবকে জার্মানি ছেড়ে গোপনে দেশ ছাড়তে হয়েছিল হিটলারের রোষ থেকে মুক্তি পেতে। ফ্যাসিস্তরা সঙ্গীতেও বিভেদ সৃষ্টির কোনও সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। নখ, দাঁত নিয়ে আক্রমণ করে।
লোককবি জালালউদ্দিনের লোকগান অবলম্বনে গিরীন চক্রবর্তী লিখেছিলেন ‘‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই।’’ এই গানে তো চাষি ‘আল্লা’র কাছে প্রার্থনা করছে। এই গান তো কতই গেয়েছি আমরা। আজও কতজন গাইছেন। এ কি শুধুই মুসলমান ধর্মাবলম্বী চাষির গান? এ গান তো ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত চাষির অন্তরের গান। প্রকৃতির উপর নির্ভরতায় চাষির অসহায়তার আখ্যান। মানুষের জীবনের নানা অনুভূতির প্রকাশে ‘আল্লা’, ‘ঈশ্বর’, ‘ভগবান’, ‘বিধি’, ‘বিধাতা’— এই শব্দগু‍‌লি কবিতায় ধর্মের পরিচায়ক নয়, বরং কাব্যিক প্রার্থনার অনুষঙ্গে শব্দগুলি প্রয়োগ হয়ে এসেছে। শুধু এইসব শব্দকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গানের ধর্ম বিচার হবে? এই শব্দগুলি থাকলেই দাঙ্গা বাধবে? আমরা গানের কথাগুলো কি শুনবো না? আর যদি কোনও ধর্মবিশ্বাসী মানুষ তাঁর ধর্মীয় কোনও শব্দ কখনো গানে বলেন, তবে তাঁর কণ্ঠরোধ করতে হবে? আমরা কি অজাতশত্রুর সময়ে ফিরে যাব? এই প্রশ্ন কোনও কাল্পনিক বিষয় বা সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা নয়। এটাই আজ‍‌কের বাস্তব অবস্থা। তিন বছর আগে আইআইটি কানপুরের ছাত্ররা জামিয়া মিলিয়া ইউনির্ভাসিটির ছাত্রদের উপর পুলিশি অত্যাচারের বিরোধিতা করতে কবি ফয়াজ‍‌ আহমেদ ফয়াজের নজম ‘হাম দেখেঙ্গে’ আবৃত্তি করছিল, ইকবাল বানোর সুরে গাইছিল। এই গানেই গজল ‍‌শিল্পী ইকবাল বানোর কালো শাড়ি পরে জিয়া-উল-হকের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ জানিয়ে‍ছি‍‌লেন লাহোরের প্রকাশ্য মঞ্চে হাজার হাজার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। স্বৈরাচারীরা দেশে দেশে হুবহু এক আচরণ করে এসেছে, সেটা আরও একবার প্রমাণিত হলো সেদিন। আইআইটি কানপুরের মতো প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফয়াজের এই গানে হিন্দু ধর্মের বিরোধিতা করার অভিযোগ বিচার করার জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। আমরা আজ পর্যন্ত জানি না সেই কমিটি তদন্তে কী পেয়েছিল। কিন্তু ফয়াজের কবিতা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের এমন উদ্যোগের প্রবল সমালোচনা হয় দেশ জুড়েই। হয়তো সেই সমালোচনার মুখেই সেই প্রতিষ্ঠানটি পিছু হটেছিল। ফয়াজের নজমের কোন অংশ নিয়ে আপত্তি ছিল? নজমের একটি অংশ আছে, ‘‘যব আরজ-এ-খুদা কে কাবে সে সব বুত উঠায়ে জায়েঙ্গে।’’ এর অর্থ হলো, ‘‘এই পৃথিবীর ঈশ্বরের আশ্রয় থেকে সব মূর্তি তুলে ফেলা হবে।’’ এই ছত্রটি নাকি হিন্দু ধর্মের বিরোধী! মূর্তি পূজার বিশ্বাসী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নাকি ভাবনায় আঘাত লেগেছে। কিন্তু এই ছত্রের মধ্যে কবি মেকি মূর্তি-পূজার আড়ালে মানুষের উপর অত্যাচারের কথা বলেছেন। এমন কথা তো রবীন্দ্রনাথও বলেছেন।


‘‘হে ধর্মরাজ, ধর্মবিকার নাশি
ধর্মমূঢ়জনের বাঁচাও আসি।।
যে পূজার বেদী রক্তে গিয়েছে ভেসে।
ভাঙো ভাঙো, আজি ভাঙো তারে নিঃ‍‌‍‌শেষে,
ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো
এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো’’— ধর্মমোহ
রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকেই আরও একটা উদাহরণ দিই। রবীন্দ্রনাথ ‘পূজারিণী’ লিখেছিলেন প্রাচীন ভারতের ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে। বৌদ্ধ পূজারি, ‘শ্রীমতি’-কে রাজা অজাতশত্রুর ধর্ম বিদ্বেষপূর্ণ নির্দেশ অগ্রাহ্য করে বুদ্ধের আরাধনা করার জন্য হত্যা করা হয়। বিম্বিসার পুত্র অজাতশত্রুর অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা নিয়ে লিখেছিলেন,—
‘‘অজাতশত্রু রাজা হল যবে, পিতার আসনে আসি
পিতার ধর্ম শোণিতের স্রোতে মুছিয়া ফেলিল রাজপুরী হতে—
সঁপিল যজ্ঞ-অনল-আ‍‌লোতে বৌদ্ধশাস্ত্ররাশি।
কহিল ডাকিয়া অজাতশ্রুত রাজপুরনারী সবে,
‘‘বেদ ব্রাহ্মণ রাজা ছাড়া আর কিছু নাই ভবে পূজা করিবার
এই ক’টি কথা জে‍‌‍নো মনে সার— ভুলিলে বিপদ হবে।....


হিন্দু রাজার সেই হিংস্রতার কাহিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা পড়েছি, পাঠ করেছি। একি রবীন্দ্রনাথের হিন্দু বিদ্বেষ? কবি তো সহিষ্ণুতার বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। অন্ধ, উগ্র ধর্ম বিদ্বেষের ‍বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি এক সহিষ্ণু ভারতবর্ষের কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘সবারে-পরশে-পবিত্র করা তীর্থনীরে/আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’’ রবীন্দ্রনাথ কোনও ধর্মের বিরোধিতা করেননি। ধর্মের নামে মানুষের উপর অত্যাচারের বিরোধিতা করেছেন। ফয়াজ‍‌ আহমেদ ফয়াজও তো মানবতার পূজারি ছিলেন। ফ্যাসিবাদীরা হিংস্র সাম্প্রদায়িকতায় এই মানবিক আবেদনের মধ্যেই ধর্ম বিদ্বেষের জিগির তুলছেন। তাই আজ রবীন্দ্রভাবনাকে শুধু বিশ্বভারতী নয়, সারাদেশ থেকে মুছে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। যেভাবে ঘটনা প্রবাহ চলেছে, তাতে মনে হয়, সে দিনের মনে হয় আর বেশি দেরি নেই, যেদিন তাঁর দৃষ্টি আরও তীব্রভাবে আক্রান্ত হবে। রবীন্দ্রনাথের অনুকরণে চুল দাঁড়ি রেখে রবীন্দ্র উদ্ধৃতি দিলেই তো রবীন্দ্র ভাবনা রূপায়ণ করবেন, ফ্যাসিবাদী সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি ছেড়ে সহনশীল হয়ে উঠবেন, এটা কিছু মানুষ আশা করতে পারেন, সবাই নয়। এই সময়ই তো গোটা দেশে আমরা দেখছি একদল উগ্র সাম্প্রদায়িক মানুষ বিভেদের বিষে জারিত করে সমাজকে আতঙ্কিত করছেন। উদার, প্রগতিশীল মানুষকে খুন করতেও পিছপা হচ্ছে না। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুকে উত্তেজিত করছেন। রবীন্দ্রনাথ এই ভারতের কথা বলেননি। আমরা এই ভারতকে চাইতে পারি না। আমাদের চাওয়া, না চাওয়া যাই থাক, আমাদের চিন্তার জগৎ, শিক্ষার জগৎ, সংস্কৃতির জগৎ, সাহিত্যের জগৎ আজ সরাসরি আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার ভিত্তিটাকেও বদলে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই আক্রমণ শুধু ধর্মের ধ্বজাধারী গোষ্ঠী নিজেরাই করছে না, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকেও এই পথেই চালিত করছে।


সংস্কৃতির উপর আক্রমণের প্রতিবাদ করে নিহত হয়ে‌ছে গৌরী লঙ্কেশ, গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর, মাল্লেশাপ্পা কালবুর্গি। আক্রান্ত হয়েছেন বহু কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন এমনই কিছু বাহানায় স্কুলে, কলেজে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সভায় কত মানুষ। ফয়াজের এই কবিতাকে এঁরা আসলে ভয়ে পেয়েছেন শুধুই ঐ পঙ্‌ক্তির জন্য নয়। ঐ নজমেই তিনি বলেছেন, ‘‘সব তাজ উছালে জায়েঙ্গে, সব তখৎ গিরায়ে জায়েঙ্গে।’’ এই বলিষ্ঠ উক্তি শাসক ফ্যাসিস্তদের কাঁপন ধরায়। ওঁরা ভয় পায় মসনদ হারানোর। তাই ফয়াজের কবিতা, গান, ওঁরা মুছে দিতে চায়। কিন্তু সেখানেই তো এরা থামেনি। ‌ফয়াজের পর এবার আক্রান্ত হচ্ছেন কবি মহম্মদ ইকবাল। আমরা ছোট থেকে ইকবালের গান শুনে বড় হয়েছি। আমাদের দেশের সিপাহিরা মার্চ করেছে তাঁর গানে, সুরে, — ‘মজহব নহীঁ শিখাতা আপস মেঁ বৈর রখনা, হিন্দি হ্যায়ঁ হম, বতন হ্যায়ঁ হিন্দুস্তান হামারা/সারে জাঁহাসে আচ্ছা, হিন্দুস্তান হামারা, হম বুলবুলে হ্যায়ঁ ইসকি, ইয়ে গুলিস্থান হমারা।’’ এতো সমগ্র ভারতবাসীর প্রাণের কথা। তিনিই যখন লেখেন, ‘‘এয় অব-রুদ-এ-গঙ্গা, ও দিন হ্যায়ঁ ইয়াদে তুঝকো/উৎবা তেরে কিনারে যব কারোয়াঁ হামারা।’’ ও গঙ্গার ধারা, তোমার কি মনে আছে, যেদিন পথ বেয়ে তোমার তীরে এসে পৌঁছেছিলাম। এ তো এক ভারত পথিকের অন্তরের কথা। তাঁর গানেই তো শুনেছি, ‘‘উঠঠো, মেরি দুনিয়াকে গরিবোঁ কো জাগা দো, খাকে উমরাহ, কে দ্বার দিওয়ার হিলা দে।’’ ওঠো, আমার পৃথিবীর দরিদ্রকে জাগাও, ধনের প্রাসাদের দরজা, দেওয়াল ভেঙে দাও। দরিদ্রের লুট করা ধনে যারা প্রাসাদ গড়ে, তাঁদের এই গান তো কম্পন ধরাবেই। এই জন্যই ফ্যাসিবাদী শাসকের বশংবদেরা আজ বলছে ইকবালের গান গাওয়া যা‍‌বে না। ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর তারিখে উত্তর প্রদেশের পিলভিট জেলার একটি সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত হয়েছিলেন ইকবালের লেখা ছোটদের প্রার্থনা সঙ্গীত, ‘‘লব পে আতি হ্যায় বন‍‌ কে তমান্না মেরি’’ ছাত্র-ছাত্রীরা সমবেতভাবে গাওয়ার জন্য। একটি সাম্প্রদায়িক দল প্রধান শিক্ষক ফুরকান আলিকে বরখাস্ত করার দাবি তুললে কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তারপরেই ঐ স্কুলের ছাত্ররাই শিক্ষকের উপর এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে প‍‌ড়ে। তারা জানিয়ে দেয়, তাঁদের শিক্ষককে ফিরিয়ে না আনলে তারা ক্লাসে যোগ দেবে না। এর পরেই কর্তৃপক্ষ পিছু হটতে থাকে। কিন্তু সেখানেই ইতি হয়নি। খবরে প্রকাশ গত শনিবার ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ আবার সেই উত্তর প্রদেশেই বেরেলি জেলার আরও এক সরকারি স্কুলের শিক্ষককে পুলিশ ক্লাস থেকেই গ্রেপ্তার নিয়ে যায়। তাঁর বিরুদ্ধে নাকি ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ২৯৮ ধারা (ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় আবেগে আঘাত করা) ও ১৫৩ ধারায় (দাঙ্গা বাধানোর উদ্দেশ্যে উসকানি দেওয়া) অভিযোগ দায়ের হয়েছে। স্কুলের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধেও অভিযোগ লিপিবদ্ধ হয়েছে। মহম্মদ ওয়াজিরুদ্দিন ঐ ক্লাসের উর্দু ‍শিক্ষক। এই শিক্ষকের দোষ যে ছাত্রদের নিয়ে সমবেতভাবে ইকবালের সেই প্রার্থনা সঙ্গীত, ‘‘লব পে আতি হ্যায়ঁ বন কে তমান্না মেরি’’ করেছিলেন। অথচ এই কবিতাটি ছাত্রদের পাঠক্রমেই অন্তর্গত। এই সঙ্গীতের একটি ছত্র ‘‘মেরে আল্লাহ্‌, বুরাই সে বচানা মুঝকো।’’ এই জন্য এটা নাকি একটি ধর্মীয় গান। এই কারণে এই গান গাওয়া  যাবে না? এটা ভারত বিরোধী গান? তবে কি ঐ, ‘‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে’’ গানটিও ‍‌কি ভারত বিদ্বেষী ধর্মীয় গান ও এই গান করলে দাঙ্গা হতে পারে? এ কোন ভারতবর্ষে বাস করছি আমরা? ইকবালের এই নজমটি লেখা হয়েছিল ১৯০২ সালে, যখন ভারত ভাগ হয়নি। তিনি গানের ছত্রে ছত্রে দেশের অর্থাৎ ভারতের মানুষের মঙ্গলের কথা বলেছিলেন। গানটির কথাগুলি আমরা যদি দেখি ও তাঁর অর্থ বোঝার চেষ্টা করি, তবে এটা বলতে কোনও দ্বিধাই থাকবে না যে এই গান দেশের শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষের গান। এই গান মনে করিয়ে দেয় রজনীকান্ত সেনের ‘‘তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।’’ কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘‘অন্তরমম বিকশিত করো অন্তরতর হে।’’ ইকবালের কবিতাটি ও তার সম্ভাব্য অনুবাদ দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। কিছুদিন আগে দক্ষিণ ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী-সঙ্গীতকার হরিহরণ এই গানটি গজলের আকারে রেকর্ড করেছেন। আবার জগজিৎ সিং-এর সুরে সিজা রায় ও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সমবেত কণ্ঠে গানটি খুব জনপ্রিয় হয়েছে। এঁদের তো গানের ঐ ছত্রে আল্লা উচ্চারণ করতে অসুবিধা হয়নি। ঐ শিক্ষক য‍‌দি এই গান গেয়ে দাঙ্গায় উসকানি দিয়ে থাকেন তবে কি এঁরাও সবাই দাঙ্গাবাজ? এঁরাও ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত দিতে চান? ফয়াজ‍‌, ইকবালদের গানকে হিন্দু ধর্ম বিদ্বেষী ‘মুসলমানের গান’ আখ্যা দেওয়া আমরা মেনে নেব? ফ্যাসিবাদীদের সংস্কৃতির উপর এই আক্রমণের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হোক দিকে দিকে। আজ যদি আমরা চুপ করে থাকি, কাল এই ভয়ঙ্কর শক্তি আমাদের গিলে খাবে।
ইকবালের মূল নজম থে‍‌কে আমার করা অনুবাদ—
আমার ওষ্ঠে ফুটুক আমার অন্তরের প্রার্থনা বাণী
জীবন আমার আলোকিত হয়ে উঠুক, হে ঈশ্বর
দূরের পৃথিবী আমার জীবনে আঁধারেই থাক,
আ‍‌লোর ছটা উজ্জ্বল হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।
অন্তরের এই আলোয় শোভিত হোক আমার জন্মভূমি,
ঠিক যেমন ফুলে ফুলে বাগান সুন্দর হয়ে ওঠে।

জীবন আমার জোনাকির মতো হোক, হে ঈশ্বর
জ্ঞানের আলোর সাথে হোক আমার প্রেম, হে ঈশ্বর
দরিদ্রের রক্ষা করা হোক আমার লক্ষ্য।
সমব্যথী হয়ে দুর্বলদের যেন ভালোবাসতে পারি।
অন্যায় কাজ থেকে আমাকে দূরে রেখো, আল্লা,
শুভ কর্ম পথে আমাকে নিয়ে চলো।

Comments :0

Login to leave a comment