রবিবারের ফাইনাল হতে চলেছে এই শতাব্দীর অন্যতম সেরা ফুটবল ম্যাচ। অন্তত বিশেষজ্ঞদের তেমনই আশা। এই শতাব্দীর সেরা ফুটবলারদের অন্তত দু’জন— শেষ প্রহরের মেসি এবং তরুণ প্রজন্মের এমবাপে— এই ম্যাচে খেলবেন। এখনও পর্যন্ত দু’দলেরই খেলার ধারা দেখে আন্দাজ করা হচ্ছে, এই ম্যাচ হবে মূলত আক্রমণাত্মক।
একথা বলা ঠিক নয় যে মেসি-এমবাপের দ্বৈরথ হবে। দু’দলেই ম্যাচের রং বদলে দিতে সক্ষম আরও খেলোয়াড় রয়েছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত দু’দলই এই দুই অস্ত্রকে সামনে রেখেই খেলার পরিকল্পনা করেছে। মেসি মাঝখানে খেলছেন বলে আর্জেন্টিনার আক্রমণের ৪১ শতাংশই হয়েছে সেন্ট্রাল এবং ইনসাইড দিয়ে। অন্যদিকে, ফ্রান্সের আক্রমণের ৬৯ শতাংশ হয়েছে উইং ধরে, বিশেষ করে বাঁ দিক দিয়ে। যেখানে এমবাপে আছেন। আক্রমণে বাড়তি মাত্রা যুক্ত হয়েছে এক সিনিয়র ও এক নেহাতই তরুণের জন্য। ফ্রান্সের অলিভিয়ার জিরুকে লক্ষ্য করে বক্সে চলছে একের পর এক সেন্টার।
ফ্রান্স এখনও পর্যন্ত বিপক্ষের বক্সে ৪৬ বার সফল ভাবে ক্রস রেখেছে, সব দলের মধ্যে সর্বোচ্চ। জিরু সাতবার হেডে গোলের চেষ্টা করেছেন। সফলও হয়েছেন দু’বার। আর্জেন্টিনার আলভারেজ এখনও পর্যন্ত সব দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৌড়েছেন— ৩০.৬ কিলোমিটার। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ৬৬টি স্প্রিন্ট দেখা গেছে তাঁর কাছ থেকে, মেসির দ্বিগুণ। ২২ বছরের আলভারেজ পিছন থেকে বল নিয়েছেন ৫৯ শতাংশ, মেসি নিয়েছেন ১৮ শতাংশ। মেসির জুড়ি হিসাবে আর্জেন্টিনাকে অনেক বেশি গতিময় করে তুলেছেন আলভারেজ।
পরিসংখ্যান ম্যাচের প্রতিফলন না-ও হতে পারে। কিন্তু মনে করা যেতে পারে গত বিশ্বকাপেও ফ্রান্স-আর্জেন্টিনা ম্যাচ হয়েছিল প্রতিযোগিতার অন্যতম দর্শনীয় খেলা। এক গোলে পিছিয়ে পড়ে আর্জেন্টিনা ২-১-এ এগিয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ৪-৩ গোলে হেরে যায়। ওই ম্যাচে বলের ৬০ শতাংশ দখল ছিল আর্জেন্টিনার। গোলে বেশি শট ছিল তাদেরই। কিন্তু খেলার ফলাফল হয়েছিল বিপরীত। এবারের বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত আর্জেন্টিনা ৯০ মিনিটে গড়ে ৪৯১ টি পাস খেলেছে। ফ্রান্স খেলেছে ৪৩০। বিপক্ষের গোল লক্ষ্য করে শট যথাক্রমে ৮৩ ও ৯১। বিপরীতে আর্জেন্টিনার গোল লক্ষ্য করে শট হয়েছে ৩৩, ফ্রান্সের ৫৭। গত বিশ্বকাপের ম্যাচের পাঁচজন এবারও খেলছেন ফ্রান্সের প্রথম একাদশে। লরিস, ভারানে, গ্রিজম্যান, এমবাপে, জিরু। আর্জেন্টিনায় রয়েছেন শুধু মেসি, ওটামেন্ডি।
ভাবা হয়েছিল, মেসি তাঁর পুরানো উজ্জ্বলতা নিয়ে এবারের বিশ্বকাপে আসবেন না। বাস্তবে হয়েছে অন্যরকম। মেসি তাঁর সেরা বিশ্বকাপই খেলছেন। সৌদি আরবের কাছে প্রথম ম্যাচে পরাজয়ের পরে কটাক্ষের স্রোত ভেসে এসেছিল। মেসি বলেছিলেন, আমাদের ওপরে ভরসা রাখুন। মেক্সিকো ম্যাচের ৬৪ মিনিটে ওচোয়ার পাশ দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেবার পর থেকেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। আর্জেন্টিনা আর ফিরে তাকায়নি, মেসিও না। বরং আরও ধারালো, আরও বৈচিত্র্যময়, আরও উদ্দীপ্ত লাগছে তাঁকে। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে দলের তৃতীয় গোলের জন্য তাঁর পাসের আগের ১৬ সেকেন্ড দেখে ফুটবল বিশ্ব মোহিত। এমনকি যে ডিফেন্ডারকে তিনি ধোঁকা দিয়েছেন সেই জসকো গাভারদিয়ল পর্যন্ত বলেছেন, ‘ওই ঘটনা ঘটায় একদিন আমি আমার সন্তানদের বলতে পারব যে এই বিরাট বিরাট খেলোয়াড়কে পাহারা দেবার চেষ্টা করেছিলাম’।
আর্জেন্টিনার কোচ স্কালোনি বলেছেন, মেসির মধ্যে এমন কিছু আছে যে লোকে ওকে ভালোবাসে, শুধু আর্জেন্টিনার মানুষ নন। যখনই ও খেলে সতীর্থরা কিছু বিশেষত্ব দেখতে পায়। ও যে আমাদের জার্সি পরে মাঠে নামে, এটা আমাদের সুবিধা, সম্মান। স্কালোনি বলছেন, বিশ্বকাপ পাক বা না পাক, ওই সর্বকালের সেরা। আর্জেন্টিনীয় বলে পক্ষপাতদুষ্ট মনে হতে পারে কিন্তু কথাটা সত্য। মেসি তাঁর ২৬ তম বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলবেন ফাইনালে। আবার একটি নতুন নজির।
অন্যদিকে ২৪ পূর্ণ হবার আগেই এমবাপে খেলবেন ১৪ তম ম্যাচ। ওই বয়সের মেসির তুলনায় ৬টি বেশি। ইতিমধ্যেই তাঁর দেরাজে বিশ্বকাপ রয়েছে। এবারেও সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় মেসির সঙ্গেই টক্কর দিচ্ছেন। তাঁর গতি অ্যাথলিটদের মতো, বল নিয়ন্ত্রণ, ড্রিবলিং মেসি-নেইমারকেই মনে করায়। এ পর্যন্ত কোনও রক্ষণই তাঁকে রুখে দিতে পারেনি। ইংল্যান্ড ম্যাচে তাঁকে পিছিয়ে খেলিয়েছিলেন দেশঁ। তার সুফল তুলেছে গোটা দল।
তবে, পর্যবেক্ষকদের মতে, ফ্রান্স দলের মুখ্য পরিচালক গ্রিজম্যান। তিনিই নিচ থেকে খেলা সাজাচ্ছেন, গোলমুখ খুলে দেবার কাজ করছেন, এমনকি নিজের রক্ষণেও অহরহ তাঁকে দেখা যাচ্ছে। বিনা উচ্ছ্বাসে, গোটা মাঠ জুড়ে খেলে চলেছেন গ্রিজম্যান। তাঁরও যেন কিছু প্রমাণ করার আছে।
কাতারের স্টেডিয়াম অবশ্য নিশ্চিতভাবেই আর্জেন্টিনার দখলে থাকবে। ইতিমধ্যেই রাস্তাঘাট আর্জেন্টিনার পতাকা ও জার্সির রঙে ঢেকে গেছে। মাঠে শোনা যাচ্ছে সমবেত কণ্ঠে ‘মুচাচোস’। আর্জেন্টিনার জনপ্রিয় ব্যান্ড লা মোস্কার একটি গানের অনুকরণে তৈরি এই গানের মধ্যে আছে অমোঘ কয়েকটি লাইন: আমরা আবার আশায় বুক বেঁধেছি/ আমরা তৃতীয়টি চাই। আর্জেন্টিনা এযাবৎ দু’বার বিশ্বকাপ জিতেছে। এই গানের শুরুতেই রয়েছে: ‘আমার জন্ম দিয়েগো আর মেসির দেশ আর্জেন্টিনায়/ ফকল্যান্ড দ্বীপের সন্তান/ সেকথা ভুলব ভেবেছে?’ ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে ব্রিটেন আর্জেন্টিনার যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আছে ‘লা টোটা’-র কথাও, তিনি মারাদোনার মা, ফুটবলের মা। এমনকি মেসি নিজেও একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে এটিকে তাঁর পছন্দের গান বলে দু’কলি শুনিয়ে দেবার পরে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে তা। ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ শেষ হবার আগেই ডি মারিয়া সহ দলের খেলোয়াড়দের এই গান গাইতে দেখা গেছে।
Comments :0