দক্ষিণ কলকাতার বুকে ৫ বিঘা জমি জলের দরে বেসরকারি মালিকানায় তুলে দিল রাজ্য সরকার। ঘটনাস্থল দক্ষিণ কলকাতার ফুসফুস বলে পরিচিত রবীন্দ্র সরোবর লেক। জানা গিয়েছে, মাত্র ৮ হাজার টাকা মাসিক লিজের বিনিময়ে এই মাঠে সেলিব্রিটি ক্রিকেটের আসর বসাবে ক্যালকাটা এন্টারটেইনমেন্ট ক্লাব ফাউন্ডেশন।
এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত অভিনেতা যিশু সেনগুপ্ত। এর মধ্যেই বহু অংশের মধ্যে এই প্রকল্প ঘিরে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সাদার্ন অ্যাভেনিউ দিয়ে রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের দিকে যেতে গেলে রাস্তার বাঁদিকে, লেক কালীবাড়ির উল্টোদিকে রয়েছে বিশাল একটি মাঠ। সেই মাঠে নিয়মিত খেলার আসর বসত। ক্রিকেট হোক কিংবা ফুটবল। সম্প্রতি সেখানে কেএমডিএ’র তরফে একটি ব্যানার টাঙানো হয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে, এখন থেকে এই মাঠ সেলিব্রিটি ক্রিকেট লিগের জন্য ব্যবহার করা হবে।
এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন সাধারণ মানুষ। রবীন্দ্র সরোবরে প্রতিদিন মর্নিং ওয়াক করতে আসেন বহু মানুষ। প্রাথমিক ভাবে তাঁরাই প্রতিবাদ শুরু করেছেন।
প্রতিবাদীদের বক্তব্য, এই মাঠ সাধারণ মানুষের সম্পত্তি ছিল। দক্ষিণ কলকাতা থেকে খেলার মাঠ কার্যত হারিয়ে গিয়েছে। তাই স্কুল কলেজের পড়ুয়ারা এই মাঠে এসে খেলতেন। একইসঙ্গে মর্নিং ওয়াকে আসা মানুষও এই মাঠ ব্যবহার করতেন। সরকারি নির্দেশিকার মাধ্যমে সেই মাঠ সাধারণ মানুষের থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
রবিবার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল, মাঠের মাঝে মাটি খুঁড়ে রাখা রয়েছে। কার্যত মাঠের চরিত্র এবং চেহারা পালটে গিয়েছে। মাঠের পাশে বিশ্রাম নেওয়া এক শ্রমিক জানালেন, কেন মাঠ খোঁড়া হচ্ছে জানি না। শুনছি স্টেডিয়াম হবে।
২০০১ সালের ৩ ডিসেম্বর রবীন্দ্র সরোবর লেক এবং সংলগ্ন অঞ্চলকে জাতীয় লেক ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক। জাতীয় জলাশয় সংরক্ষণ প্ল্যানের আওতায় আনা হয় রবীন্দ্র সরোবরকে। প্রাথমিক ভাবে ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট লেকের রক্ষণাবেক্ষণ করলেও, ২০১৭ সাল থেকে কেএমডিএ-কে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, জাতীয় লেক হিসেবে চিহ্নিত কোনও জলাধারকে রক্ষা করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ মেনে চলতে হয়। জলাধার রক্ষার জন্য জলাধারের পার্শ্ববর্তী বাফার জোনে কোনওরকম নির্মাণ করা যায় না।
পরিবেশ প্রেমীদের অভিযোগ, মধ্যরাতে লেকের মধ্যে ডিজেল চালিত জেসিবি মেশিন নিয়ে এসে মাঠে খননকাজ চালানো হয়েছে। তীব্র আলো জ্বালিয়ে চলছে কাজ, যা সম্পূর্ণ ভাবে নিয়মবিরুদ্ধ।
ইতিমধ্যেই জাতীয় গ্রিন ট্রাইবুন্যালে এই ঘটনার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হয়েছে। কেএমডিএ’র চেয়ারপার্সন ও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের কাছে লিখিত অভিযোগও দায়ের হয়েছে। প্রতিবাদীরা জানিয়েছেন, আগামীদিনে মুখ্যমন্ত্রীকেও অভিযোগ জানানো হবে। তাতেও কাজ না হলে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হবেন তাঁরা।
সংশ্লিষ্ট মহলের বক্তব্য, নবান্নে যিশু সেনগুপ্ত সহ তিন চলচ্চিত্র তারকা গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে সেলিব্রিটি লিগের সাফল্য নিয়ে কথা চালাচালি হয়। তারপরেই সরোবরে কাজ শুরু হয়ে যায় সেলিব্রিটি লিগের ‘উপযুক্ত’ মাঠ তৈরির।
উদ্যোক্তাদের তরফে যিশু সেনগুপ্ত যদিও বলেছেন, ‘‘মাঠের চরিত্র বদলানো কিংবা কোনও রকম নির্মাণ করা হবে না। মাঠের মাটির অবস্থা খারাপ ছিল। তাই সেটা তুলে ফেলা হচ্ছে। এখানে ঘাস লাগানো হবে ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেট মাঠের আদলে। একটা গাছও যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে আমরা তার বদলে একাধিক বৃক্ষরোপন করব।’’
এর পালটা পরিবেশ প্রেমীদের বক্তব্য, মাঠ তৈরি হলে সেটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকবে। সরকারি সম্পত্তিকে ব্যক্তি মালিকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে খোলা মাঠে সেলিব্রিটি ক্রিকেট লিগ আয়োজন আদৌ হবে কিনা, রয়েছে সেই প্রশ্নও। তাঁদের আশঙ্কা, বিতর্ক ধাপাচাপা পড়ে গেলে এখানে স্টেডিয়ামের আদলে স্থায়ী নির্মাণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একইসঙ্গে এই অঞ্চলে সেলিব্রিটি লিগ চালু হলে বিপুল যানজটেরও আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা রবীন্দ্র সরোবরের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
যদিও ক্যালকাটা এন্টারটেইনমেন্ট ক্লাব ফাউন্ডেশনের তরফে বলা হয়েছে, সেলিব্রিটি ক্রিকেট লিগের পাশাপাশি এই মাঠে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের শিশুদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। মাঠ তৈরি শেষ হলে কোমর সমান উঁচু ঝোপ দিয়ে মাঠ ঘিরে দেওয়া হবে। সেখানেও ইট-পাথর ব্যবহার করা হবে না।
কিন্তু এমন প্রতিশ্রুতি ঘিরে আশ্বস্ত নন অনেকেই। পরিবেশের ক্ষতি করে ব্যবসার জন্য খোলা মাঠের এমন বেদখল মানতে নারাজ তারা।
Comments :0