Rampath

৪০০টাকায় ‘রামপথে’ ঝাড়ু রামবতীর

জাতীয়

স্বর্ণেন্দু দত্ত: অযোধ্যা
 

দিনভর সূর্যের দেখা মেলেনি, তীব্র ঠান্ডার সঙ্গে কনকনে হাওয়া যেন সুঁচের মতো বিঁধছে। তারমধ্যেই অযোধ্যার প্রধান সড়ক যা এখন ‘রামপথ’ নামে পরিচিতি, তাতে ঝাড়ু দিয়ে চলেছেন জ্ঞানবতী। বছর তিরিশ-পঁয়ত্রিশের মহিলা জানালেন ১২দিন ধরে কাজ করছেন। আগে অযোধ্যার রাস্তা সাফাই করার এমন কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। রামলালার ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’র অনুষ্ঠান ঘিরে এই নতুন ‘নিয়োগ’। রাস্তায় যাতে একটা পাতা, কাগজের টুকরোও পড়ে না থাকে। 
কটা বাজে? গলায় প্রবল ক্লান্তি নিয়ে প্রশ্ন করলেন জ্ঞানবতী। চারটে বাজে শুনে বলে উঠলেন, আরও দুই ঘণ্টা! ঝাড়ু নাড়া বন্ধ হলেই সুপারভাইজারের বাঁশি বেজে উঠছে অথবা চিৎকারে তটস্থ হয়ে উঠছেন জ্ঞানবতী এবং তাঁর মতো আরও অনেকে। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ। মাঝে এক ঘণ্টা খাবারের, সেটা দেন ঠিকাদার। ১২ ঘণ্টা কাজের মজুরি ৫০০ টাকা। শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে ঘর জ্ঞানবতীর। গ্রামের অন্যদের সঙ্গে শহরে আসতে ৫০ টাকা করে আসা-যাওয়ায় খরচ হয়ে যায় ১০০ টাকা। ১২ ঘণ্টা কাজ করে হাতে থাকে ৪০০ টাকা। বললেন, ‘‘গ্রামে কোনও কাজ নেই, যে কদিন এখানে কাজ মিলছে হাতে দুটো পয়সা তো আসছে।’’ জ্ঞানবতীরা শুনেছেন ২২ তারিখের পরে আর এই কাজ থাকবে না। বললেন, ‘‘এত ঠান্ডায় অবশ হয়ে আসছে হাত। ঝাড়ু আর টানা যায় না বিকেলে।’’ তারপর বললেন, ‘‘আমার তো তবুও অল্প বয়স, বুড়িরাও এই কাজ করছেন।’’ 
এমনই এক বুড়ি রামবতী এসেছেন বাহারাইচ থেকে। বিকেলে যখন আরও ঠান্ডা বাড়ছে, বিড়িতে একটা সুখটান দিয়ে বললেন, আমরা গোটা পরিবারের ১৫ জন এসেছি। সত্যিই তাই, নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও রয়েছে। যখন যেখানে কাজ জোটে এভাবেই গোটা পরিবার চলে যায় সেখানে। রামবতীর দেওরের ছেলে রাজু মৌর্য বললেন, এর আগে মোরাদাবাদে ইটভাটায় কাজ করে এসেছেন, সপরিবার। বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানোয় শিশু দু’টি স্কুলে যায় না। পড়াশোনার কোনও সুযোগ তাদের নেই। রাজু বললেন, ‘উপায়টা কী? গ্রামে-ঘরে থাকলে খাবোটা কী?’ 
অযোধ্যার সড়কে যদিও বিশাল বিশাল সরকারি বিজ্ঞাপনে ‘মোদীর গ্যারান্টি’ বলছে, ‘‘কেউ ভুখা থাকবে না। প্রতি মাসে ৮০ কোটি মানুষ বিনামূল্যে রেশন পাচ্ছেন।’’ জ্ঞানবতী বা রাজুর প্রতিদিনের জীবন যেমনই হোক, মোদীজী তো বিজ্ঞাপনে বলেছেন কেউ ভুখা থাকবে না। এমনই কাজের গ্যারান্টির বিজ্ঞাপনও আছে লক্ষ্ণৌ থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত রাস্তাজুড়ে। সেই ছবিতে যোগীও আছেন। লক্ষ্ণৌ থেকে ফৈজাবাদ হয়ে অযোধ্যার পথ মুড়েছে সরকারি-বেসরকারি-দলীয় বিজ্ঞাপনে। যেগুলি বিজেপি’র ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের, সেগুলির রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে। সেখানে সবগুলিতেই মোদীর ছবি হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের। আর সঙ্গে আছে পাল্লা দিয়ে ‘মোদী কি গ্যারান্টি’র সরকারি বিজ্ঞাপন। লক্ষ্ণৌ থেকে যত অযোধ্যার দিকে এগনো যায়, ততই বিজ্ঞাপনে রাম ব্রাত্য হয়ে মোদীই মুখ্য হয়ে উঠেছেন। সেটা অযোধ্যার মন্দির চত্বরের আশপাশে এসে ‘রাম আসছেন’ না ‘মোদী আসছেন’ বোঝার উপায় থাকছে না। 
রানোপালির কাছে পরাগ ডেয়ারির পুরো পরিসরটাই শুধু গাঁদা ফুলের মালার পাহাড়ে ভর্তি। গলায় পরিচিতি পত্র ঝুলিয়ে কাজ করছেন সুজিত কুমার। পশ্চিম উত্তর প্রদেশের বুলন্দশহরের বাসিন্দা। বললেন, টেন্টওয়ালাও বুলন্দশহরের। গোটা অযোধ্যাকে ফুলে সাজানোর দায় পড়েছে বিভিন্ন ঠিকাদারের। তেমনই একজন মহেন্দ্র সিং। তাঁর কাছেই ৬০০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন সুজিত। বললেন, ‘‘১৬ তারিখ থেকে এখানে কাজ করছি। ২১ জানুয়ারির মধ্যে সাজানোর কাজ সব শেষ করতে হবে। মন্দির উদ্বোধনের জন্য এই কটা দিন কাজ পেলাম। এমনি সময়ে তো কাজের কোনও ঠিক নেই। কখনও মিলল, কখনও গোটা মাস কাজ জুটল না।’’ হেসে বললেন, ‘‘অন্য জায়গাতেও মন্দিরের এইরকম কাজ হলে ভালোই হয়।’’ মন্দিরই এখন যুবদের কাজ খোঁজার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের নানা জায়গায় হাজার হাজার টাকা তো সরকার সরাসরি বা ঘুরপথে বিনিয়োগ করছে মন্দিরের নামে রাজনীতির জন্যেই। 
বাইরের লোকেদের কাজ জুটলেও বিপদে পড়েছেন অযোধ্যার বাসিন্দারা। অযোধ্যার ‘ট্রেডমার্ক’ বিক্রম টেম্পোকে আটকে দেওয়া হচ্ছে অযোধ্যায় ঢুকতে দেওয়ার আগেই। ই-রিকশাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিড়লা ধর্মশালা থেকে। তার বদলে চলছে লক্ষ্ণৌ থেকে আনা ব্যাটারি বাস। ব্যাটারি পরিচালিত গোলাপি রঙের উবের অটো, যার সবগুলিই মহিলারা চালান। ফলে স্থানীয়দের ভাত মারা গেছে। বাইরের ভিড় বাড়ছে, কিন্তু লাভের গুড় খাচ্ছে অন্যরা। এরথেকেও খারাপ অবস্থা হয়েছে খাবারের দোকানের। দুই পা পরে পরে দেশের নানা প্রান্তের বিভিন্ন মঠ, ধর্মীয় সংস্থার পক্ষ থেকে ভাণ্ডারা খোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে হাজারে হাজারে লোক খাচ্ছেন সেই লঙ্গরে। ফলে সিঙারা, কচুরি ভেজে বসে আছেন দোকানদার। হনুমানগড়ি মোড়ে এমনই এক বড় দোকানদার বললেন, ২২ তারিখটা মিটলে আমরা বাঁচি। বিক্রি বাটা সব লাটে উঠে গেছে। একই বক্তব্য ক্যানে করে ঘুরে ঘুরে চা বিক্রেতা সঞ্জয় কুশওয়াহার। বললেন, অন্যদিন আধ ঘণ্টায় পুরো ক্যান শেষ হয়ে যায়। আজ চার ঘণ্টা হয়ে গেছে, এখনও ঘুরেই যাচ্ছি। দেদার চা বিলি হচ্ছে ভাণ্ডারা থেকে। এমনই এক ভাণ্ডারা খুলেছে কলকাতার খেলাত ঘোষ লেনের রাম শারদ কোঠারি স্মৃতি সঙ্ঘ। ১৯৯০ এর করসেবায় এসে নিহত হয়েছিলেন দুই জনে। 
কিন্তু অযোধ্যার পথে পথে দেখা মিলছে উল্লসিত জনতার, নানা সাজ পোশাকে তারা নাচ-গান করছেন, কীর্তন করছেন। বড় অংশের ঝোঁক হচ্ছে ভিডিও ছবি সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করার। এদের হাতে হাতে রামের ছবি দেওয়া গেরুয়া পতাকা, সঙ্গে জাতীয় পতাকা, মোদীর ছবি। সেই ছবি-ভিডিওই দেখছে গোটা দেশ। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার এক আনন্দোল্লাসের মনোভাব তৈরি হচ্ছে তাদের মনে। কিন্তু ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’র জেরে আসলে প্রাণ ওষ্ঠাগত অযোধ্যার স্থানীয় বাসিন্দাদের।
 

Comments :0

Login to leave a comment