Ram Mandir

'হিন্দু রাষ্ট্র'গঠনের ডাক মোদী - ভাগবতে

জাতীয়

স্বর্ণেন্দু দত্ত: অযোধ্যা
 

রামমন্দির নির্মাণকে রাষ্ট্রমন্দির নির্মাণ বলে বারেবারে উল্লেখ করেছিলেন আরএসএস-বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা। সোমবার আরও একবার বললেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। কিন্তু এদিনের প্রাণ প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানে আরও এককদম এগিয়ে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বললেন, নতুন ভারতের প্রতীক আজকের অনুষ্ঠান। সেকাজে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কৃচ্ছ্রসাধনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সরসঙ্ঘচালক নির্ধারণ করে দিলেন আপামর ভারতবাসীর কর্তব্যও। আর আরএসএস প্রধানের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নিয়ে ‘প্রধান সেবক’ মোদী আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, রামের রূপে রাষ্ট্রচেতনার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রামের রূপে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তাঁর ঘোষণা, কালচক্র বদলে যেতে চলেছে। এবং সেই বদলের জন্য স্লোগান দিয়েছেন, ‘‘এহি সময় হ্যাঁয়, সহি সময় হ্যাঁয়।’’- এটাই সময়, সঠিক সময়।
প্রশাসন আর ধর্মের মিলমিশে আয়োজিত সভায় দাঁড়িয়ে এদিন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই মন্দিরে শুধু একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি; ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি,দর্শন,দিগদর্শণের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ভারতের চেতনা, সংস্কৃতি, দর্শন বলে যা বলছেন তা আসলে সবই হিন্দু ধর্মীয় চেতনা, সংস্কৃতি এবং দর্শনের কথা বলছেন। ফলে তিনি এদিন প্রকৃত অর্থে হিন্দু রাষ্ট্রের প্রাণ প্রতিষ্ঠার কথাই বলেছেন। এখনও একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংবিধানের মধ্যে কাগজে-কলমে দেশ আছে। এখনও সেই সংবিধানের আওতাধীন প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন। 
রামমন্দির আন্দোলন সব সময়ই একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি, কোনোদিনই এরমধ্যে কোনও ধার্মিকতা ছিল না। অযোধ্যায় নতুন রামমন্দিরের নির্মাণ উপলক্ষেও তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। রাস্তাঘাটে, বাড়িঘরে, বিদ্যুতের খুঁটিতে রাম, হনুমানের ছবি দেওয়া গেরুয়া পতাকার সঙ্গে বিজেপি’র পতাকা টাঙানো হয়েছে। মোহন ভাগবত, নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের ছবি দেওয়া হোর্ডিংয়েও বলা হয়েছে ভগবান প্রভু রামচন্দ্রের পুনঃস্থাপনা করার জন্য ভারতভূমির বীর সন্তানদের শুভেচ্ছা অভিনন্দন। রামকে বিজেপি বারেবারে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এবারে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সুযোগে ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে। আগামী লোকসভা ভোটে সম্পূর্ণত ব্যবহার করার প্রস্তুতি চূড়ান্ত। কিন্তু শুধু একটা নির্বাচনে জয় নয়, এই রামমন্দিরকে আরও বড় মতাদর্শগত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন ভাগবত-মোদীরা। এদিন তা বারেবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। 
জোশের পরিবেশে হোঁশের কথা বলার জন্য তাঁকেই দায়িত্ব নিতে হবে বলে জানান মোহন ভাগবত। প্রধানমন্ত্রী ১১ দিন কঠোর তপস্যা করেছেন। কিন্তু শুধু তিনি তপস্যা করলে হবে না। আমাদেরও নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে হবে। রামরাজ্য আসছে। তার জন্য আমাদেরও রাষ্ট্রের জন্য কাজ করতে হবে, ছোট ছোট বিষয় নিয়ে বিবাদ করার অভ্যাস ছাড়তে হবে। নিজেদের মধ্যে সমন্বয় রাখতে হবে, এটাই ধর্মের আচরণ। সম্ভবত মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে শঙ্করাচার্যদের মতবিরোধ এবং সংঘাতের পরিস্থিতির দিকেই তিনি ইঙ্গিত করেছেন। অন্যদের মত শোনার পরামর্শ দিতে গিয়ে তিনি গান্ধীজীকেও টেনেছেন। সাড়ে চারশো বছরের একটি মসজিদ ভেঙে, অন্যের ধর্মস্থানের দখল নিয়ে বানানো মন্দিরের উদ্বোধনের দিন গান্ধীকে টেনে আনছেন আরএসএস প্রধান- এটাই সম্ভবত এদিনের সব থেকে বড় বিদ্রুপ ছিল। শেষ পর্যন্ত ভাগবত ভারতকে বিশ্বগুরু বানানোর জন্য কর্তব্য নির্ধারণ করেছেন। নতুন কালচক্র নির্মাণের আহ্বানে এদিন ছত্রে ছত্রে জাতীয়তাবাদের আবেগ যুক্ত ছিল। হিন্দুত্ব এবং জাতীয়তাবাদের মিশেলই নতুন হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের উপকরণ। 
প্রধানমন্ত্রী মোদী সরাসরি বলেছেন, ২২ জানুয়ারি ক্যালেন্ডারে লেখা একটি তারিখ মাত্র নয়, নতুন কালচক্রের সূচনা হলো এদিন। অতীতের স্মৃতি উসকে দিয়ে বলেছেন, আমাদের রামলালা আর তাবুতে থাকবে না, ভব্য মন্দিরে থাকবে। দেশজুড়ে মানুষের আবেগ, অনুভূতি হচ্ছে তা নিয়ে। ভারতের চারদিক দিব্যতাতে ভরে উঠেছে। গোলামির মানসিকতা ভেঙে জেগে উঠছে রাষ্ট্র। হিন্দুত্ববাদীদের কাছে গোলামির অর্থ ব্রিটিশের থেকে নয়, গোলামির বলতে মুসলিম শাসনের দিকে ইঙ্গিত করে। 
মন্দির নির্মাণ এবং মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠাকে অলৌকিক এবং দৈব বলে বর্ণনা করলেও মোদীর মনের মাঝের আসল কথাটা রয়েই গেছে। ফলে শুরু থেকে একটি অনৈতিক কাজকে বৈধতা দিতে তিনি সংবিধান এবং আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছেন, ‘‘ভারতের সংবিধানের প্রথম পাতায় ভগবান রাম বিরাজমান। সংবিধান কার্যকরী করার পরেও রামের অস্তিত্ব নিয়ে আইনি লড়াই চালানো হয়েছে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ভারতের বিচার ব্যবস্থাকে। যারা ন্যায়ের মান রেখেছে। প্রভূ রামের মন্দিরও ন্যায়বদ্ধ পদ্ধতিতেই হয়েছে।’’ এই নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই যে ১৯৪৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭০ বছরে বারে বারে বিভিন্ন স্তরের আদালতের নির্দেশের সুযোগেই হিন্দুত্ববাদীরা আজ এই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছে। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানকেই চৌপাট করে দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হওয়ার পথে প্রধান হাতিয়ার করা হয়েছে রামকে। আদালতের ভূমিকা বারে বারে সেই ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর ধন্যবাদ জানানো স্বাভাবিক। কাশী-মথুরাও তো বাকি আছে এবং আদালতেই আছে। মঙ্গল-বুধবার ওই দু’টির ক্ষেত্রে পৃথক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ আসতে পারে আদালত থেকে।
মোদী বলেছেন, শান্তি, ধৈর্য, পারস্পরিক সদ্ভাব এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে এই মন্দির গড়ে তোলা হয়েছে। এই মন্দিরের জায়গাতেই এক সময়ে বাবরি মসজিদ ছিল। তার আশপাশে মূলত সংখ্যালঘু মুসলিমদের বসবাস। মসজিদ নেই কিন্তু মানুষের বসবাস আছে। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ মোদী কথিত শান্তি, ধৈর্য, পারস্পরিক সদ্ভাবের নমুনা ভুলতে পারেননি তাঁরা। বাবরি মসজিদের পিছনের দিকের এই এলাকায় ১৭জনকে হত্যা করা হয়েছিল। ২৪টি মসজিদ সম্পূর্ণ বা আংশিক ভাঙা হয়, শত শত কবর ধ্বংস করা হয়। বেছে বেছে মুসলিমদের ঘরে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর-লুট হয়েছিল অবাধে। ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার মোদীর এই প্রচেষ্টা এদিন টিভিতে বসে অযোধ্যার অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে তাঁরাও শুনেছেন। 
দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মোদী বলেছেন, ‘‘এটা শুধু একটি দেবমন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা নয়, রামের রূপে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাণ প্রতিষ্ঠা। ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন-দিগদর্শণের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ত্রেতাতে রাম যখন অযোধ্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তখন ১০ হাজার বছর রাজত্ব করেছিলেন। এখন তিনি আবার অধিষ্ঠিত হয়েছেন, এখন আমাদের কাজ কালচক্র বদলের। ইতিহাস আমাদের কালচক্র পরিবর্তনের কারিগর হিসেবে মনে রাখবে। হাজার বছর পরেও রাষ্ট্র নির্মাণে আমাদের কাজকে মনে রাখবে।’’ ৩৬ মিনিটের ভাষণে মোদী দেশবাসীর জন্য বেঁধে দিলেন নতুন মন্ত্র, ‘দেব সে দেশ; রাম সে রাষ্ট্র’।
‘মোদী কথিত রাষ্ট্র নির্মাণের অর্থ কী? কোন রাষ্ট্র নির্মাণের কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী, তা সুস্পষ্ট তাঁর সমগ্র বক্তব্যে। স্বভাবসিদ্ধ নাটকীয় ঢঙে বলেছেন, ‘‘এটাই সময়, সঠিক সময়। আজকের এই সময় থেকে আগামী হাজার বছরের ভারতের ভিত্তিস্থাপন করতে হবে। সেই নতুন ভারত নির্মাণের শপথ নিচ্ছি।’’ সেই ভারত হিন্দুত্বের ভারত, সেই রাষ্ট্র হিন্দুরাষ্ট্র একথা বলার অবকাশ রইল না।

Comments :0

Login to leave a comment