প্রতীম দে
সোমবার রাতে পাড়ার মোড়ের পেনের দোকান গুলোয় ছাত্র ছাত্রীদের ভিড়। শিক্ষক দিবস উপলক্ষে শিক্ষক, শিক্ষিকাদের জন্য পেন বা উপহার কেনার জন্য সবাই ভিড় জমিয়েছে। শুধু পেনের দোকান নয়, কেকের দোকানেও ভিড় জমেছে। স্কুল, কলেজে আজ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু এই আনন্দের দিনেও রাস্তায় বসে রয়েছেন টেট, এসএসসটির যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা।
৯০০ দিন পার। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে চাকরির দাবিতে রাস্তায় বসে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা। এই আন্দোলনকারিদের আজ হয়তো স্কুল বসে ছাত্র ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সাক্ষী থাকতেন। কিন্তু তা হয়নি। টাকার বিনিময় চাকরি বিক্রি হয়েছে। তারা যোগ্য, মেধা তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও তাদের চাকরি হয়নি। ভবিষ্যতের নাগরিক তৈরি করার যেই স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন তা অধরা থেকে গিয়েছে।
হাতে চক ডাস্টার থাকার বদলে কারুর হাতে উঠেছে লাঙল, তো কারুর ছেনি হাতুড়ি। চাকরির দাবিতে বার বার পথে নেমেছেন চাকরি প্রার্থীরা। মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে চেয়েছেন। কিন্তু পারেননি। মুখ্যমন্ত্রী ধনধান্য অডিটোরিয়ামে শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে রাজ্যপালকে নিশানা করেছেন, কিন্তু এই যোগ্য বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের নিয়ে কোন বাক্য ব্যায় করেননি।
বছর তিরিশের সুবোধ হালদার। বীরভূমের ইলমবাজারের বাসিন্দা। এসএসসি পাশ করেও এখন সংসার চালাতে দিন মজুরের কাজ করতে হচ্ছে। সুবোধ হালদারের বাবা ছিলেন দিনমজুর। কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করে ছেলেকে তিনি স্নাতকোত্তর এবং বিএড পড়িয়েছিলেন। সুবোধ হালদারের কথায়, ‘‘বাবা পেশায় দিনমজুর। খেটেখুটে পয়সা জোগাড় করে লোকের থেকে টাকা ধার করে আমাকে তিনি পড়িয়ে ছিলেন। বাবার এবং আমার পরিবারের সকলের স্বপ্ন ছিল যে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে সরকারি স্কুলে টিচারের চাকরি করব। কিন্তু আজও সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।’’ নিজের পড়ার খরচ চালাতে সে নিজেও দিনমজুরের কাজ করেছে। ২০১৬ সালের হওয়া এসএসসি পরীক্ষার মেধাতালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও এখনও চাকরি হয়নি তার।
কিন্তু সময় তো আর থেমে থাকেনি। সুবোধের বাবার বয়স বেড়েছে। কাজ করার ক্ষমতা কমেছে। আর সংসার টানার ভার এসে পড়েছে সুবোধের কাঁধে। এখন তাঁর ঘরে শুধু বাবা মা নয়, স্ত্রী এবং সন্তানও আছে। তাঁদের মুখে দুবেলা ভাত তুলে দিতে হাতে চক ডাস্টারের বদলে গাইতি, কোদাল তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বললেন, ‘‘আজ বলতে লজ্জা নেই যে বাড়ির লোকেদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি দিনমজুরি করছি। ওদের জন্য যদি ভ্যান চালাতে হয় তাও চালাবো।’’
আর লড়াই? বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই? সেটাও কি চলবে? এর উত্তরে একটাই কথা বললেন, ‘‘জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়ে যাবো।’’
এরকম আরও অনেক সুবোধ হালদার টানা ৯০০ দিন অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন কলকাতায় গান্ধী মূর্তির পাদদেশে। দাবি একটাই এসএসসি উত্তীর্ণদের স্বচ্ছতার সাথে নিয়োগ। ২০১৯ সালে প্রেস ক্লাবের সামনে তাদের ধরনা মঞ্চে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলেছিলেন যে তিনি তাদের নিয়োগের বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু তৃতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে সেই সময় তাঁর হয়নি।
মুখ্যমন্ত্রীর এহেন আশ্বাসের পর এসএসসি উত্তীর্ণ সাফি কর্মকারের মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন যে এবার হয় তো সব সমস্যা মিটবে। কিন্তু তাঁর সেই আশা পূরণ হয়নি। সাফি জেলে পরিবারের সন্তান। বাবা মাছ চাষ করতেন। এই মাছ চাষ করতে গিয়েই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। সাফি কর্মকারের মা অনেক আগেই মারা গেছেন। ছোট বোনকে নিয়ে কষ্ট করে দিন চলে তার। কিন্তু তাও পিছিয়ে আসেননি আন্দোলনের রাস্তা থেকে। সাফির কথায়, ‘বাবা মা কষ্ট করে পড়িয়েছেন। কিন্তু সুখের মুখ তাঁরা দেখতে পারেননি। যাদের জন্য আজ আমার এই অবস্থা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই তো চালাবোই’। সাফির বোন এখন পড়াশোনা করে। তারও ইচ্ছা বড় হয়ে স্কুল টিচার হওয়ার। কিন্তু নিয়োগ দুর্নীতি দেখে এখন থেকেই সে আশঙ্কিত।
সাফির মতো আরও এক কৃষক পরিবারের সন্তান মৌসুমী ঘোষ দাস। রাষ্ট্র বিজ্ঞানে বিএড পাশ করে ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় তিনি বসেন। পাশও করেন। কিন্তু বাকিদের মতো তাঁরও এক পরিস্থিতি। শিক্ষিকা হিসাবে নিয়োগ পেলেন না কোনও স্কুলে। মেয়ের চাকরি পাওয়াকে কেন্দ্র করে ঘুরতে ঘুরতে অসুস্থ হয়ে পড়েন মৌসুমী ঘোষের বাবা। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। মৌসুমী ঘোষ দাসের কথায়, ‘সাধারণ এক কৃষক পরিবারের মেয়ে আমি। ছোটবেলা থেকে কষ্ট করে বড় হয়েছি, স্বপ্ন ছিল যে একটা ভালো চাকরি করে বাবা-মার মুখে একটু হাসি ফোটাবো। কিন্তু তা আর হয়নি। উলটে আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে বাবা আজ নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এখন এমন পরিস্থিতি যে তাঁর চিকিৎসার জন্য টাকাপয়সা ঠিকমতো জোগাড় করতে পারছি না।’
একদিকে যখন মেয়ের চিন্তায় মৌসুমী ঘোষের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তখন অন্যদিকে আরেক বাবা মানে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারী নিজের প্রভাব খাটিয়ে নিজের মেয়েকে স্কুল শিক্ষকের চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। এসএসসি’র নিয়োগকে কেন্দ্র করে যে দুর্নীতি প্রতিদিন সামনে উঠে আসছে তার পিছনে রয়েছে সুপরিকল্পিত একটি চক্রান্তের জাল।
২০১৬ সালে যে এসএসসি পরীক্ষা হয় তার ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে এসএসসি’র গেজেটের কোনও নিয়ম মানা হয়নি। মেধাতালিকায় চাকরিপ্রার্থীদের কোনও প্রাপ্ত নম্বরের উল্লেখ ছিল না। তাদের নাম ক্রমিক সংখ্যা এবং র্যাওঙ্ক উল্লেখ করা হয়েছিল। তাছাড়া চূড়ান্ত মেধা তালিকা প্রকাশের পর নিয়োগ শুরু হওয়ার আগে হঠাৎ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং নবম ও দশম শ্রেণির গণিতের ক্ষেত্রে পিছনের সারিতে থাকা অনেকের নাম সামনের সারিতে উঠে আসে। তারমধ্যে অন্যতম নাম অঙ্কিতা অধিকারী। হঠাৎ করে প্রভাবশালী বাবার একমাত্র মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর নাম রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মেধা তালিকার প্রথম স্থানে উঠে আসে। কীসের ভিত্তিতে তার নাম উঠে এল প্রথমে ? উত্তরটা হলো, তাঁর বাবা রাজ্যের মন্ত্রী প্রভাব খাটিয়ে মেয়েকে তিনি চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শুধু এসএসসি’র ক্ষেত্রেই নয় কলেজ সার্ভিস কমিশনের ক্ষেত্রেও অঙ্কিতা অধিকারী নাম মেধা তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। ২০১৮ সালে কলেজ সার্ভিস কমিশন পাশ করা ৬০০ জন চাকরিপ্রার্থীর এখনও কোনও নিয়োগ হয়নি। কিন্তু অঙ্কিতা অধিকারীর নাম রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এবার আর কোনও স্কুলের শিক্ষকের জন্য নয় তাঁর নাম জায়গা করে নিয়েছে কলেজ শিক্ষক হওয়ার জন্য।
চাকরিপ্রার্থীদের কথায় অঙ্কিতা অধিকারীর মতন একাধিক ব্যক্তি রয়েছেন যাদের নিয়োগ হয়েছে শাসকদলের মদতে। কথায় কথায় সুবোধ হালদার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘‘২০১৪ সালে যখন টেট পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম তখন পাশের পরীক্ষার্থীকে দেখেছিলাম সাদা খাতা জমা দিতে। তাকে যখন জিজ্ঞেস করি যে ভাই কেন তুমি সাদা খাতা জমা দিচ্ছ, তখন সে বলে যে আমার ভেতর থেকে সব সেট করা রয়েছে।’’
রাজনৈতিক কারণে মৃত্যু বাংলা দেখেছে কিন্তু চাকরি চাইতে গিয়ে চাকরির দাবিতে আন্দোলন করতে করতে মৃত্যু কোনদিন বাংলা দেখেনি। মিঠু মণ্ডল। এসএসসি পাশ করা অন্যতম চাকরিপ্রার্থী। চাকরির দাবিতে তিনিও বাকিদের মতো কলকাতার রাস্তায় লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলেন। আর এই আন্দোলন চলাকালীন শারীরিকভাবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি তিনি। মিঠু মণ্ডল মারা গেলেও তাঁর পরিবার আজ পর্যন্ত কোনও সরকারি সাহায্য পায়নি, কারণ তিনি যে হকের দাবি নিয়ে লড়াই করেছিলেন।
Comments :0