চিন্ময় কর: মেদিনীপুর
তাঁকে অপহরণ করেছিল বিজেপি-র লোকজন। ইন্দ্রাণী দে’র তেমনই অভিযোগ। তাঁকে বাদ দিয়ে তাঁর আসনে এবার তৃণমূল প্রার্থী করেছে সেই বিজেপি’রই একজনকে।
কেশিয়াড়ি ব্লকের কেশিয়াড়ি পঞ্চায়েতের পাঁচ বছরের প্রধান ইন্দ্রাণী সোমবার বললেন,‘‘আমি দলের প্রচারেও নামিনি। আমি আর এসবের মধ্যে থাকতে চাই না। একজন সাধারণ ভোটার হিসাবে থাকতে চাই। ভোট দিতে যাবো, এইটুকু বলতে পারি।’’
আপনার দুঃখ হয়নি? আপনি একজন মহিলা। আপনাকে এই ভাবে ছেঁটে ফেলা হলো। ইন্দ্রাণী মৃদু হাসলেন। বললেন,‘‘আমার স্বামী একজন সিভিক ভলান্টিয়ার। আমি এই ঠিক আছি। বাড়িতে ছোট বাচ্চা। আমার দুঃখের কোনও বিষয় নেই।’’
কিন্তু বোঝা গেল এক তীব্র অপমান বোধ ঘিরে আছে গ্রামবাংলার এই মহিলাকে। বিষাদ ছুঁয়ে ছিল তাঁর সবকটি উচ্চারণে।
২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে, পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠনের দিন তাঁকে বিজেপি অপহরণ করে। কেশিয়াড়িতে মমতা ব্যানার্জির শাসনেই আরএসএস মাথাচাড়া দিয়েছে। মোহন ভাগবত এখানে এসে থাকেন। মমতা ব্যানার্জি ফুল, মিষ্টিসহ শুভেচ্ছা পাঠান।
সেই এলাকার গৃহবধূ ইন্দ্রাণী বললেন,‘‘আমি ছিলাম একমাত্র ওবিসি। ওবিসি-দের জন্য প্রধান পদ সংরক্ষিত ছিল। ওরা (বিজেপি) ভেবেছিল আমাকে অপহরণ করলে পঞ্চায়েত দখল করা যাবে। পরে অবশ্য আবার বোর্ড ডেকে আমাকে প্রধান করা হয়। আমার বাচ্চা তখন আটমাসের। তবুও রেহাই মেলেনি। দল থেকে থানায় অভিযোগও করা হয়েছিল।’’ তাতে কার কার নাম, মিহির রানার নাম ছিল কিনা ইন্দ্রাণী বলতে চাননি। কৌশলে এড়িয়ে গেছেন।
এবার তাঁর সেই বেগমপুর আসনে তৃণমূলের প্রার্থী মিহির রানা। বিজেপি’র নেতা ছিলেন— কিছুদিন আগেও। তৃণমূলে তাঁকে বরণ করে প্রধানের সিটে দাঁড় করিয়ে দিল ।
কেন এমনটা? সিপিআই(এম)-কে আটকাতে বিজেপি’র কিছু ভোট চাই তৃণমূলের। তাই ইন্দ্রাণী বাদ।
বিজেপি আর তৃণমূলের এমন বোঝাপড়ার কাহিনি অনেক জায়গাতেই।
শালবনীর পীড়াকাটা মোড়ে চা চপের দোকানে সবাই মন খোলা কথা বলছে পঞ্চায়েতের ভোট নিয়ে। এক বয়স্ক নলিনী মাহাতো বললেন,‘‘উধার নিয়ে চলছে তৃণমূল আর বিজেপি।’’ উধার মানে কী বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে দেখে আমার দিকে তাকালেন। ‘‘তুমি কি শহরে থাকো? আরে আমরা গ্রামের মানুষ। ভোর দুপুরে কুটুম ঘরে এলে তখন পাশের বাড়ি থেকে তেল ডাল বা পোস্ত ধার নিয়ে সামাল দেই। আর ওই জিনিসটাই আবার ফেরত দেই। একেই উধার বলি মোরা।’’
নলিনী মাহাতোর বাড়ি পাশের গ্রাম গড়মালে। সেই গড়মালে পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের নিতাই ভূঞা আর উপপ্রধান বিজেপির বঙ্কিম মাহাত। দুটো দলই আবাস যোজনায় কাটমানি সহ দুর্নীতিতে, একশ দিনের কাজে ভুয়ো খরচ করে লুট, এমনকি ঢালাই রাস্তা না তৈরি করে তার বরাদ্দ লুটের অভিযোগে অভিযুক্ত। সেই সব দুর্নীতি দেখে গেছে কেন্দ্রীয় টিম। পদক্ষেপ? না, কিছু নেওয়া হয়নি।
ওই শালবনীর কাশীজোড়া অঞ্চলের বৈঁউচা পূর্বে তৃণমূলের প্রার্থী নীলিমা ব্যানার্জি। তাঁর প্রস্তাবক বিজেপির বিদায়ী পঞ্চায়েত সদস্য জিতেন মাহাত। গত বারে বিজেপির প্রার্থী হয়ে ভোটে জিতেছিলেন।
জগন্নাথ মাহাত এবার সিপিআই(এম) প্রার্থী জেলা পরিষদের— শালবনীর ওই এলাকা থেকেই। বলেন,‘‘জিন্দালের কারখানা হলো না বড়। যা ছোট হলো, তাতে তৃণমূলের আর বিজেপির ব্লক নেতা ও জেলা নেতারা ভাগবাঁটোয়ারা চলছে। ক্ষমতায় এসে সিপিআই(এম)’র উপর অত্যাচার হয়েছে। তারপর গত দুটো পঞ্চায়েতে ভোটে সিপিআই(এম)-কে আটকে বিজেপিকে মনোনয়ন করতে দিয়েছিল। এর কারণ একটাই। তৃণমূলের হাতে সিপিআই(এম)’র অত্যাচারিত সমর্থকরা তৃণমূলকে ভোট দেবেন না। ওরা জানে। সেই জন্যই সিপিআই(এম)-এর লোকজনকে বিজেপিতে শামিল করানোর প্রয়াস ছিল। নিজেরা পঞ্চায়েত চালিয়েছে ভাগ বাঁটোয়ারা করেই। লুটেছে। চলেছে স্বজন পোষণ।’’
সাতপাটিতে কথা হচ্ছিল রাধানাথ পালের সঙ্গে। সাতপাটিতেও পঞ্চায়েত চলেছে তৃণমূল আর বিজেপি’র হাত ধরাধরি করে। প্রধান তৃণমূলের পরিমল ধল আর উপপ্রধান বিজেপির উত্তরা সিং। বিজেপি মণ্ডল সভাপতি শেখ সাহাজান। পেশায় ঠিকাদার। সিপিআই(এম)-কে হারাতে কোন বুথে তৃণমূল এবং কোন বুথে বিজেপি প্রার্থী, তা ঠিক হয় তাঁর নির্দেশে।
এই সাতপাটিতেই আমফানে ক্ষতিপূরণ যাদের দেওয়া হলো, কারোরই কোনো ক্ষতি হয়নি। অভিযোগের তদন্তে তাই উঠে আসে। যাঁদের পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ৯০০-র বেশি ছিলেন তৃণমূলের নেতা কর্মী, তাঁদের আত্মীয়রা। আর সাতশোর বেশি ছিলো বিজেপি’র পছন্দের লোক।
‘উধার’ কেশিয়াড়ি ব্লকেও। এখানে ঘৃতগ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলেন বিজেপি সুলতা সর্দার মান্ডি। তিনি এবারে তৃণমূল দলের হয়ে পঞ্চায়েত সমিতির ২০ নম্বর আসনে প্রার্থী হয়েছেন। আর উপপ্রধান বিজেপি দলের শুক্লা হাঁসদা এখন তৃণমূলের মহিলা সেলের নেত্রী এবং সিভিক কর্মী।
এমন উদাহরণ অনেক।
বোঝাপড়ার একটিই কারণ— বামফ্রন্টকে আটকানো।
Comments :0