Post Editorial

রাজ্যে দুষ্কৃতীদের বারুদের স্তূপ
মানুষের মনেও আগ্নেয়গিরি তৈরি হচ্ছে

উত্তর সম্পাদকীয়​

Post Editorial

মানবেশ চৌধুরি

রাজকুমার রায়। বাড়ি ফাঁসিদেওয়া। শিক্ষকতা করতেন উত্তর দিনাজপুর জেলার রহতপুর মাদ্রাসায়। স্ত্রী, এক কন্যা, এক পুত্র নিয়ে শান্তির সংসার। ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনের ডিউটি পড়েছিল ইটাহার থানার এক বুথে। 
তৃণমূলী গুণ্ডারা তাঁকে দিয়ে ছাপ্পা ভোট করাতে বাধ্য করতে চাইছিল। তিনি রাজি হননি। তাঁকে তুলে নিয়ে এসে রায়গঞ্জ শহরের পূব দিয়ে যে ট্রেন লাইন চলে গিয়েছে, সেখানে হত্যা করল গুণ্ডারা। পরদিন তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গেল সেখানে। 
তৃণমূলী পাষণ্ডরা ছাড়া, সবাই হায় হায় করতে লাগল। শিক্ষক সমাজ পুলিশের রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা না করে রায়গঞ্জে পথ অবরোধ করলেন। গড়ে উঠলো একটা সংগঠন– ‘রাজকুমার রায় হত্যার বিচার চাই মঞ্চ’। তাঁদের আরও স্লোগান– ‘ভোটদাতা – ভোটকর্মী’ একতা গড়ে তোল। সে বছর সংগঠনের উদ্যোগে রায়গঞ্জেই অনুষ্ঠিত হলো এক বিরাট প্রতিবাদ সভা। সেই সভায় রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে শামিল হলেন হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী। মাঝে মাঝেই এই সংগঠন নানা প্রোগ্রাম করে আসছেন। যেমন কয়েকদিন আগে  ১৫ মে করলেন রায়গঞ্জ শহরে। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে করলেন ৬টি জায়গায়। এবার কর্মচারী সমাজ যুক্ত হলেন।


দুই
আসলে ১৯১৩ ও ১৯১৮ সালে কোনো নির্বাচনই হয়নি।  
তৃণমূলীরা যা যা  দুষ্কার্য করেছিল, তা একটু মনে করিয়ে দিই। ১) ভোটে দাঁড়াতে না দেওয়া। ২) বিডিও অফিসে নমিনেশন দিতে গেলে বেদম মার, মাটিতে ফেলে বীভৎস অত্যাচার। এখানে নমিনেশন জমা দেওয়া গেলো না।  তবে যাওয়া যাক এসডিও অফিসে। সেখানেও একই সন্ত্রাস।  ৩) কোনক্রমে নমিনেশন জমা দিলেও, প্রচার করতে না দেওয়া। ৪) কোনক্রমে প্রচার করতে পারলেও, ভোটের আগের রাতেই বুথ কর্মীদের ভয় দেখিয়ে ছাপ্পা ভোটের সব ব্যবস্থা করে নেওয়া, তা না পারলে, ভোরের আগে থেকেই বুথে গোলমাল করা, ভোটার ও ভোট কর্মীদের ভয় দেখানো, ছাপ্পা ভোট। ৫) গণনা কেন্দ্রে নিয়ে যাবার আগেই ভোট বাক্স ভেঙে ওলট পালট করা। এবং শেষে ৫) দলবেঁধে গণনা কেন্দ্রে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গিয়ে, বিরোধী দলের সবাইকে মেরে কলার ধরে বের করে, এমনকি মহিলা প্রার্থীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করে, তামাম  রেজাল্ট লুট করা।  এগুলি সবই বোমা-বন্দুক নিয়ে এবং পুলিশের উচ্চ কর্তাদের সঙ্গে বন্দোবস্তে পুলিশের দ্বারা। শুধু গুণ্ডা ডাকাতরা নয়, তৃণমূলের জেলার সভাপতি-এমপি- এসপি মিলে পর্যন্ত এই ভোট লুট-কাণ্ড করা হয়েছিল।
এই দুষ্কার্য ঘটাতে ওরা ভোট কর্মীকে, অপমান করা, প্রহার করা ও  হত্যা করা কিছুই  বাদ রাখেনি। যেমন, রাজকুমার রায়ের হত্যাকাণ্ড।    
তাই সরকারি হিসাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূলীদের জয়  ৩৪ শতাংশ দেখানো হলেও, আসলে প্রায় ১০০ শতাংশ আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওরা ‘জয়ী’ হয়ে যায়।

পঞ্চায়েতের উপনির্বাচনগুলিতে হয়েছে আরও মারাত্মক কাণ্ড! সারা ব্লকের গুণ্ডা–ডাকাতদের আগের দিন বিকাল থেকে এনে রাখা হয়েছে, বিএড কলেজ জাতীয় কিছু বড় জায়গায়, চব্য চোষ্য লেহ্য পেয়’র মহা ধুম। দেদার মদের ফোয়ারা। ভোর সকালে বুথের প্রত্যেকের বাড়ির দুয়ারের সামনে পিস্তল সাটারধারীরা মোতায়েন হয়ে গেল তারা। একজনেরও বেরনো হবে না।  
উপনির্বাচনেও কোনো বুথে এমপি গিয়ে পুলিশদের ধমকিয়েছে – ভোট হচ্ছে কেন? আপনারা কী– এই শব্দের পরে যে প্রশ্নবোধক কথা বলেছেন তিনি, তা সাধারণ্যে উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। 
 অতএব, এখন যারা আছে, তারা কেউই নির্বাচিত নয়। ফলত জনগণের প্রতি এদের কোন দায়বদ্ধতা নেই। একমাত্র কাজ নোট কামানো। 
একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা, এই যে গ্রামাঞ্চলে দাপট ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করল, তারই পরম্পরায়, ভূমিকম্প হলে যেমন আফটার শক থাকে, জনগণের মনে সেই ভীতির ভাবটা থেকেই গেল, তৃণমূলীদের মধ্যে সৃষ্টি হলো এক সর্বগ্রাসী জান্তব উল্লাস।  এই পরিবেশে তারা বিধানসভা–লোকসভা নির্বাচনগুলিতেও ‘জয়ী’ হলো।  

তিন
যেরকম বেসুমার চুরি করেছে, সেই অপরাধে, যে অভিষেক ব্যানার্জি দাপটের সঙ্গে বেপরোয়া অনর্গল মিথ্যা কথা বলতে অভ্যস্ত, যে রাজ্যের মাফিয়াদের সর্দার, যে একটা বেহায়া লজ্জাহীন– যে বুকের ছাতি ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সেই রাজপুত্রটিকে যাতে ফাটকে না যেতে হয়, এবং যাতে পঞ্চায়েত ভোটটা পেছানো যায়- এই  ফিকিরে ‘ধন গরিমার ইতরতা’ দেখাতে দেখাতে, সে যাত্রা-ফাত্রা করছে।  
মানুষ ধরে ফেলেছেন এসব ফন্দি–অপকৌশল। তৃণমূলীদের যে চুরি–লুট-ছলনা-সাম্প্রদায়িকতার বৃত্তি ছাড়া, আর কোনো বৃত্তি নেই, এ ক’দিনে তাদের অভ্যন্তরীণ প্রার্থী বাছাইয়ের অপকাণ্ডে, পঞ্চায়েত ও অন্য ভোটের সময় যেমন ভোট লুট করে, তারই মহড়া দেখে, মানুষের কাছে তা জলবৎ পরিষ্কার। 
ওদের বেআব্রু চেহারা বেরিয়ে এসেছে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া–ঝাঁটি মারামারি-রক্তপাত এই যাত্রা পথে তার নিত্য সঙ্গী। যুবরাজ একটু পরীক্ষা করে দেখলেন, তাদের গুণ্ডা বাহিনী কেমন আছে! আগের মতোই আছে। কী আর নতুন হবে!  ইল্লদ যায় না ধুলে আর স্বভাব যায় না মলে। বিষ ফলের গাছে কি আম ফলে!


কিছু বশংবদ অশ্লীল লোক ছাড়া এই যাত্রা-ফাত্রার ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে, রাজ্যের মানুষের বিবমিষার উদ্রেগ হচ্ছে।
 মানুষ অভিজ্ঞতায় জানেন তৃণমূল গণহারে মানুষ হত্যাকারী, সন্ত্রাসী ও গণতন্ত্র হত্যাকারী। অস্ত্রশস্ত্র ওরা ব্যবহার করতে চাইবেই। এই এক বছরের মধ্যেই কত বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল চিন্তা করলেই এই দলটি সম্পর্কে ঘৃণার উদ্রেক হতে বাধ্য। দুবরাজপুর, কোচবিহারের নিগম নগর, খণ্ডঘোষের ডাহুকা, টিটাগড় ইত্যাদি জায়গার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ছাদ উড়ে গেল বোমা বিস্ফোরণে। তার সঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুরের ভূপতিনগর, দেগঙ্গার চাঁদপুরে তৃণমূল নেতাদের বাড়িতে বোমা ফেটে অনেক কয়েকজন মারা গেলেন। ভগবানপুর, খেজুরী, পাঁশকুড়া, পুন্দা– এসব জায়গার তৃণমূলীদের বাড়িতে নিজেদের তৈরি বোমা ফেটে মহিলা, কিশোর, শিশু সহ অনেকে মারা গেলেন। বগটুই গণহত্যাকাণ্ডের কথা আমরা ভুলব কী করে! তা তো অনুব্রতের শাগরেদ তৃণমূলের লোকেদের লুটের ভাগ নিয়ে কূট-কাচালির এক বিয়োগান্তক পরিণতি। পুড়িয়ে মারা হলো ১০ জনকে।  এর সঙ্গে যুক্ত হলো  সাম্প্রতিক পূর্ব মেদিনীপুরের গোপীনাথপুরে খাদিকুল গ্রামে তৃণমূলী নেতা ভানু বাগের বোমার কারখানায় বিস্ফোরণে ১২জনের মৃত্যু। এঁদের মধ্যে কেউ মারা গিয়েছেন বিস্ফোরণে, প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে আহত কয়েকজনকে ভানুর ভাইপো পুকুরে ছুঁড়ে হত্যা করেছে বলেও অভিযোগ। ঐ কারখানায় যে বোমাই তৈরি হতো, ইলেকশন উপলক্ষেই তৃণমূলীদের জন্য যে সেসব বানানো হতো এবং তা যে বিভিন্ন জায়গার তৃণমূলীরাই নিয়ে যেতো, গ্রামের নারী– পুরুষকে যে জোর করে, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করার ভয় দেখিয়ে বোমা বানাতে বাধ্য করা হতো, এর আগে আরও দুবার যে এখানে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, যাতে মালিকের ভাই-ভ্রাতৃবধূ, ভাইপো নিহত হয়– সেসব এখন রাজ্যের মানুষ জেনে গিয়েছেন। পুলিশকে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়ে এই বেআইনি কারখানা চালাতো সে, রাজ্য সরকারের মদতে। খাদিকুলের পরদিনই বিস্ফোরণ হলো মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের বোমা কারখানায়। সেখানে তৃণমূলী নেতার ছেলে ও নাতির হাত উড়ে গেল। তারপর দিন হলো ভাঙড়ে। তার একদিন পরে, জানা গেল, বজবজে ঐ কারণেই মারা গেল ৩ জন।        
এসব সংবাদে এসেছে জন্য জানা গিয়েছে। এর বাইরে রাজ্যের আনাচে কানাচে কত জায়গায় যে বোমা বন্দুকের আখড়া আছে, তা কল্পনা করাও মুশকিল।

চার
তৃণমূলের কোনও কথাকে বিশ্বাস করা চলে না। মরে যাওয়ার প্রাকমুহূর্তে রোগীর যেমন হিক্কা ওঠে, তেমন মরণ হিক্কা উঠবে ওদের। তাই একটা মরিয়া অপচেষ্টা করবে তৃণমূল।  
কিন্তু অবিনাশী মানুষ বুঝতে শুরু করেছেন দ্রুত, ২০১৮’এর পরে নদী-শাখা নদী-খাড়ি দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। তৃণমূল-বিজেপি যে  চোর–লুটেরা-তস্করদের দল, সাম্প্রদায়িকতা যে তাদের অ্যাজেন্ডা- এই কথা মানুষজনও বলছেন। অনেক গ্রামে একসঙ্গে শত শত, কোথাও হাজার হাজার  মানুষ তৃণমূল–বিজেপি ছেড়ে বাম ও বামসঙ্গীদের পতাকা ধরছেন। মিটিং করছেন। গ্রামকে গ্রাম। যত দিন যাচ্ছে, তৃণমূল–বিজেপির অবস্থা কাহিলতর হচ্ছে। জেহাদ করে বিভিন্ন জায়গার নিজেদের অফিসের সাইনবোর্ড খুলে দিচ্ছে তৃণমূলীরা। নেত্রীর ছবি ধুলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। পতাকা–ফেস্টুন ড্রেনে। সাইনবোর্ড খুলনেওয়ালারা বলছে, নেতারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কার্যক্ষেত্রে তার কিছুই হয়নি। কোন মুখে যাবো মানুষের কাছে? তার সঙ্গে রাজ্যজুড়ে চলছে, তৃণমূলীদের নিজেদের মধ্যে, এমনকি, প্রাণঘাতী আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ। 
সমবায় নির্বাচন, পৌরসভা, বিধানসভা উপনির্বাচনে ইদানিং শুধু বামেরা ও তাদের জোটসঙ্গীরাই বিজয়ী হচ্ছেন। কর্নাটকের সাম্প্রতিক নির্বাচনেও বিজেপি’র শোচনীয় পরাজয় ও কংগ্রেসের জয় মানুষের মনে উৎসাহ সৃষ্টি করেছে।  
পঞ্চায়েত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতেই হবে- জেদ নিয়ে রাজ্য কাঁপিয়ে  স্লোগান দেওয়া  শুরু হয়েছে– ‘চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি চ্যালেঞ্জ নাও/ পঞ্চায়েতের তারিখ দাও।’ 
বামপন্থী ফ্রণ্ট ও কোথাও কোথাও কংগ্রেসের পক্ষ থেকে থানা, এসডিও অফিস ঘেরাও করে দলদাস পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসনকে বলা শুরু হয়েছে-  খবরদার এবার আর দালালি করতে এসো না।

তৃণমূলকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে- বার বার ঘুঘু তুমি ধান খেয়ে যেতে পারবে না। ২০১৩, ২০১৮ সাল আর ২০২৩ সালে অনেক তফাৎ। মানুষের মধ্যে ভয় যেমন সংক্রামক, জানবে সাহসও তেমনই সংক্রামক। এবার আমরা সাহসে বলীয়ান। এবার আমরা মরিয়া। আত্মরক্ষার অধিকার সবার আছে। তোমরা যদি বোমা বন্দুক নিয়ে আসো, তবে আমরাও ঝাণ্ডার সঙ্গে গুঁজি ভাইলকা বাঁশের ডান্ডা নিয়ে আসব। তার কাছে তোমাদের যে ক’টা গুন্ডা আছে, তারা নস্যির মতো উড়ে যাবে। মনে রেখো, তোমাদের অপশাসনে মানুষ কিন্তু ভয়ানক ক্ষেপে আছে। তোমরা যেমন রাজ্যটাকে বারুদের স্তূপ বানাতে চাইছো, তেমনি রাজ্যের সাধারণ মানুষের মনগুলোও কিন্তু আগ্নেয় গিরি হয়ে আছে।


 

Comments :0

Login to leave a comment