সুবিনয় মৌলিক
আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদকে রুখে দেওয়ার শপথ পুনরুচ্চারণের লক্ষ্য নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শান্তি ও সংহতি দিবসে মহামিছিল হবে কলকাতায়। অবশ্যই নতুন কিছু নয়। বাংলার সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ও আধিপত্যবাদ-বিরোধী চেতনার দীর্ঘ ঐতিহ্যকে ধারণ করে প্রতি বছর ১ সেপ্টেম্বর বামপন্থী, প্রগতিমনস্ক, গণতন্ত্রপ্রিয় ও শান্তিকামী মানুষের উদ্যোগে কলকাতায় ও অন্যত্র নানা কর্মসূচি পালিত হয়। এ বছরও হবে। ধর্মতলায় মহাসমাবেশ হবে এবং মিছিল হবে।
১ সেপ্টেম্বর দিনটিকে আলাদা করে পালনের বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত সকলেরই জানা। ১৯৩৯ সালের এই দিনে হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই পৈশাচিক স্মৃতি অবিস্মরণীয়। তাই এই দিনটি নিছকই শান্তি কামনার দিন নয়, বরং বিস্মৃতিহীন ধিক্কারের এবং সাম্রাজ্যবাদী দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে অবিরত সংগ্রামের শপথ গ্রহণের দিন। নাৎসি ও ফ্যাসিবাদী নৃশংসতার শিকার লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং সাম্রাজ্যবাদী সংঘাত ও পুঁজির সীমাহীন লালসার শিকার অসংখ্য মানুষের প্রতি সংহতি প্রকাশের দিন।
১ সেপ্টেম্বরকে অর্থবহ করতে হলে সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান আগ্রাসী নীতি এবং তার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। আমরা এক কঠিন সময় পার করছি, যেখানে প্যা লেস্তাইন ও ইউক্রেনের মতো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন ও পুরানো সামরিক সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদীদের মূল লক্ষ্য এখন যুদ্ধ-অর্থনীতি. ফলে সামরিক ব্যয় আকাশচুম্বী এবং ফ্যাসিবাদ, বর্ণবাদ ও 'অপরাধ' ক্রমবর্ধমান। এমন পরিস্থিতিতে শান্তির জন্য সংগ্রাম করা এক 'অস্তিত্ববাদী' অপরিহার্যতা।
যুদ্ধেই মুনাফা
যে তাত্ত্বিকরা একসময় সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপে সমাজন্ত্রের বিপর্যয়ের পর 'গণতান্ত্রিক' একমেরু বিশ্বে চিরস্থায়ী শান্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, আজ তাঁরা কোথায় মুখ লুকিয়েছেন তা জানা নেই। তবে গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা এই ধ্রুপদী কথাটিকেই বারবার প্রমাণ করেছে যে সাম্রাজ্যবাদ ও সমরবাদ অবিচ্ছেদ্য। এ বছর জুনে হল্যান্ডের হেগে অনুষ্ঠিত ন্যাটো সামরিক জোটের শীর্ষ সম্মেলন এই বিষয়টিকে জোরালোভাবে তুলে ধরেছে। সম্মেলনে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো তাদের মোট জিডিপি’র ৫% পর্যন্ত প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা নজিরবিহীন। মার্কিন রাষ্ট্রপতির অনুরোধেই নাকি এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে মার্কিন কংগ্রেস দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সামরিক বাজেট পাশ করেছে, যা এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি, এবং ট্রাম্প তাতে স্বাক্ষর করেছেন। ফলে ট্রাম্প ন্যাটো দেশগুলোর কাছে এমন একটি আবদার করবেন, তাতে আশ্চর্য কী? এতে কারা জয়ী হচ্ছে? একমাত্র যুদ্ধাস্ত্র ব্যবসায়ীরা, মৃত্যুর কারবারিরা, আর বাকি সবারই অসহায় পরাজয়। যারা পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পুর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর 'সমুখে শান্তি পারাবার' বলেছিলেন, তারা এখন কী বলবেন? কীই বা বলার থাকতে পারে?
সোজা কথায়, দেশে দেশে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য উন্নত জীবন, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, সর্বসাধারণের জন্যে গুণমানসম্পন্ন শিক্ষা, সম্মানজনক বেতন ও অবসরকালীন এবং অন্যান্য কল্যাণমূলক খাতে এই বিপুল সম্পদ ব্যয় না করে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ ও একচেটিয়া মুনাফার জন্য যুদ্ধ ও হত্যায় ‘বিনিয়োগ’ করা হচ্ছে। ১ সেপ্টেম্বরের সমাবেশ আমাদের এ বিষয়ে সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার দিন।
আজকের বাস্তবতা হলো, বিশ্বজুড়ে সামরিক ব্যয় বাড়ছে, বিশেষ করে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে তা দুই অঙ্কের শতাংশে পৌঁছেছে। বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয়ের প্রায় ৭৫% খরচ করে মাত্র ১৫টি দেশ, যার পরিমাণ ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এই ক্রমবর্ধমান সামরিকীকরণ সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলছে এবং একটি ব্যাপক ও বিস্তৃত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, যার পরিণতি অকল্পনীয়। তাই সমস্বরে বলা দরকার, ‘আমরা যুদ্ধকে ঘৃণা করি’। এটি কেবল একটি মন্ত্রোচ্চারণ নয়, বরং শেষ বিচারে সাম্রাজ্যবাদ নামক অমানবিক বিধ্বংসী লুটেরা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের মানব প্রজাতি হিসাবে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
আমরা লুটেরা শব্দটি খুব সচেতনভাবে ব্যবহার করছি। কে বাঘ আর কে ফেউ, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে এটা পরিষ্কার যে সাম্রাজ্যবাদের বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামরিক কৌশল ও প্রবণতা সরাসরি আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। যে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি নয়া উদারবাদের নামে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক জরুরি ক্ষেত্রগুলিতে বেপরোয়াভাবে অবাধ হস্তক্ষেপের সুযোগ করে নিচ্ছে, তা আজকের বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য।
আপস নয় প্রতিরোধ
আন্তর্জাতিক স্তরে এবারের ১ সেপ্টেম্বরের দীর্ঘমেয়াদি ও আশু দাবি ও বক্তব্যগুলি খুব স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেছে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব ট্রেড ইউনিয়নস (বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন) বা ডব্লিউএফটিইউ-র ঘোষণাপত্রে। চাই— প্রথমত, বিশ্বজুড়ে সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও হস্তক্ষেপের অবিলম্বে নিঃশর্ত অবসান। দ্বিতীয়ত, ন্যাটো এবং অন্যান্য সমস্ত সামরিক জোট ভেঙে দেওয়া এবং পারমাণবিক অস্ত্রের সম্পূর্ণ বিলোপ। তৃতীয়ত, ইউক্রেন, ইয়েমেন, সুদান এবং বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য সহ সব যুদ্ধমগ্ন অঞ্চলে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধের অবসান। প্যালেস্তাইনের জনগণের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের চলমান অবর্ণনীয় যুদ্ধাপরাধের ধিক্কার ও গণহত্যা, জাতিগত নিধন এবং যুদ্ধ কৌশল হিসাবে দুর্ভিক্ষকে ব্যবহারের জঘন্য কর্মকাণ্ডের অবসান এবং ৬০ হাজারেরও বেশি সাধারণ মানুষকে হত্যাকারী নেতানেয়াহু’র বিচার ও শাস্তি।
১ সেপ্টেম্বর লেবানন, সিরিয়া এবং ইরানের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের সশস্ত্র অভিযান ও আগ্রাসনের প্রতিবাদে বিশ্বব্যাপী তীব্র জনমত উচ্চারিত হবে। ১ সেপ্টেম্বর অতি অবশ্যই জোরের সঙ্গে বলা হবে প্যালেস্তাইনে , বিশেষত গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজরায়েলি ‘ঔপনিবেশিক’ দখলদারিত্ব ও বসতি স্থাপন বন্ধ করো, শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরার অধিকার নিশ্চিত করো এবং ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী স্বাধীন প্যা লেস্তাইন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি জানাও। ইজরায়েলের পাশাপাশি স্বাধীন, সার্বভৌম, দখলদারি-মুক্ত প্যা লেস্তাইন মাথা তুলে দাঁড়াক।
১ সেপ্টেম্বর সরবে বলতে হবে ইউক্রেন এবং রাশিয়াকে ধ্বংস করে চলা যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্রদের উসকানি বন্ধ হোক। এটা স্পষ্ট যে ট্রাম্পের কোনও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ইচ্ছা নেই, এবং যুক্তরাষ্ট্র এই দেশগুলোকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ট্রাম্প এখন আরও অস্ত্র পাঠাচ্ছেন। ১ সেপ্টেম্বরের দাবি, আলোচনার মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসানের এবং একই সঙ্গে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের ওপর থেকে আমেরিকা ও ন্যাটোর দখলদারিত্বের অবসান।
এমন কিছু সময় আসে যখন পরিচিত কথাগুলো বারবার উচ্চারণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সেটাই হবে এবারের ১ সেপ্টেম্বরে। আমরা প্রতিটি জাতির সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকারের প্রতি পূর্ণ সম্মান জানাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তাদের মিত্ররা চীন, কিউবা সহ বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে যে বর্জন, বৈষম্য, নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের পথ বেছে নিয়েছে, আমরা তার তীব্র নিন্দা করি। কারণ, এই ধরনের প্রতিটি পদক্ষেপ অগণিত সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সরাসরি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ অর্থনীতির কৌশলের বিরোধিতা করি। যুদ্ধ অর্থনীতির ব্যয় এবং অর্থনৈতিক যুদ্ধের প্রভাব যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে, তা অত্যন্ত স্পষ্ট। দেশে দেশে সাধারণ মানুষ এমনিতেই আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি এবং আনুষঙ্গিক জীবনযন্ত্রণায় জর্জরিত। অথচ বহুজাতিক সংস্থাগুলোর মুনাফা বৃদ্ধির জন্য পরিচালিত এসব যুদ্ধের মূল্য জীবন দিয়ে চোকাতে হচ্ছে তাদেরই।
বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের (WFTU) অবস্থান দৃঢ় এবং সুস্পষ্ট। সংগঠন বলছে , শ্রমিক এবং বিশ্বের সাধারণ মানুষের আন্তঃ-পুঁজিবাদী ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং একচেটিয়া মুনাফার লড়াই থেকে পাওয়ার বা আশা করার কিছুই নেই, কারণ এর ফল শুধু মৃত্যু, দারিদ্র আর দুর্ভোগ। তাই বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের আহ্বান— শ্রমিকদের অবশ্যই শ্রেণি-ভিত্তিক ইউনিয়নগুলোর সংগ্রামী উদাহরণ অনুসরণ করতে হবে এবং যেকোনও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। নিজেদের দেশের যেকোনও যুদ্ধে জড়ানোর বিরোধিতা করতে হবে, অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন, লোডিং ও পরিবহণের জন্য কাজ করতে অস্বীকার করতে হবে, এবং ইজরায়েলি দখলদারিত্ব বা অন্যান্য সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত যেকোনও সহযোগিতা বা সুবিধা দেওয়াকে বয়কট করতে হবে।
পিছু হটার দিন শেষ
এই দুঃসময়ে আমাদের দেশের অবস্থা দেখে লজ্জা লাগে। এককালের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অগ্রদূত ভারতে আজকের মোদী সরকার এই সমস্ত বিষয়ে কোনও দৃঢ় অবস্থান নিতে পারেনি। ইজরায়েলের গাজায় গণহত্যা এবং ইরানের ওপর সম্পূর্ণ অবৈধ বোমাবর্ষণের বিষয়ে কূটনৈতিক স্তরে বা সরকারি ঘোষণায় 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' গোছের বিবৃতি দিলেও, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিজেপি ও তার মূল কেন্দ্র আরএসএস নিজেদের জায়নবাদী শক্তির অনুকূলে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবেই পরিচয় দিতে পছন্দ করে। কলঙ্কজনক হলেও এটাই বাস্তব।
ইরানের বিষয়টাই ধরুন। এটা এখন দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার যে ইজরায়েলের সাম্প্রতিক সম্পূর্ণ অবৈধ ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণের সঙ্গে ইরানের তথাকথিত পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির কোনও সম্পর্ক নেই। এমনকি পারমাণবিক বিদ্যুৎ বা পারমাণবিক চিকিৎসা সংক্রান্ত বৈধ উন্নয়নেরও কোনও যোগসূত্র নেই। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা অনেকেই একমত যে ইজরায়েলের এই প্রক্সি আক্রমণের মূল কারণ হলো মার্কিন শাসকশ্রেণির দীর্ঘদিনের লক্ষ্য— ইরানের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারকে উৎখাত করে এমন একটি শক্তিকে ক্ষমতায় বসানো, যে মার্কিন শাসকশ্রেণির সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতির চাহিদা পূরণ করবে। যখন এমনটা ঘটছে, তখন ইরানের সঙ্গে ভারতের এতদিনের কূটনৈতিক সুসম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ভারত কি কোনও দৃঢ় প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারল? না, পারল না, পারছে না– এটাই বাস্তব।
এটিও বাস্তব যে মোদী সরকার গত মাস পর্যন্ত বহুক্ষেত্রে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কৌশলগত অংশীদার হয়েই নিজের বিদেশনীতি চালিয়েছে। ২০১৯ সালে মার্কিন মুলুকে ‘হাউডি মোদী’ সভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ‘অব কি বার ট্রাম্প সরকার’ স্লোগান দিতে দেখেছি আমরা। দেশের মাটিতে 'নমস্তে ট্রাম্প' শুনতে হয়েছে। এই ধরনের চটকদারি চাটুকারিতার বিষয় ছাড়াও, প্রতিবেশী চীনের প্রশ্নে দেশে অনমনীয় বৈরী মনোভাব নেওয়া থেকে শুরু করে ইজরায়েলের সঙ্গে গভীর সখ্যভাব ফুটিয়ে তোলা পর্যন্ত দেশের কূটনীতিকে নিখুঁত মার্কিনঘেঁষা করে তোলা হয়েছে। বিজেপি প্রকাশ্যে আমেরিকার পুঁজিবাদী স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতের সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে তাই নয়, এর ফলে দেশের শ্রমিক শ্রেণি, বিশেষত নিম্নবিত্ত কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আজ হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের আসল রূপ; তুমি যতই পা ধরো, সে তোমার মাথায় পা তুলে দিতেও দ্বিধা করবে না, যদি তার প্রয়োজন হয়। পরিস্থিতি এমন যে, ভারত-পাকিস্তান সংঘাত বাধলে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে থামাতে হচ্ছে, যেন তিনি বড় দাদা হিসাবে দুই ভাইকে শাসন করছেন। স্বাধীনতার ৭৮ বছরে এমন দৃশ্য আগে কি কেউ দেখেছে? আজ পর্যন্ত এ দেশের প্রধানমন্ত্রী বলতে সাহস হলো না, ট্রাম্প যা বলছেন তা মিথ্যে।
এখন তথাকথিত ‘ভারতবন্ধু’ ট্রাম্পসাহেব সম্পূর্ণ একতরফাভাবে কোনও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০% কড়া শুল্ক চাপিয়ে দিয়েছেন, যার মধ্যে কাজু, সামুদ্রিক খাবার, প্রক্রিয়াজাত সামুদ্রিক পণ্য এবং মশলা অন্তর্ভুক্ত। এর ভঙ্গিটা পুরোদস্তুর মাফিয়ার মতো। এই বেপরোয়া শুল্ক পোশাক শিল্প, চামড়া, ওষুধ এবং গয়না রপ্তানি সহ অন্যান্য ক্ষেত্রকেও বিরাট ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। গোটা দেশের রপ্তানিক্ষেত্র এবং তার সঙ্গে যুক্ত অযুত শ্রমিক কর্মচারী এক অজানা সঙ্কটের মুখোমুখি।
কী বলল ট্রাম্প প্রশাসন? ভারত রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করায় ওরা নাকি ভারতকে শাস্তি দিচ্ছে। এই বাণিজ্য নাকি রাশিয়াকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর জন্য অর্থ জোগান দিচ্ছে। তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো নিজেই রাশিয়া থেকে ইউরেনিয়াম এবং সার আমদানি করে। তার বেলা? ট্রাম্প ঠিক করে দেবেন আমরা কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করব এবং আমাদের বৈদেশিক সম্পর্ক কেমন হবে? আসল কথা হলো হাঁটু মুড়ে বসলেও হেঁট মুণ্ড উর্ধ্বপদ করে টাঙিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না, সাম্রাজ্যবাদের ভৃত্যবৃত্তির বিপদ এটাই ।
শুধু ভারত নয়। ট্রাম্পের নেতৃত্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই বেপরোয়া শুল্কযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী আর্থিক ও বাণিজ্যিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করেছে । লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই এই বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) হিরন্ময় নীরবতা ? আমরা কেউ নিশ্চিত নই, সাম্রাজ্যবাদ আজকে যেভাবে বাণিজ্য শুল্ককে অস্ত্র করেছে, কাল তার এই রণকৌশল লগ্নির ক্ষেত্রে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রসারিত হবে কি না। হলে কী হবে আন্দাজ করছেন নিশ্চয়ই!
অতএব সময় এসেছে মার্কিন একনায়কতন্ত্র, অর্থনৈতিক চাপ এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বিশ্বময়তা গড়ে তোলার। সময় এসেছে আঞ্চলিক মৈত্রীবন্ধন শক্তিশালী করে মার্কিন বাণিজ্য হামলার বিযুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। এই সংগ্রামে আমাদের দেশের সরকারকে অবশ্যই দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং দেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। ভারতবাসী দাবি, ভারত সরকার তার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করবে এবং মার্কিন দাদাগিরির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে।
পশ্চিমবাংলা এবং মহানগরী কলকাতার সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও, এই মুহূর্তে যারা সরকার চালাচ্ছে তারা সাম্রাজ্যবাদের এবং অবশ্যই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদ না জানিয়ে নীরব থাকাকেই শ্রেষ্ঠপন্থা মনে করে। তাদের বাধ্যবাধকতা নিয়ে ভিন্ন পরিসরে আলোচনা হবে। আসন্ন ১ সেপ্টেম্বরের মহাসমাবেশে আপনার আমার সক্রিয় সচেতন উপস্থিতি আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধের বলিষ্ঠ প্রত্যয় সুনিশ্চিত করুক।
Comments :0