ভবতোষ ভট্টাচার্য: ফালাকাটা
কেন্দ্র এবং রাজ্য, দুই সরকারের যাঁতাকলে পড়ে ভয়াবহ বিপদের মধ্যে রয়েছেন মানুষ। বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে ফায়দা লুটতে চাইছে। মানুষের ঐক্যবব্ধ আন্দোলন-সংগ্রামের কাছে কেন্দ্র ও রাজ্যের এই দুই শক্তিকে মাথা নত করাতেই হবে। শনিবার সিপিআই(এম) আলিপুরদুয়ার জেলার চতুর্থ সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশে একথা বলেন সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী।
সম্মেলন উপলক্ষে ফালাকাটা বেসিক জুনিয়র স্কুল ময়দানে এদিন প্রকাশ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন সুজন চক্রবর্তী এবং পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জিয়াউল আলম। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পার্টির আলিপুরদুয়ার জেলা সম্পাদক কিশোর দাস। এদিনই সম্মেলনের প্রতিনিধি অধিবেশনের উদ্বোধন করে সুজন চক্রবর্তী বলেন, জীবন-জীবিকা, রুটিরুজি, অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের ভরসাস্থল হয়ে উঠতে হবে কমিউনিস্টদের। এর জন্য সিপিআই(এম) ও বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি করে ব্যাপকতম জনগণকে সমবেত করে আন্দোলন-সংগ্রাম তীব্র করে তুলতে হবে।
এদিন সকালে আলিপুরদুয়ারের ফালাকাটা কমিউনিটি হলে এই সম্মেলন শুরু হয়েছে। সম্মেলন স্থলের নামকরণ হয়েছে কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি নগর ও মঞ্চের নামকরণ হয়েছে কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মঞ্চ। এদিন বেলা ১১টায় সম্মেলনের শুরুতে রক্তপতাকা উত্তোলন করেন প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা নিতাইকৃষ্ণ পাল। এরপর শহীদবেদীতে নেতৃবৃন্দ মাল্যদান করেন।
প্রকাশ্য সমাবেশে জিয়াউল আলম বলেন, তৃণমূল সরকারের আমলে চা বাগানগুলিতে মজুরি বাড়েনি। চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এরাজ্যে ২৫০ টাকা। অথচ পশ্চিবঙ্গে ভাল উৎকৃষ্ট মানের চা হয়। অন্ধ্র প্রদেশ, কেরালায় উন্নত মানের চা উৎপাদন না হওয়া সত্ত্বেও সেখানে দৈনিক মজুরি ৪৫০ টাকা। তাই তাঁরা সেখানে চলে যাচ্ছেন। পঞ্চায়েতকে পুরো কাঙাল করে দিয়েছে এই সরকার। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বিকশিত এলাকা এই ফালাকাটা। এখানে কৃষকরাও শঙ্কিত তাঁদের উৎপাদিত ফসলের দাম নিয়ে। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও এরাজ্যে মমতা ব্যানার্জির সরকার মহিলাদের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আসলে এরা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। দিদির টিকি বাঁধা আছে মোহন ভাগবতের হাতে। এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে ব্যাপক অংশের মানুষকে সমবেত করে।
এদিন সুজন চক্রবর্তী বলেন, নানা বৈচিত্র ও জনজাতির সমাহার এই আলিপুরদুয়ার জেলা। এখানকার গরিব মানুষের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে সেই ঐতিহ্যকে তছনছ করতে চাইছে বিজেপি। একদিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে, অন্যদিকে মানুষের উপর অর্থনৈতিক আক্রমণ চালাচ্ছে বিজেপি সরকার। সংবিধানকে ওরা নস্যাৎ করতে চাইছে। আম্বেদকরকে হেয় করার মাধ্যমে ওরা দেশের ইতিহাসকেই ভুলিয়ে দিতে চাইছে। সেই জন্য দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কুক্ষিগত করতে উদ্যোগী হয়েছে বিজেপি’র মতাদর্শগত পথনির্দেশক আরএসএস।
চক্রবর্তী আরও বলেন, বিজেপি ও তৃণমূল একে অপরের পরিপূরক। তৃণমূল রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন সহ সমাজকেই পচিয়ে দিচ্ছে। অনৈতিকতা, মূল্যবোধহীনতাকে সমাজে বেশি করে প্রোথিত করতে চাইছে। তৃণমূলের সৌজন্যে আজ শিক্ষা ব্যবস্থাও তলানিতে। স্কুল আছে তো শিক্ষক নেই, আবার কোনও স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীই নেই। তাই স্কুল তুলে দাও। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে শিক্ষার যে বিস্তার ঘটেছিল, তাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তৃণমূল সরকার। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে সমবেত করে লড়াইকে প্রসারিত করতে হবে। সিপিআই(এম)-কে মানুষের পরম ভরসাস্থল হয়ে উঠতে হবে।
এদিনই সম্মেলনে প্রতিনিধি অধিবেশনে খসড়া রাজনৈতিক প্রতিবেদন ও আয়ব্যয়ের হিসাব পেশ করেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক কিশোর দাস। তিনি বলেন, রাজবংশী, মদেশিয়া, রাভা, মেচ, সাঁওতাল, টোটো, ওরাওঁ, ভুজেল থেকে শুরু করে গুরুঙ, শেরপা, দুপকা, ভুটিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন জনজাতির বাস আলিপুরদুয়ারে। আর এই বৈচিত্রকেই হাতিয়ার করে বিভিন্ন জনজাতির মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে জেলা জুড়ে বিস্তার লাভ করছে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি। কখনও ‘উত্তরবঙ্গ’ রাজ্যের নামে, কখনও ‘গ্রেটার কামতাপুরী’ রাজ্যের নামে এই বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে। তৃণমূল রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ‘কনভেয়ার বেল্ট’ হয়ে উঠেছে।
সম্মেলন পরিচালনা করছে বিদ্যুৎ গুন, আতিউল হক, আশা ছেত্রী, পিন্টু গাঙ্গুলি, বিকাশ মাহালিকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী। এদিনই খসড়া রাজনৈতিক প্রতিবেদনের উপর প্রতিনিধিরা আলোচনা শুরু করেছেন। মঞ্চে উপস্থিত রয়েছেন জিয়াউল আলম, অনন্ত রায়, অলকেশ দাস, সলিল আচার্য প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এদিন সমাবেশের শুরুতে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের ফালাকাটা শাখা নাটক পরিবেশন করে ‘এই চোপ’। এরপর আদিবাসী মহিলারা সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ ও প্রতিনিধিদের স্বাগত জানান ‘বৈতী’ নৃত্যের মাধ্যমে। রবিবারও সম্মেলন চলবে।
CPIM ALIPURDUAR DISTRICT CONFERENCE
বিভাজনের রাজনীতিকে পরাস্ত করার আহ্বান
×
Comments :0