মণ্ডা মিঠাই
মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ
কৃশানু ভট্টাচার্য্য
নতুনপাতা
সে একটা সময় ছিল। বাংলার গ্রামে গ্রামে তখন শুধুই হাহাকার। একদিকে কলেরা আর অন্যদিকে ম্যালেরিয়া। কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে মানুষ চরিত্রের পাশাপাশি এই দুই রোগ চরিত্রের উজ্জ্বল উপস্থিতি। ১৯১১ থেকে ১৯২১ র মধ্যে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে মোট জনসংখ্যা কমে গেল। কারণ ম্যালেরিয়া আর কলেরা। আর সেই সময় এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মাঠে নেমে পড়েছিলেন যে মানুষটি তার নাম ডাক্তার গোপাল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। জন্ম বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটি পৌরসভার অন্তর্গত সুখ চর গ্রামে। বাবা ছিলেন ডাক্তার নীলমাধব চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৮৯৬ তে এমবি পাস করার পরে গোপাল চন্দ্র যুক্ত হয়েছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার কাজে। সে সময় তিনি নোবেল পুরস্কার জয়ী চিকিৎসা বিজ্ঞানী লিওনা্ড রজার্স এর অন্যতম সহকারী । কালা জ্বরের পরজীবী কৃত্রিম উপায়ে তৈরীর কাজে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন রজার্স। তার গবেষণার অন্যতম প্রধান সহকারী ছিলেন গোপাল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। যদিও রজার্স সে কথা স্বীকার করেননি কোথাও। তবে এটাই ছিল সেসময়ের রেওয়াজ। নোবেল পুরস্কার জয়ী রোনাল্ড ট্রাস্ট যেমন স্বীকার করেননি তার সহকারী কিশোরী মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা।
শুধু রজার্স এর সহকারি নয়, ব্যক্তিগত উদ্যোগে অসংখ্য চিকিৎসা বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণার কাজে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আর সেই সময়ই তার নজরে এসেছিল ম্যালেরিয়া রোগ কিভাবে বাংলার হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। মানুষ তাকিয়ে আছে ব্রিটিশ সরকারের দিকে। সরকার প্রায় নীরব। বিভিন্ন সভা সমিতিতে গোপালচন্দ্র বলে চলেছেন ম্যালেরিয়া নিবারণ করতে গেলে সাধারন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সচেতনতা না বাড়াতে পারলে এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে না।
১৯১৮ সাল। পানিহাটির
ত্রাণনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি ঘরোয়া সভার মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠলো প্রথম ম্যালেরিয়া নিবারণীর সমবায় সমিতি - পানিহাটি এন্টি ম্যালেরিয়া কো-অপারেটিভ সোসাইটি। পাশে তার নিজের গ্রাম সুখ চরেও শুরু হল এই একই ধরনের সমিতির কাজ। সমিতির কাজ ছিল এলাকায় যেসব জায়গায় মশা জমতে পারে যে রকম জঙ্গল কিংবা জলা সেগুলিকে নিজেদের উদ্যোগে পরিষ্কার করা। কেরোসিন ছড়ানো। গ্রামের কোন লোকে ম্যালেরিয়া হলে তাকে রক্ত পরীক্ষার পর ওষুধ সরবরাহ করা। বাচ্চাদের মধ্যে নিয়মিত যকৃত পরীক্ষা করা। গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রকাশ্যেই বলেছিলেন এই ধরনের কাজ করে যদি আমরা কোন একটা গ্রামেও ম্যালেরিয়ার পরিমাণ কমাতে পারি তাহলে তর্কের জন্য কোন মানুষের সঙ্গে সময় নষ্ট করতে হবে না। হলেও তাই। ১৯১৮ সালে যেখানে সমিতির সংখ্যা ২ ১৯৩১ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ালো প্রায় তিন হাজারের উপরে। বাংলার এমন কোন জেলা ছিল না যেখানে এই ম্যালেরিয়া নিবারণের সমবায় সমিতির আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েনি। বাংলার বাইরে পাটনা কিংবা গোয়ালিয়রেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সেই যুগের বাংলার বহু বরেন্য মানুষ। এর মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ,আচার্য জগদীশচন্দ্র, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, আশুতোষ চৌধুরী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সি ভি রমন। মানুষকে সচেতন করবার জন্য ম্যাজিক লন্ঠন সহযোগে প্রচার, এমনকি বাংলার শত্রু নামে একটি প্রচারমূলক নাটকের অভিনয়ের মধ্য দিয়েও মানুষকে বোঝানো হলো দেশ থেকে ম্যালেরিয়া তাড়াতে গেলে দেশের মানুষকে সবার আগে স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের প্রচারের জন্য কেন্দ্রীয় ম্যালেরিয়া নিবারনী সমবায় সমিতির নিজস্ব বাংলা ও ইংরেজি দ্বিভাষিক পত্রিকা সোনার বাংলা প্রকাশিত হতে শুরু করলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত গোটা বাংলায় একটি অত্যন্ত সক্রিয় জনস্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল এই কেন্দ্রীয় ম্যালেরিয়া নিবারণী সমবায় সমিতি। আর এর কর্ণধার ছিলেন ডাক্তার গোপাল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
২০১৫ সালে তার নিজের গ্রাম সুখচরে তাঁর নামাঙ্কিত রাস্তার উপরেই সম্ভবত ভারতবর্ষে এখনো পর্যন্ত সক্রিয় একটি মাত্র ম্যালেরিয়া নিবারণ সমিতি সুখচর এন্টিম্যালেরিয়া কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড এর পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁর আবেক্ষ মূর্তি। এখনো ১৬ই অক্টোবর তার প্রয়াণ দিবসে আলোচনা এবং স্মৃতিচারণ এর মধ্যে দিয়ে। এই শতবর্ষ অতিক্রান্ত জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার গ্রামবাসীরা। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার এই সামগ্রিক কাজের মূল্যায়ন সমৃদ্ধ একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ।
আজকের দিনে হয়তো সরাসরি এই জাতীয় আন্দোলনের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই কিন্তু স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রসারের প্রয়োজনীয়তা এখনো পর্যন্ত মেটেনি। আর সেই কারণেই গোপাল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মত মানুষদের আমাদের মনে রাখতে হবে।
Comments :0