স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গের বুকে সর্ববৃহৎ নিয়োগ দুর্নীতিতে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর পারিবারিক সংস্থার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করল আদালত। যা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেনজির।
নিয়োগ দুর্নীতির টাকা ঘুরপথে এবং সরাসরি ঢুকেছে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে। ইডি’র চার্জশিটেও তা দাবি করা হয়েছিল। তার ভিত্তিতে তথ্য,প্রমাণের সাপেক্ষে মঙ্গলবার বিচারভবনে প্রাথমিকে নিয়োগ দূর্নীতির মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস সহ ২২টি সংস্থার বিরুদ্ধে চার্জ ফ্রেম করা হয়।বিচারক জানান, যা তথ্য প্রমান রয়েছে তা চার্জ গঠনের পক্ষে যথেষ্ঠ। যদিও বাকি অভিযুক্তের মতো লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসও নিজেদের ‘নির্দোষ’ বলে দাবি করে এজলাসে।
এরাজ্যের বুকে হাজার হাজার যোগ্য, মেধাবীদের বঞ্চিত করে বিপুল টাকার বিনিময়ে সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার যে চক্র সেই দুর্নীতিতে খোদ লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন রীতিমত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা,লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেডের সিইও এখনও তৃণমূল সাংসদ, দলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জি! আদালতেও সেই তথ্যের স্বপক্ষে প্রমান জমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
অভিষেক ব্যানার্জি ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দাখিল করা হলফনামায় যদিও লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের কোনও প্রসঙ্গই উল্লেখ নেই। একটি সংস্থার সিইও, তাহলে সেটি হলফনামায় কেন চেপে গেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি? নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামায় পরিকল্পিতভাবেই কী লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের প্রসঙ্গ এড়িয়েছেন কালীঘাটের কাকুর এই ‘সাহেব’? এমনকি ২০১৯’র লোকসভা নির্বাচনের হলফনামায় অভিষেক ব্যানার্জি তাঁর পেশার কলমে উল্লেখ করেছেন- ‘স্যালারিড’ অর্থাৎ বেতনভূক! যদিও কোথা থেকে বেতন পান তার উল্লেখ নেই।
অভিষেক ব্যানার্জির ব্রেনচাইল্ড সংস্থা ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’। দুটি সংস্থা। একটি হলো- ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’। দ্বিতীয়টি হলো- ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস এলএলপি’। দুটি সংস্থার ঠিকানাও একই- ব্লক পি, পি-৭৩৩, নিউ আলিপুর, কলকাতা-৭০০০৫৩। দুটি সংস্থাতেই বর্তমানে ডিরেক্টর দুজন- লতা ব্যানার্জি(অভিষেক ব্যানার্জির মা), অমিত ব্যানার্জি( অভিষেক ব্যানার্জির বাবা)। এই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের আগের ঠিকানা ছিল খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের ঠিকানা অর্থাৎ ৩০/বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট। শুধু তাই নয় ২০১২ সালে কোম্পানির প্রথম ডিরেক্টর হিসাবে অভিষেক ব্যানার্জি, তাঁর মা লতা ব্যানার্জি এমনকি পরবর্তীতে তাঁর স্রীসাও মুখ্যমন্রী-্র বাসভবনকেই কোম্পানির ঠিকানা হিসাবে দেখিয়েছিল। আপাদমস্তক পারিবারিক এই সংস্থাতেই ঢুকেছিল যোগ, মেধাবীদের স্বপ্নকে বিক্রি করার দুর্নীতির অবৈধ টাকা।
কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসে গত বছরের জানুয়ারিতে রিপোর্ট পেশ করে ইডি জানিয়েছিল এই কোম্পানির আটটি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তার মূল্য সাড়ে সাত কোটি টাকা। নিয়োগ দুর্নীতির টাকার সঙ্গে সরাসরি যোগ আছে এই সংস্থার।’। আদালত প্রশ্ন তোলে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস কীসের ব্যবসা করে? সংস্থায় আয় হয় কোথা থেকে ? আদালতের নির্দেশ ঠেকাতে বিস্তর আইনী লড়াইও চালিয়েছেন অভিষেক ব্যানার্জি। আদালতে অভিষেক ব্যানার্জিকে সাড়ে পাঁচ হাজার পাতার নথি জমা দিতে হয়েছিল।
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় পঞ্চম অতিরিক্ত (সাপ্লিমেন্টারি) চার্জশিটে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসকে ‘অভিযুক্ত’ হিসাবে দেখানো হয়েছে। কোনও ব্যবসা ছাড়াই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা জমা পড়েছে। ইডি চার্জশিটে দাবি করেছে, ব্যবসা হয়েছে শুধু কাগজে কলমে। তার মাধ্যমেই একটি সাইকেল সংস্থা সহ চারটি সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে কোটি কোটি টাকা। এই সংস্থাগুলির সঙ্গে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের বৈদ্যুতিক কেটলি, চশমা এবং কার্ডের ব্যবসা হয়েছে বলে ‘ইনভয়েস’ দেখানো হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থার দাবি আদৌ কোনও জিনিসপত্রই কেনাবেচা হয়নি দু’পক্ষের মধ্যে। এমনকি কোন কোন সংস্থা থেকে কত টাকা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে তাও চার্জশিটে জানানো হয়েছে। ওই চারটি সংস্থা থেকে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের অ্যাকাউন্টে মোট ২ কোটি ৮৩ লক্ষ ২৬ হাজার ৪৩৫ টাকা জমা পড়েছিল।
শুধু তাই নয় এর আগে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে কালীঘাটের কাকুর বিরুদ্ধে দেওয়া চার্জশিটেও অভিষেক ব্যানার্জির এই সংস্থার উল্লেখ ছিল। ইডি’র দাবি, মান লন্ডারিংয়ের তদন্তে দেখা গেছে ঘুরপথে অভিষেক ঘনিষ্ঠ কালীঘাটের কাকুর সংস্থা এসডি কনসালটেন্সির মাধ্যমেই ২০২০সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২১’র জানুয়ারি পর্যন্ত তিন দফায় মোট ৯৫লক্ষ টাকা ঢুকেছিল লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে। ঘুরপথে অভিষেক ঘনিষ্ঠ কালীঘাটের কাকুর সংস্থা এসডি কনসালটেন্সির মাধ্যমেই চাকরি বেচার টাকা ঢুকেছিল লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে। নিয়োগ দুর্নীতির টাকা খেটেছে রিয়েলে এস্টেটে, সিন্ডিকেটের কারবারেও। তারপর সেখান থেকে মুনাফার টাকা সরাসরি সুজয় ভদ্রের সংস্থার মাধ্যমে ঢুকে পড়ে অভিষেক ব্যানার্জির পারিবারিক সংস্থায়!
মঙ্গলবারই শেষ হয়েছে এই মামলার চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া। সোমবার সোমবার পার্থ চ্যাটার্জি, কালীঘাটের কাকু, তৃণমূলী বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য সহ ৬ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় চার্জ গঠন সম্পন্ন হয়েছিল। মঙ্গলবার বাকি ৪৭জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। ২২টি সংস্থা সহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে পাঁচ দফায় চার্জশিটে দিয়েছিল ইডি। আদালতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পেশ করেছে তদন্তকারী সংস্থা। তার ভিত্তিতেই টাকা তছরুপ প্রতিরোধ আইন (পিএমএলএ)’র নির্দিষ্ট ধারায় চার্জ গঠন করা হয়েছে। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ রয়েছে, পৃথক ভাবে তা পড়েও শুনিয়েছেন বিচারক। তাঁরা দোষী না নির্দোষ, তা-ও শুনতে চাওয়া হয়েছে। চার্জ গঠন শেষে ইডি’কে সাক্ষীদের তালিকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। আগামী ১৪, ২০ ও ২৭ জানুয়ারি রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার পর্বে তাঁদের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হবে।
মঙ্গলবার অর্পিতা মুখোপাধ্যায়, তাপস মণ্ডল, কুন্তল ঘোষ, পার্থর জামাই কল্যাণময় ভট্টাচার্য সহ ৪৭ জনের বিরুদ্ধে চার্হ গঠন হয়। শুনানির সময় এদিন যুব তৃণমূলের তৎকালীন রাজ্যনেতা, নিয়োগ দুর্নীতির অন্যতম এজেন্ট কুন্তল ঘোষ প্রতিহিংসার রাজনীতি করা হচ্ছে বলে দাবি করে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ফাঁসানো হচ্ছে। তাকে থামিয়ে দেন বিচারক। বলেন, ‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনা নিয়ে ধর্মতলায় গিয়ে বলুন, এখানে নয়।’
Ssc Scam
নিয়োগ দুর্নীতিতে ২২টি সংস্থা সহ ৫৪জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন
×
Comments :0