নীলাদ্রি সেন
ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার বেসরকারিকরণের সরকারি উদ্যোগ আমাদের দেশে নতুন কোনও ঘটনা নয়। নব্বইয়ের দশকে উদারীকরণ পর্ব শুরু হতেই এর সূচনা ঘটে। কখনো তা পিছোতে বাধ্য হয়েছে মূলত বামপন্থীদের সম্মিলিত প্রতিরোধে। এখন মোদী সরকারের জমানাতে মসৃণ হয়েছে সরকারের এই ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের কাজ। সংসদে বামপন্থীদের শক্তি এখন অত্যন্ত সীমিত। সেই সুযোগে বছর শেষে সংসদের শীত অধিবেশনে ধ্বনিভোটে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ বিল। যার পোশাকি নাম ‘ব্যাঙ্কিং কোম্পানিস (অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ট্রান্সফার অব আন্ডারটেকিং) অ্যাক্ট ১৯৭০ এবং ১৯৮০’। এই বিলে যে ১৯ টি সংশোধনী আনা হয়েছে তার মধ্যেই বিভিন্ন ধাপে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের ৪টি সংশোধনী জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই সংশোধনীতে ব্যাঙ্কে সরকারি অংশীদারিত্ব ৫১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। ফলে এখন থেকে আর ব্যাঙ্কের মালিকানা বদলে কোনও আইনি বাধা থাকছে না।
ভারতের সব সরকারি ব্যাঙ্ক এখন লাভজনক অবস্থায় রয়েছে। তাদের দারুণ অগ্রগতি ঘটেছে। ২০২৪-২০২৫ অর্থাৎ চলতি অর্থবর্ষে তারা লাভ করেছে ১.৪১ লক্ষ কোটি টাকা। সংসদে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের বিল পাশ করিয়ে একথা স্বীকার করে নিয়েছেন খোদ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তবু বেসরকারিকরণের পথ থেকে সরবে না তাদের সরকার। কারণ এটাই মোদীজিদের অঙ্গীকার লগ্নিপুঁজির কাছে। যে লগ্নিপুঁজির নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত কর্পোরেট অবাধে লুট করছে দেশের জাতীয় সম্পদকে সরকারি তত্ত্বাবধানে। আর নীতিগতভাবে মোদী সরকার দেশের জাতীয় সম্পদ বিক্রির অংশ হিসাবেই হাত দিয়েছে ব্যাঙ্ককে বেসরকারি মালিকানায় তুলে দেবার কাজে।
সামান্য অতীতে ফিরে তাকালে দেখা যায় যে, ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে যে কেন্দ্রীয় বাজেট মোদীজিরা পেশ করেন তাতে দেশের সরকারি সংস্থাগুলোর ঢালাও বিলগ্নিকরণের উদ্দেশ্যে ‘রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নীতি’ ঘোষণা করা হয়েছিল। এই নীতিতে দেশের স্ট্রাটেজিক ক্ষেত্র ছাড়া বাকি সব সরকারি সংস্থাকেই বেসরকারি মালিকানাতে তুলে দেবার কথা বলা হয়েছে। সরকারি সমীক্ষা অনুসারে তখন দেশে মোট রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সংখ্যা ছিল ৩৪৮টি। এরমধ্যে চালু থাকা সংস্থার সংখ্যা ছিল ২৪৯ টি। সরকারি সমীক্ষাতে প্রকাশ এর বেশির ভাগটাই লাভজনক। মোদী সরকারের এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নীতিতে মোট চারটি সরকারি সংস্থাকে স্ট্রাটেজিক তালিকাভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো যথাক্রমে পরমাণু বিদ্যুৎ, প্রতিরক্ষার যন্ত্রাংশ, যানবাহন ও টেলিকম পরিষেবা এবং খনিগুলোর ক্ষেত্রে পেট্রোলিয়োম, বিদ্যুৎ এবং কয়লা। স্ট্রাটেজিক তালিকায় থাকা এই চারটি সরকারি সংস্থার অধীন অফিস-কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় সারা দেশে চালু ২৪৯ টি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির মধ্যে সাকুল্যে ২৫টি। বাকি সবই নির্বিচারে বেসরকারি কর্পোরেটের অবাধ লুণ্ঠনের জন্য খুলে দেওয়োর ইঙ্গিত দেওয়া হয়। স্ট্রাটেজিক ক্ষেত্রগুলোর এই তালিকাতে কোথাও সরকারি ব্যাঙ্কগুলোকে রাখা হয়নি। অর্থাৎ জাতীয় সম্পদ বিক্রির তালিকাতে সেদিনই সুচতুরভাবে মোদী সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি ব্যাঙ্কগুলোকে যুক্ত করে দেওয়া হয়।
অবশ্য ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের মহড়া তার আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থাৎ আগের অর্থ বছর শুরুর দিন থেকেই। মোদী সরকারের তরফে এই সময় থেকেই ভারতে সরকারি ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণ (Merger and acquisition of Nationalised Banks in India) কার্যকর করা শুরু করে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের ঘোষণাকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিয়ে, এই সংযুক্তিকরণে যথাক্রমে এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের সঙ্গে ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক, সিন্ডিকেট ব্যাঙ্কের সঙ্গে কানাড়া ব্যাঙ্ক, অন্ধ্র ব্যাঙ্ক ও কর্পোরেশন ব্যাঙ্কের সঙ্গে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক এবং ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া এবং ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অব কমার্সকে মিশিয়ে দেওয়া হয় পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সঙ্গে। এছাড়া ব্যাঙ্ক অব বরোদার সঙ্গে বিজয়া ব্যাঙ্ক ও দেনা ব্যাঙ্ককে যুক্ত করে দেওয়া হয়। এইভাবে মোট ১৩টি সরকারি ব্যাঙ্কের সংখ্যাকে নামিয়ে আনা হয় মাত্র ৫টিতে। এছাড়া একই অর্থ বছরের বাজেট ভাষণে সীতারামণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ো (আইডিবিআই) এবং তারপর আরও দুটি ব্যাঙ্ককে বেসরকারিকরণ করবার ঘোষণা করেছিলেন।
সরকারি ব্যাঙ্কের এমন সংযুক্তিকরণ কি আগে হয়নি? এর উত্তরে বলা যায়, হ্যাঁ আগেও এমন ঘটনার নজির রয়েছে। তবে তার প্রকৃত কারণ ছিল সম্পূর্ণ অন্য। বেসরকারি মালিকানাধীন কিছু ব্যাঙ্ক অর্থ নয়ছয় ও তাদের কর্তৃপক্ষের সরকারি নিয়মভঙ্গের কারণে দুর্বল হয়ে পড়াতে তাদের সরকারি ব্যাঙ্কে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ বেসরকারি ব্যাঙ্কের দুর্বলতার ভার সেই সময় চাপিয়ে দেওয়া হয় সরকারি ব্যাঙ্কের ওপরে। মোদী সরকারের বক্তব্য হলো সরকারি ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমিয়ে আনাতে নাকি ব্যাঙ্ক বড় হবে ও ফেল করবে না। বড় হলে আন্তর্জাতিক স্তরে স্থান পাবে। শিল্পের চাহিদামতো বড় আকারে ঋণ দেওয়া যাবে। বড় হওয়াতে বাকি কাজের পরিধিও বড় হবে ইত্যাদি।
আসলে সবটাই মোদী সরকারের মিথ্যাচার। কিছু উদাহরণ নেওয়া যাক। ২০০৮ সালের দুনিয়োজোড়া আর্থিক মন্দায় বহু নামী ব্যাঙ্ক মুখ থুবড়ে পড়ে। শীর্ষ পুঁজিবাদি দেশ আমেরিকাতেই লেম্যান ব্রাদার্স, ওয়োশিংটন মিউচুয়াল, মেরিল লিঞ্চ-এর মতো বড় ব্যাঙ্কগুলো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। বিশ্বজুড়ে নামী ব্যাঙ্কগুলো একে একে বন্ধ হতে থাকে। লাখে লাখে কর্মী ছাঁটাই হয়। শুধুমাত্র সিটি গ্রুপ ব্যাঙ্কেই ছাঁটাই হন ৫২ হাজার। শেষে আমেরিকার বড় ব্যাঙ্কগুলোকে বাঁচাতে তখনকার বুশ প্রশাসনকে সরকারি কোষাগার ভেঙে ৭০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিতে হয়। অথচ এই দুনিয়াব্যাপী আর্থিক মন্দার মধ্যেও আমাদের দেশের অভিজ্ঞতাটা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। সেদিন ভারতের ছোট বা বড় একটিও ব্যাঙ্কের দরজাতে তালা পড়েনি। মাথায় হাত দিয়ে বসতে হয়নি কোনও আমানতকারীকে। কোনও ব্যাঙ্কে একটি ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেনি। আর সবচেয়ে বড় কথা আমেরিকার মতো ভারতকে সরকারি কোষাগার ভেঙে একটি পয়সাও ব্যাঙ্ক বাঁচাতে সহায়তা করতে হয়নি। কারণ এই সময়ে আমাদের দেশে বড় ব্যাঙ্কগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হতো।
আসলে লুটেরা পুঁজির দাস মোদী সরকার কর্পোরেটের পদতলে ভেট দিচ্ছে ব্যাঙ্কগুলোকে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রথম মোদী সরকারের সঙ্গে দেশের শীর্ষ বণিক সংস্থা কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়োন ইন্ডাস্ট্রিজের (সিআইআই) পক্ষ থেকে প্রাক বাজেট আলোচনাতে দাবি জানানো হয়, প্রথমত সরকারি ব্যাঙ্কগুলোতে সরকারি অংশীদারিত্ব ৩৩ শতাংশে নামিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত শুধুমাত্র স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়োতে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি সরকারি অংশীদারিত্ব রাখা। সরকারি অংশ ৩৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে সরকারি পদক্ষেপগুলো কী হবে সিআইআই মোদী সরকারকে সে বিষয়েও জানায়। অর্থাৎ ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণে মোদী সরকারই কর্পোরেটকে উৎসাহ দিয়ে চলেছে। ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ ঘটিয়ে ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমিয়ে আনা বিলগ্নীকরনের পথকে সুগম করবার জন্যই করা হয়েছে।
ব্যাঙ্ক বেসরকারিকনে কর্পোরেটের স্বার্থ কি? ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাপনার আওতায় থাকা মোট সম্পদের ৬০ শতাংশই এখন সরকারি ব্যাঙ্কগুলোতে গচ্ছিত। বেসরকারি মালিকানায় চলে গেলে এই সম্পদ সরকারের হেফাজত মুক্ত হয়ে তাদের কাছে চলে আসবে। অন্যদিকে সরকারি ব্যাঙ্কগুলো কর্পোরেটদের নেওয়ো পুঞ্জিভুত অনাদায়ী ঋণের সমস্যাতে জেরবার হয়ে যাচ্ছে। সরকারি ব্যাঙ্কগুলো থেকে অপেক্ষাকৃত কম সুদে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা মেটাতে অস্বীকার করছে কর্পোরেটরা। যাতে ব্যাঙ্কগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। আর্থিক সঙ্গতি থাকা সত্বেও যারা ঋণ শোধ করেনা তাদের ব্যাঙ্কের পরিভাষাতে বলা হয় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি (Wilful defaulter)। আর মোদী সরকার এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবার পরিবর্তে বছর বছর বড় অংশের ঋণ মকুব করে চলেছে। এইভাবে ঋণখেলাপি হীরে কারবারি মেহুল চোকসি সহ সর্বোচ্চ ৫০ টি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সংস্থার ৬৮ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা ঋণ মকুব করে দেওয়া হয়েছে, খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক একটি তথ্য জানার আইনের প্রশ্নের উত্তরে একথা জানিয়েছে। এর মধ্যে কিং ফিসার কোম্পানির মালিক বিজয় মালিয়োর ১ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা, অ্যাগ্রো ইন্ডিয়োর মালিক সঞ্জয় ও সন্দীপ ঝুনঝুনওয়োলাদের ৪ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করা হয়েছে। এটা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। এছাড়াও অসংখ্য কর্পোরেট ঋণ মকুব করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের মদত দিয়ে চলেছে মোদী সরকার। ব্যাঙ্ক বেসরকারি মালিকানাতে গেলে এইসব ঋণখেলাপি কর্পোরেটদের আর কোনো ঋণই পরিশোধ করতে হবে না। এইরকম প্রায় ৩৬ জন সরকারের টাকা লোপাট করে বিদেশে পালিয়ে গেছে। তাই ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের জন্য কর্পোরেট মহল থেকে মোদী সরকারকে ক্রমাগত চাপে রাখা হচ্ছে। আর স্বার্থপুরণের জন্য ইলেকটোরাল বন্ডসহ বিভিন্ন উপায়ে শাসক বিজেপির তহবিলে ঢালা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার ভেট।
মোদী সরকার ২০১৪ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসবার আগে সরকারি ব্যাঙ্কের সংখ্যা ছিল ২৭টি। এখন সেটা কমিয়ে ১২টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। এখন বেসরকারিকরণের বিল সংসদে পাস হয়ে যাওয়োতে বেসরকারিকরণে আর কোনো আইনগত বাধা রইল না। সম্ভবত অতি দ্রুতই মোদী সরকারের পক্ষ থেকে ৫১ শতাংশের নিচে ব্যাঙ্কের সরকারি অংশীদারিত্ব নামিয়ে এনে, ক্রমশ শূণ্য করার লক্ষ্যমাত্রার দিকে এগিয়ে যাওয়ো শুরু হবে। সেইসঙ্গে সরকারি ব্যাঙ্ক গ্রাহকদের জন্য যে নিশ্চিত নিরাপত্তা দিত তা কর্পোরেট দস্যুদের মালিকানাতে লুটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে। ব্যাঙ্কের কর্মী আধিকারিক থেকে গ্রাহক তথা বৃহত্তম জনগোষ্ঠির ঐক্যবদ্ধ গণপ্রতিরোধ ছাড়া এই কর্পোরেট লুটের হাত থেকে ব্যাঙ্ককে বাঁচানো যাবে না।
Bank Privatisation
'গুডবাই' সরকারি ব্যাঙ্ক
×
Comments :0