গল্প
রুকু'র ভাবনা
ভবানীশংকর চক্রবর্তী
নতুনপাতা
আজ বাবা অফিস যায়নি। রুকু-রও ইস্কুল ছুটি। সারাদিন বাবার সাথে কাটল রুকু-র ।বাবা মাঝে মাঝে রাগলে রুকু-র বেশ ভালো লাগত।তবে বাবা আর সে দুজনেই বাড়ি থাকলে মা চ্যাঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে। মা-র অনুযোগ,বাবা-মেয়ের ফাইফরমাস খাটতে খাটতে তার সংসারের কাজকর্ম গুছিয়ে করে উঠতে পারে না।-আর বাবার আশকারায় রুকু নাকি লেখাপড়ায় আর সহবত শিক্ষায় একেবারে গোল্লায় যাচ্ছে। মা-র এসব কথা শুনে শুনে রুকুও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সে জানে সে পড়াশোনা করে। মা-র কথারও কখনও অবাধ্য হয় না।তবু মা বারবার এসব বলে যায় ।
ও,রুকুর পরিচয়টাই তো দেওয়া হয়নি এখনও। রুকু-র এখন ক্লাস ফোর ।গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়ে ।তার বাবা বংশী পঞ্চায়েত অফিসের পিয়োন ।সকাল দশটায় অফিসে যায় ।ফেরে সেই রাত্তিরে।পঞ্চায়েত বাবুদের মিটিং টিটিং থাকলে তো কথাই নেই। কোনো কোনোদিন রাত সাড়ে ন-টা দশটা বেজে যায় ।বাড়ি ফিরেও জজিয়তি। রুকু তখন ফরিয়াদি। বাবার কাছে তার নামে পাঁচকাহন। বাবা সব শোনে।তারপর ঠান্ডা মাথায় রুকুকে আদর করে আর বলে ' কাল থেকে মা-র সব কথা শুনবে । এখন যাও, বইখাতা গুছিয়ে রাখো।খেতে হবে তো এবার।' ওকালতিতে মা-র হার হয়।বেশ মজা হয় তার। আসলে রুকু বোঝে,মা তাকে খুব ভালোবাসে। তাই বকে বেশি। বাবাও তাকে ভালোবাসে খুব। তাই আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। ইস্কুলের রিমি,সুহা,কেকা,সোহম,
দীপেশ আর পাড়ার পিঙ্কি,সুমি,দীপিতা, তাপু, শুভ,কঙ্কণ _ এরা সব তার বন্ধু। তাদের সাথে খেলে, পড়ে, আড়ি করে, মজা করে ,বেশ হয়।
সারাদিন বাবার সাথে বাড়িতেই কাটল তার । সন্ধে হতেই বাবা বলল, 'বইখাতা নিয়ে এসো রুকু।আজ আমি তোমাকে পড়াব।' বাবার কথা শুনে খুব আনন্দ হয় রুকু-র। বাবা তো তাকে পড়াবার সময়ই পায় না। এরকম মাঝে মধ্যে বাবার কাছে পড়তে ভালোই লাগে তার। অঙ্কের খাতা খোলে রুকু। গতকাল হোমটাস্কের খাতায় অঙ্কগুলো কাটা। নতুন অঙ্কের স্যার সব কেটে দিয়েছে।
এই পাতাটা লুকাতে চাইল রুকু।বাবা বকুনি দিয়ে বলবে ''কিচ্ছু শিখিসনি অঙ্কের।এত কাঁচা তুই অঙ্কে!' মা এসে সাতকাহন শোনাবে। তখন!কিন্তু বাবার চোখ পড়ল সেই পাতাটায় ।' দেখি এত কাটাকাটি কেন?' বলেই বাবা খাতাটা হাতে নিল ।' আমি তো সব ঠিক করেছি। নতুন স্যার সব কেটে দিল।' কাঁদো কাঁদো গলায় বলল রুকু।অনেকক্ষণ ধরে দেখল বাবা।কিন্তু বাবা তাকে বকল না।খাতাটা বন্ধ করে বলল, 'অঙ্ক থাক।অন্য বই খোলো।'
তার মুখ গম্ভীর।থমথমে।বাবার এরকম মুখ দেখলে খুব ভয় হয়। এই তো মাসছয়েক আগে ঠাকুমা মারা যাবার দিন বাবার এই রকম মুখ দেখেছিল রুকু।তবে সে কি অঙ্কে সত্যিই খুব কাঁচা ! পাস করতে পারবে না অঙ্কে! চোখ ছলছল করে এল তার। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল রুকু। 'তুমি ইংরেজির হোম টাস্কটা করো।আমি আসছি।' ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বাবা।
মা ছিল রান্নাঘরে।বাবা গেল সেদিকেই। মৃদুকণ্ঠে কী যেন বলছে মাকে। কিচ্ছু জানে না,টাকা দিয়ে, চাকরি চুরি, হরির লুট, সব্বোনাশ হয়ে যাচ্ছে,কী করা যায়, এইরকম খাপছাড়া কিছু কথা কানে এল রুকু-র।সে বুঝে উঠতে পারল না ঠিক এসব হিজিবিজি কথার সঙ্গে তার অঙ্ক না -পারার কী সম্পর্ক! সে শুধু এইটুকু বুঝল, সে অঙ্কে খুব কাঁচা। ইংরেজি বই খুলে বসে রইল। একটি শব্দও পড়তে পারল না সে।খানিক পরে বাবা এল।গম্ভীর মুখেই বলল, 'তোর ভুল হয়নি মা।স্যারই ভুল করে কেটেছে।কাল আমি যাব ইস্কুলে খাতাটা নিয়ে।' রুকু ভাবনায় পড়ল।সে অঙ্কে কাঁচা কিনা সেটা নিয়ে নয়।বাবার গম্ভীর মুখ আর এইসব গোলমেলে কথাগুলো নিয়ে। এই গোলমেলে কথাগুলোই তার ভাবনাটাকে জট পাকিয়ে দিচ্ছিল।
Comments :0