কনীনিকা ঘোষ
সময় চলেছে তার নিজের গতিতে—বদলে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটা— আহ্নিকগতি আর বার্ষিকগতির আবর্তনে পৃথিবী এগোচ্ছে সামনের দিকে—বদলে যাচ্ছে দিনপঞ্জী—মাস-বছর-যুগ আর এ বদলানো সময়ের প্রবাহে প্রতিবছর নতুন করে আসে ৮ মার্চ। নতুনভাবে—নতুন করে আর আমরা যারা মেয়ে, বিশেষত সংগ্রাম-আন্দোলনে অংশ নেওয়া মহিলা, তাদের মনে ‘‘পুলক লাগে/চোখে ঘনায় ঘোর’ কারণ এ দিন মানে তো আমাদের কাছে শুধু কাঁচ চুড়ি, ঝুটো মুক্তার মালা অথবা ক্রিম এর বিজ্ঞাপনের দিন না অথবা একটি দিনের জন্য দেবী সাজিয়ে মেয়েদের ক্ষমতায়নের জন্য প্রথাগত উচ্চারণের দিন না। এদিন মানেই ‘‘প্রত্যহের বন্ধন হতে মুক্তি’’ আনার দিন—কৃষক আন্দোলনে অংশ নেওয়া যশপ্রীত কাউর পিঠে কেমিক্যালের মেশিন নিয়ে আরবান ক্ল্যাপ-এর মিঠু সেনগুপ্ত, প্রতিদিন সংকুচিত হতে থাকা ব্যাঙ্ককর্মী স্মিতা জোনস বা দিনের পর দিন শিক্ষকতার চাকরি না পেয়ে ধরনায় বসে থাকা নাসরিন বানু— সবার দিন, সকলের না বলা কথা বাগ্ময় হয়ে ওঠার দিন, প্রত্যেকের জীবনযাত্রার সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার দিন—এদিন আমাদের দিন—আমাদের সমস্ত মেয়েদের দিন, এদিন আন্দোলন-সংগ্রামের দ্যোতনায় চির উজ্জ্বল ৮ মার্চ—আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
সংগ্রামের পথ বেয়ে: তখনও যখন কার্ল মার্কস, ফেডরিক এঙ্গেলস জন্মাননি— ফরাসি বিপ্লব বা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, কিছুই হয়নি, হয়নি মর্গানের anecient society লেখা তখন, সেই তখন ১৭৭২ সালে মেরি উলস্টোন ক্রাফট তাঁর A Vindication of the Rights of Women : with Strictures on Political and Moral Subjects বইতে লেখেন কেন মহিলাদের বিভিন্ন দিক থেকেই প্রয়োজন অধিকার, আর তা না যদি তাঁরা পান, তা সমগ্র মানবতার জন্যই ক্ষতিকারক, তখনকার সে বই তার আখ্যান আজও আমাদের কাছে আলোর মশাল, তাই ৮ মার্চের সংগ্রামের কাহিনি বর্ণনা করতে সে বই-এর কথা এসেই যায় আর এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তো লড়াই।
১৮৫৭ সাল যখন আমাদের দেশ ‘‘হঠাৎ দেশে উঠলো আওয়াজ— হো হো হো হো / চমকে সবাই তাকিয়ে দেখে সিপাহী বিদ্রোহ’’—এই বিদ্রোহের পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যখন ঐ সময়েও ঝাঁসীরানি লক্ষ্মীবাঈয়ের মতো মহিলা নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঠিক তখনই অপর গোলার্ধে ১৮৫৭ সালে নিউ ইয়র্কের দর্জি মেয়েরা মজুরি বৃদ্ধি আর কাজের ঘণ্টা কমানোর দাবিতে উত্তাল আন্দোলন গড়ে তোলেন, যা সংগ্রামের বহমানতায় এক চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
১৮৬৪: মার্কস শ্রমিকশ্রেণির প্রথম আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে বললেন, শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম মহিলাদের বাদ দিয়ে কখনই হতে পারে না। মার্কসের হাত ধরেই মেয়েরা অর্জন করল অধিকার, ট্রেড ইউনিয়নের সভ্য হওয়ার অধিকার।
১৮৭১: চিরচিহ্ন রেখে গেছে যে লড়াই, প্যারি কমিউনের লড়াই, সে লড়াইতে মেয়েদের অংশগ্রহণ তাঁদের বীরত্বের প্রমাণ আমরা পাই। প্যারি কমিউনের মহিলা নেতৃত্ব নেথালি লেমেল বা লুই মিশেল— এঁরা ছিলেন অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাম। লুই মিশেলকে তো পরে দ্বীপান্তর দেওয়া হয় আর নেথালি লেমেলের বীরত্বপূর্ণ উচ্চারণ আজও আমাদের উদ্দীপিত করে। তিনি বলেছিলেন “We have come to the supreme moment, when we must be able to die for our Nation. No more weakness! No more uncertainty! All women to arms! All women to duty! Versailles must be wiped out!”—এই লড়াই মার্কসকেও মুগ্ধ করে। তিনি স্বীকৃতি দিলেন এ লড়াইকে, বললেন “In their stead the real women of paris showed again at the surface-heroic, nobel and devoted...... বললেন “The red partisan women came to the surface nobel and devoted the women of antiquity, The women of paris joyfully gave up their lives on the barricade and execution ground. প্যারি কমিউন স্থায়ী না হলেও এ লড়াই মেয়েদের বীরত্ব চিরচিহ্ন রেখে যায়। তাকে সাথে নিয়েই এগিয়েছে মেয়েদের সংগ্রাম।
১৮৮৯: প্যারি শহরে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলন মঞ্চে ক্লারা জেটকিনের অসাধারণ বক্তব্য, যাতে নারী-পুরুষ সমানাধিকারের কথা বিশ্ব শুনেছিল অবাক হয়ে আর মেয়েরা উপলব্ধি করেছিল এ দাবি করা যায়, মনের অন্তঃস্থলে লালিত যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত-নিপীড়িত মেয়েদের কথা উঠে এসেছিল এক লহমায় সামনে, তাঁরা এগিয়ে আসার সাহস পেয়েছিল। অন্য মেয়েরা, যাঁরা খানিক এগিয়ে থাকা, বুদ্ধিজীবি, মধ্যবিত্ত তাঁদেরকেও আলোড়িত করেছিল এ ভাবনা, শিল্পোন্নত দেশের শ্রমজীবী নারীরাও আগ্রহ বোধ করেছিলেন। সমস্ত অংশের মেয়েরা তাই এ দাবির পক্ষে সোচ্চার হলেন সংগ্রামে।
১৯০৭: জার্মানির স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন। সম্পাদক হন ক্লারা জেটকিন। সমাজতন্ত্রীরা ছাড়া মেয়েদের জন্য সত্যিকারের লড়াই কেই বা করেছে! সেই কবে এঙ্গেলস বলেছিলেন ‘‘পুরুষ কর্তৃক নারীর শোষণ প্রকৃতপক্ষে প্রথম শ্রেণি শোষণের দৃষ্টান্ত’’ আর সে পথ ধরেই তো চলেছে সমাজ, এ ব্যবস্থার প্রতিবাদে মেয়েদের সংগ্রাম তাই তো সমাজতন্ত্রীদের হাত ধরে আন্দোলনের অনির্বাণ শিখা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।
১৯০৮: ৮ মার্চ নিউ ইয়র্কের দর্জি মেয়েরা ঐতিহাসিক ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। লক্ষ লক্ষ মেয়েরা বিশাল মিছিলে সমবেত হন। তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে এগিয়ে চলে আন্দোলন, ভোটাধিকারের আন্দোলন, যা সেদিন ছিল স্বপ্ন— আজকের মেয়েদের ভোটাধিকার তো বিনা সংগ্রামে অর্জিত হয়নি, সে দিনকার এ সংগ্রাম ছিল তাই স্পর্ধার, সাহসের। চলতে থাকে দুর্দমনীয় জেদে লড়াই, এগিয়ে চলে মেয়েদের সংগ্রাম।
১৯০৯: ২৭ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্কের শ্রমজীবী মহিলাদের এক সভা ভোটাধিকারের দাবির পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে।
১৯১০: অন্তবিহীন পথে চলতে চলতে জীবনের কথা বলতেই ডেনমার্কের কোপেন হেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে রচিত হয় ইতিহাস— ক্লারা জেটকিন এবং আলেকজান্দ্রা কোলনতাই-এর প্রস্তাব গৃহীত হয়— তোমার আমার সব মেয়েদের ঠিকানা প্রোথিত করে দিতে স্থির হয় প্রতিবছর একটি দিন পালিত হবে পূর্ণবয়স্কা নারীর ভোটাধিকার হিসাবে— এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সাথে সাথে কারা যেন দু’হাতে খুলে দিল, ভেঙে দিল সমস্ত খিল—ভেঙে দিল প্রাচীর। বিশ্বের মেয়েদের এ দাবি নিয়ে অবারিত আন্দোলনের স্রোত আছড়ে পড়ল দেশে দেশে— মার্চ মাস—বনে ফাগুনের আর মনে আগুনের মাস পরিণত হলো অধিকারের মাসে। মার্চের নানান দিন, নানান দেশে পালিত হতে থাকল ‘‘নারী দিবস’’ হিসাবে আর এই খরস্রোতা সংগ্রামের গতি পথেই স্থির হয় ১৯০৮-এর ৮ মার্চ— যেদিন নিউ ইয়র্কের দর্জি শ্রমিক মেয়েরা ভোটাধিকারের দাবিতে তুফান তুলেছিল, সেই দিনটিকে চিরস্মরণীয় করে রারখতে ৮ মার্চ পালিত হবে মেয়েদের দিন হিসাবে, আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে। তারপর থেকে প্রতিবছর ৮ মার্চ মেয়েদের কাছে এক অনন্য দিন, সমানাধিকারকে বুঝে নেওয়ার দিন— এ সংগ্রামকে আরও আরও এগিয়ে নেওয়ার দিন।
সংগ্রামের বহমান স্রোতেই আমরা: ‘নারী দিবস’ শুধু একদিন, তাই প্রতীকী এদিনে নারীর জয়গাথা উচ্চারণ আর প্রকৃত অর্থে তাঁদের সেই শোষণ-বঞ্চনার জাঁতাকলে পিষে দেওয়া— এরকমভাবে যারা দেখে, তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম-আন্দোলনের বহমানতায় নারী দিবসের পরম্পরাকে প্রতিষ্ঠিত করার দৃপ্ততায় আমরা পথ চলি। আজও বিশ্বে—ভারতে মেয়েরাই তো সমস্ত প্রশ্নে আগে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। জায়নবাদী ইজরায়েল যখন গাজাকে ধ্বংস করতে উদ্যত, প্যালেস্তাইনে যখন একের পর এক আক্রমণ করছে তারা, তখন যে ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার মধ্যে ১৬ হাজারই তো নারী আর শিশু। তখন এ হিংসা, এ রক্তপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটি দিন তো ৮ মার্চ হবেই। যখন জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্বে হচ্ছে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যখন ধ্বংস হচ্ছে সবুজ— জীবন-জীবিকা হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত তখন তো পুঁজিবাদের এই জিঘাংসা তার জন্য দায়ী, তার সরাসরি আক্রমণে সবচেয়ে আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রান্তিক মানুষ তথা মহিলারা, তাহলে পরিবেশ রক্ষা করার দাবি তোলার দিন আর পরিবেশ ধ্বংস করেছে যে কর্পোরেট, যে পুঁজিবাদ, তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার দিন তো অবশ্যই ৮ মার্চ। ৮ মার্চ তাই আমাদের জীবনে, প্রতি পরতে পরতে।
আমাদের দেশে যখন জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ মহিলা বলে শুধুমাত্র ভোটের রাজনীতিতে তাকে টার্গেট করা হয় অথচ উজালা প্রকল্প আসলে এতটুকু উজ্জ্বলতা আনতে পারে না গরিব মহিলার জীবনে তখন তার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার দিনই তো ৮ মার্চ। ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’-কে বলা হয় ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্ট অথচ প্রকৃত অর্থে বাজেটে সে সম্বন্ধে একটি কথাও উচ্চারিত হয় না, আইসিডিএস প্রকল্প যা প্রান্তিক মা-শিশুর পুষ্টির জন্য এক অতি দরকারি প্রকল্প, ‘পরিবর্তনের প্রতিভূ’ বলেন ‘মোদী’ মেয়েদের অথচ ‘মোদী গ্যারান্টি’তে বাদ পড়ে যায় এ প্রকল্পের সমস্ত দাবি-দাওয়া, বরং ৩০০ কোটি টাকা কম বরাদ্দ হয় এ বাজেটে, তখন এনিয়ে প্রশ্ন তো তুলতেই হবে নারী দিবসে— ৮ মার্চে।
প্রতিদিন বাড়ছে নারী নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা। থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন বলছে ভারত মেয়েদের জন্য নিরাপদ না। হাথরস, উন্নাও শুধু না আজ রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশে একের পর এক ধর্ষিতা হচ্ছে মেয়েরা। BHU বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন ন্যক্করজনক ঘটনা ঘটে অথচ অভিযুক্ত বিজেপি আইটি সেলের কর্মী ভোট প্রচারে থাকায় গ্রেপ্তার করতে লেগে গেছে একমাস, ‘লাডলিবহিন’-দের কথা তখন মনে পড়ছে না মোদী-শাহর? মনে পড়েনি মণিপুরের আদিম বর্বরতার পর? মহিলা কুস্তিগীরদের হয়রানির পরও বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ সিং সারনের প্রতি কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার মুরোদ যখন বিজেপি’র হয় না তখন আমরা বুঝি মনুবাদ এ শাসকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, আর তা উপলব্ধি করেই এই মনুবাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার অন্যতম দিন অবশ্যই ৮ মার্চ।
Annual Gender Gap Report 2023-এ প্রকাশিত ভারত লিঙ্গ সমতার মাপকাঠিতে ১৪৬-এর মধ্যে ১২৭-তম স্থানে। এই ভারত এ চিত্র নিয়ে নাকি বিশ্বগুরু হবে! কর্মসংস্থান-বেকারিতে এক নিদারুণ চিত্র ভারতের। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষে বেকারি ছিল ৩.১০ কোটি আর এখন বেকারি ৪৮.২ কোটি তার ওপর এ শাসকের নীতিতে প্রতিদিন কেন্দ্রীভবন হচ্ছে পুঁজির তাই কমছে শ্রমিক, কমছে কাজের জায়গাও তাই বাড়ছে বেকারি। মার্কস বলেছিলেন, ‘‘Capital comes dipping from head to foot from every pore with blood and dirt’’(p172, capital vol 1) ভারত সর্বার্থে আজ একথা প্রমাণ করছে। কোভিড লক ডাউন বেকারিকে বাড়িয়েছে আর তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মেয়েরা। বেকারি তাদের মধ্যে বেড়েছে অনেক বেশি। তরুণ অংশের দিকে নাকি মোদীজীর নজর অথচ CMI প্রদত্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২৫-২৯ বছর যুবদের মধ্যে বেকারির হার ১১.৩ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে মহিলাদের মধ্যে বেকারির হার ১৯.৩৬ শতাংশ। বোঝাই যায় বৈষম্য আজও প্রবলভাবেই বিদ্যমান। সরকারি হিসাবে বলা হচ্ছে ৪.৮২ কোটি বেকার, Statistical juggliry যা আজ সরকার এর অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে তাতে তথ্য জানা খুবই দুস্কর, তবু বিভিন্ন ক্ষেত্র পরিমাপ করে বলা যায়, যাই বলা হোক না কেন আসলে বেকার ৭ কোটি অর্থাৎ প্রতি ১৮ জনে একজন। এক্ষেত্রেও যুক্ত আছে অস্থায়ী কাজ যার নেই কোনও স্থিতিশীলতা, নেই কোনও সামাজিক সুরক্ষা। মেয়েদের এ প্রশ্নে হাল আরও খারাপ। একই কাজে মজুরি কম, তার উপর আছে মজুরি বিহীন কাজের বোঝা। এই যখন প্রকৃত চিত্র তখন যে বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি মেয়েদের সম্বন্ধে বাক্সর্বস্বতার ফুলঝুরি ছিটিয়ে আসলে মনুবাদী নীতিতেই মেয়েদেরকে করে হীন থেকে হীনতর, তাদের মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলার দিন তো ৮ মার্চকে হতেই হবে।
এই প্রতিজ্ঞা এই লড়াইয়ের কসমেই দেশের ৮ মার্চের লড়াইয়ে মিশে যায় রাজ্যের মেয়েদের লড়াই। একদিকে প্রকল্পের বাগাড়ম্বর অথচ সবুজ সাথীর সাইকেল চাপবে কে? বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক স্কুল— ড্রপ আউটে প্রতিদিন বাড়ছে ছাত্রীর সংখ্যা। সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে মহিলাদের ভাতা বাড়ানোর জন্য কাঁসর ঘণ্টা বাজাচ্ছেন মাননীয়া কিন্তু অন্যান্য রাজ্যে এর থেকেও বেশি ভাতা চালু আছে তাই তাকে মনে রাখতে হবে এ কোনও বাড়তি দাক্ষিণ্য নয়, বরং মাথাপিছু দৈনিক আয় বামফ্রন্টের সময় যা জাতীয় অর্থনীতির চেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল তা জাতীয় গড়ের নিচে নেমে এসেছে। প্রতীচী ট্রাস্টের রিপোর্ট বলছে মহিলাদের জন্য রাজ্যে যে সামাজিক প্রকল্প, তাতে যাদের বেশি পাওয়ার কথা তারা পাচ্ছে না, এটা কী তাদের প্রতি বঞ্চনা নয়, তার কি উত্তর দেবেন মাননীয়া? কবিতা পড়বেন— বুলি আওড়াবেন বাজেটে কিন্তু কেমন করে এর বাস্তবতাকে অস্বীকার করবেন? কেমন করে চাপা দেবেন এ তথ্যকে সমাজে নেশার প্রাবল্য বাড়ানোর সরকারের প্রচেষ্টাকে অস্বীকার করা যায় না, কারণ গত ১২বছরে শুধুমাত্র মদ বিক্রিতে আয় বেড়েছে ৬৭৯%। আপনি জানেন না মাননীয়া মহিলা বিশেষত প্রান্তিক মহিলারা মদের নেশাকে তাদের সর্বনাশের অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করে? এরপরও ৮ মার্চে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কর্মসূচিতে আপনি বড় বড় ভাষণ দেবেন? আপনার লজ্জা লাগে না মাননীয়া! ‘কন্যাশ্রী’র ঢক্কানিনাদেও আজ ল্যানসেটের এ সমীক্ষাকে চাপা দেওয়া যাচ্ছে না যে রাজ্যে বেড়েছে বাল্য বিবাহের সংখ্যা, তথ্যকে যতই চেপে দেওয়ার চেষ্টা হোক তবু NCRB-র পরিসংখ্যান বলছে রাজ্য নারীর বিরুদ্ধে হিংসায় উপরের দিকে। ৮ থেকে ৮০ রাজ্যে আজ কোনও নারীই নিরাপদ নয়, সে তালিকায় আজ কারাগারও বাদ যাচ্ছে না। কারাগারে মহিলা কয়েদীদের অন্তসত্ত্বা হয়ে পড়ার খবর কি সরকারের ব্যর্থতার অন্যতম নজির নয়! এক্ষেত্রে বীভৎসতম সংযোজন সন্দেশখালি, যা সভ্য জগতে নজিরবিহীন। সন্দেশখালির ওই প্রতিবাদী মহিলাদের সাহসী লড়াইকে কুর্নিশ জানানোরই তো দিন ৮ মার্চ, আর সাথে শেখ শাহজাহানদের, উত্তর সর্দারদের, শিবু হাজরাদের লুটের রাজত্ব শেষ করার অঙ্গীকার গ্রহণ করার দিন ৮ মার্চ হবে না? সন্দেশখালির লড়াইয়ের জ্বলন্ত দীপশিখা তো সে প্রতিজ্ঞাই গ্রহণ করছে। তাই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও জলপাইগুড়ির শিক্ষিকা হতে পারত যে মহিলা তার হার না মানা লড়াইয়ের সাথেই মিশে যায় সন্দেশখালির প্রতিবাদী মহিলাদের লড়াইয়ের আখ্যান। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ভরিয়ে দিয়ে হিন্দরাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে সংবিধানকে পালটে দেওয়ার ফ্যাসিবাসী চেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই, কর্নাটকে হিজাব নিষিদ্ধ করার সাথে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার উপর আক্রমণের প্রতিবাদে লড়াই এর সাথেই তাই ৮ মার্চ উচ্চারিত হয় ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে একতাকে তুলে ধরার লড়াই। রাজ্যের দুর্নীতিকে পরাস্ত করার সংগ্রামের সাথেই ৮ মার্চে মিশে যায় মেয়েদের নিরাপত্তাকে, প্রকৃত অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই। সামনে লোকসভা নির্বাচনে যখন ধর্ম জাতের হানাহানিতে মানুষকে তার জীবন যন্ত্রণা ভোলাতে চেষ্টা করবে বিজেপি-আরএসএস অথবা ‘নিজের মেয়ে’-র বিজ্ঞাপনের আড়ালে রাজ্যে সমস্ত মেয়েরা নিরাপত্তার চিত্র হবে করুণ থেকে করুণতর তখন মাথা উঁচু করে নিজেদের সম্মানকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, শাসকের চোখে চোখ রেখে বিকল্পকে স্থাপন করার জন্য, তমসার ওপারে নবীনের সকালকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবারের ৮ মার্চ— তীব্র থেকে তীব্রতর লড়াইয়ের শপথ নেওয়ার দিন— মতাদর্শের ঝান্ডাকে আরও শক্ত করে ধরে জানকবুল লড়াইয়ের অঙ্গীকার গ্রহণের দিন— জীবনের জন্য ভালোবাসার জন্য লক্ষ কণ্ঠে গর্জে ওঠার দিন।
Comments :0