Biman Bose

অধিকার ফেরাতে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে নয়া বাংলার ইঙ্গিত

রাজ্য

গণউদ্যোগের পঞ্চায়েত এখন কয়েকজনের পকেট ভারী করার পঞ্চায়েতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মানুষ যেভাবে পঞ্চায়েত পুনরুদ্ধারে নেমেছেন তাতে আগামী দিনে নতুন বাংলার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সাক্ষাৎকারে জানালেন বামফ্রন্ট সভাপতি বিমান বসু। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রসূন ভট্টাচার্য।


------------
প্রশ্ন: আপনার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় গ্রামবাংলার অর্থনৈতিক রূপান্তরের কাজে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতকে কী ভূমিকা পালন করতে দেখেছেন? 
বিমান বসু: জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার ১৯৭৮ সালে এরাজ্যে তথা ভারতে প্রথম ত্রিস্তর পঞ্চায়েত গড়ে তোলে নির্বাচনের মাধ্যমে। তার আগে, অন্য রাজ্যেও দ্বিস্তর পঞ্চায়েত ছিল, একটা স্তরে মনোনীত সদস্য ছিল। এখানে প্রথম থেকেই লক্ষ্য ছিল যাতে উন্নয়নের কাজে গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে মানুষকে যুক্ত করা যায়। পঞ্চায়েত সমিতির মাধ্যমে ব্লকে এবং জেলা পরিষদের মাধ্যমে জেলায় যাতে উন্নয়নের কর্মসূচি রূপায়িত করা যায়। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে সব জানার পর এটিকে সারা দেশের মডেল বলেছিলেন। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের এই মডেল সারা ভারতে চালু করার লক্ষ্যে পরে ৭৩ তম সংবিধান সংশোধনী হয়। মানুষের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে গ্রাম, ব্লক, জেলার উন্নয়ন চালাতে এটি যে কার্যকরী ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৮ সালে আমাদের রাজ্যের বিধ্বংসী বন্যায় এবং তারপরে পুনর্গঠনে। বামফ্রন্ট সরকার ভূমিসংস্কার আইন কার্যকর করতে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে মানুষকে সংগঠিত করতে পেরেছিল, তার ফলেই জমিদারদের লুকিয়ে রাখা জমি টেনে বের করতে পেরেছিল। গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বণ্টনের মাধ্যমে। গণউদ্যোগ না থাকলে এটা সম্ভব হতো না। সেচের বৃদ্ধি করে, মিনিকিট দিয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদনেও অভাবনীয় সাফল্য এসেছিল। আগে রাজ্যে খাদ্যে ঘাটতি ছিল, কেন্দ্র থেকে চাল আসত। ক্রমশ ঘাটতি কমতে কমতে পঞ্চম বামফ্রন্ট সরকারের শেষদিকে খাদ্যে স্বনির্ভর হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এমনকি বাঁকুড়া, পুরুলিয়াতেও প্রয়োজন মতো উৎপাদন হয়েছিল। 
প্রশ্ন : অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম সারা দেশের মধ্যে সামাজিকভাবে অগ্রসর বলে পরিচিতি পেয়েছিল। এখানে জাতি বৈষম্য, নিষ্পেষণ কম ছিল। এর পিছনে পঞ্চায়েতের ভূমিকা কী ছিল? 
বসু: বাংলার গ্রামে মানুষ আগে থেকেই মিলেমিশে বাস করতেন। বিদ্যাসাগর যেখানে জন্মেছিলেন বীরসিংহ গ্রামে, এটি তখন হুগলী জেলায় ছিল, এখন পশ্চিম মেদিনীপুরে। সেখানে আদিবাসী, তফসিলি জাতি, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, মুসলমান মানুষজন সবাই ছিলেন। বিদ্যাসাগরকে যখন কলকাতা থেকে লেঠেল বাহিনী আক্রমণ করতে গিয়েছিল তখন তাঁকে রক্ষা করেছিলেন আদিবাসী এবং মুসলমান মানুষজন। তার মানে বাংলায় একসঙ্গে মিলেমিশে থাকার চিত্র ছিল। সেটা নষ্ট করার অনেক চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু এখনও সেভাবে সফল হতে পারেনি। পঞ্চায়েত অবশ্যই তাতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। 
প্রশ্ন : গ্রামবাংলায় জনশিক্ষা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও সচেতনতা প্রসারে পঞ্চায়েতের ভূমিকা নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কীরকম?
বসু : গ্রামবাংলায় জনশিক্ষা প্রসারের কর্মসূচিতে, বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রে দেখেছি অনেকে উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। একজন বয়স্ক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, শিক্ষাকেন্দ্রে কেন এসেছেন? তিনি বলেছিলেন, টিপ সই না দিয়ে আমিও যাতে নাতির মতো লিখতে পারি তার জন্য এসেছি। মাঠের কাজ করা এক ভদ্রলোক বলেছিলেন, টাকা নেওয়ার সময় খাতায় কত লিখল সেটা যাতে বুঝতে পারি তার জন্য শিখতে এসেছি। অনবদ্য উৎসাহ দেখেছি। মানুষ উন্নতির জন্য এগতে চায়। পরনির্ভরশীল থাকতে চায় না। 
প্রশ্ন : ক্ষমতায়নের আশাব্যঞ্জক চিত্র আঁকলেন। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার চলে যাওয়ার পরে গত বারো বছর ধরে যেভাবে পঞ্চায়েত চলছে তাতে কী এমন ইতিবাচক ছবি দেখা গিয়েছে? আপনার অভিমত কী?
বসু : পঞ্চায়েত যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল ও পরিচালিত হয়েছিল তা ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। গ্রাম সংসদের সভা করে গ্রাম উন্নয়নের কর্মসূচি নেওয়ার কথা। এখন সেসবের বালাই নেই। কোথাও সভা হয় না, কারুর বাড়ি থেকে পঞ্চায়েত চলে অথবা কলকাতা থেকে কারুর অঙ্গুলিহেলনে কাজ হয়। গ্রামের সার্বিক বিকাশের যে লক্ষ্য ছিল, অর্থনৈতিক বিকাশ, বৌদ্ধিক বিকাশ, পরিকাঠামোগত উন্নতি ইত্যাদির জন্য মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত আবশ্যিক ছিল। সেই অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ হওয়ার কথা। কিন্তু এখন তো কেবল লোকদেখানো কাজ হয়, কাজের কাজ হয় না। 
প্রশ্ন : তাহলে কী গ্রামের মানুষের সম্পদ লুট হয়ে যাচ্ছে?
বসু : লুট তো হচ্ছেই। জমি হাঙররা আগে শহরের জমির দিকে নজর রাখতো, এখন গ্রামের পুকুরও ভরাট করে দিচ্ছে। মানুষের সম্পদ চলে যাচ্ছে, পরিবেশের পক্ষেও ভয়ঙ্কর ক্ষতি হচ্ছে। নিয়মনীতি মেনে কাজের বদলে কারুর কারুর পকেট ভারী করতে পঞ্চায়েতকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রশ্ন : এই অবস্থায় পঞ্চায়েতে মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এবারের নির্বাচনে আপনারা যে আহ্বান জানিয়েছেন তাতে মানুষের সাড়া কেমন পাচ্ছেন?
বসু : মানুষ বুঝতে পারছেন পঞ্চায়েতে কারা লুটেপুটে খেয়েছে, কৃষির উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দিয়েছে, মানুষের উন্নয়নের বদলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে কারা কাজ করেছে। তাঁরা অধিকার ফিরে পেতে সরব হয়েছেন। বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন পঞ্চায়েত বিরোধীশূন্য ছিল না, এমনকি জেলা পরিষদও বিরোধীরা চালিয়েছে। তারপরে ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত করতে শাসকদল হামলা চালিয়েছে। এখন মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে, পঞ্চায়েতকে পুনরুজ্জীবিত করতে, নতুন বাংলা গড়ে তুলতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। 
প্রশ্ন : সম্প্রতি পাটনায় বিরোধীদের বৈঠক দেখিয়ে এরাজ্যে বিজেপি প্রচার করছে যে বামেদের সঙ্গে নাকি তৃণমূলের জোট হয়েছে! আপনি কী বলবেন এই প্রচার সম্পর্কে?
বসু : বিজেপি মিথ্যার বেসাতি করে। মিথ্যা সংবাদ মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারও করে। বিজেপি নিজেরাই পোস্টার তৈরি করছে যাতে পদ্ম ফুল এবং কাস্তে হাতুড়ির ছবি একসঙ্গে রয়েছে। পাটনা বৈঠক হয়েছে সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধিতার লক্ষ্যে। পশ্চিমবঙ্গকে নির্দিষ্ট করে ধরলে, এখানে ‘রাম’-এর প্রয়োজন নেই, রামের সহোদরেরও কোনও দরকার নেই। অর্থাৎ পদ্মের প্রয়োজন নেই, জোড়া ফুলেরও প্রয়োজন নেই। বিজেপি’র থিংক ট্যাঙ্ক আর তৃণমূলের থিংক ট্যাঙ্ক একই, আরএসএস। আরএসএস’ই তো পরিকল্পনা করে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূলকে তৈরি করেছে। ওরা উভয়ে বোঝাপড়া করে চলে, বোঝাপড়া করেই নিজেদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক লড়াই প্রচার করছে। বাস্তব কিন্তু তা নয়। রাজ্যে তিন পক্ষের লড়াই হচ্ছে। এবার বামেদের বোঝাপড়া অনেক উন্নত হয়েছে, কংগ্রেসের সঙ্গে এবং আইএসএফ’র সঙ্গেও সীমিত ক্ষেত্রে সমঝোতা হয়েছে। এর ফলে বিরাট বৃত্ত লড়াই করছে তৃণমূল এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে। এখন অনেক সমীক্ষায় অনেক কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এসব আদৌ টিকবে তো? 
প্রশ্ন : কিন্তু অবাধ ও শান্তিতে পঞ্চায়েত নির্বাচন করানোর জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশনের যে ভূমিকা থাকা উচিত সেটা দেখতে পাচ্ছেন কী?
বসু: আমরা বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের কাছে গিয়েছিলাম, গ্রামে গুন্ডামি বন্ধ করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের শিরদাঁড়া নেই, তিনি সরীসৃপের মতো কাজ করছেন। তাঁর হাতেই এখন প্রশাসন, অথচ তিনি সরকারের ওপরে নির্ভর করে থাকছেন। শাসকদলের অন্যায় বন্ধ করতে কিছুই বলছেন না, করছেন না। কিন্তু মানুষ শিরদাঁড়া খাড়া করে ঐক্যবদ্ধভাবে যে লড়াই করছেন তাতে নতুন বাংলা গড়ার আহবান আগামী দিনে আসবেই, আমি নিশ্চিত।


..........................
মুখোমুখি বিমান বসু, সাক্ষাৎকারটির ভিডিও দেখতে চোখ রাখুন CPIM West Bengal ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল ও গণশক্তি ওয়েব পোর্টালে।
 

Comments :0

Login to leave a comment