Manipur

মণিপুরকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে বিজেপি-ই জানালেন ‘ইন্ডিয়া’র প্রতিনিধিরা

জাতীয়

বিশ্বজিৎ দাস: গুয়াহাটি
 

প্রধানমন্ত্রী আরও একটি ‘মন কি বাত’ করলেন। কিন্তু তাঁর মুখে ‘মণিপুর কি বাত’ শোনা গেল না। এদিনও চুপ রইলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মণিপুর সম্পর্কে তাঁর এই উদাসীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন বিরোধীদের মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’র সাংসদ প্রতিনিধিরা। মণিপুরের পরিস্থিতি সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে রবিবার দিল্লি ফিরে যাওয়ার আগে রাজ্যপাল অনুসূয়া উইকির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সবিস্তারে জানিয়ে একটি স্মারকলিপিও তুলে দেয় প্রতিনিধিদল। 
স্মারকলিপিতে সাংসদরা উল্লেখ করেছেন, ‘মণিপুরের পরিস্থিতি ভয়াবহ। উৎকন্ঠা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন মণিপুরবাসী। দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছে ত্রাণ শিবিরগুলি। একেকটি শিবিরে চার থেকে পাঁচশো মানুষ গাদাগাদি করে বাস করছেন। শিবিরে করুণ অবস্থায় আছেন শিশু ও বৃদ্ধরা। দুই গোষ্ঠীর মধ্যে আগে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরানোর উদ্যোগ নিতে হবে।’ প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলেছেন সাংসদরা। রাজ্যপাল প্রতিনিধিদলকে বলেছেন, ‘‘রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার কাজকে অগ্রাধিকার দিতে আমি রাজ্য সরকারকে বলেছি। সরকার ও বিরোধীপক্ষ মিলে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল রাজ্যের বিবদমান দুই গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বললে আরও ভালো হতো।’’ তখন সাংসদরা বলেন, ‘‘বিরোধীরা বারবার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে মণিপুরে সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল পাঠাতে প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি।’’ 
রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সাংবাদিকদের সামনে কংগ্রেস সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরি বলেন, ‘‘দু’দিন ধরে ঘুরে আমরা যা বুঝলাম, মণিপুরকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে বিজেপি সরকার। পাহাড়ের মানুষ উপত্যকায় যেতে পারছেন না, উপত্যকার মানুষ পাহাড়ে যেতে পারছেন না। মনে হচ্ছে একটি ছোট্ট রাজ্য মেইতেইল্যান্ড ও কুকিল্যান্ডে ভাগ হয়ে গেছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী এখনও নীরব।’’ তিনি রোম-নিরোর উদাহরণ টেনে বলেন, ‘‘মণিপুর যখন জ্বলছে মোদী তখন বাঁশি বাজাচ্ছেন।’’ 
সিপিআই(এম) সাংসদ এ এ রহিম বলেন, ‘‘মণিপুরে আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। রাজ্য ও কেন্দ্র দুই সরকারই মানুষের পাশে নেই। রাজ্যে কাজ ও খাদ্যের সঙ্কট তীব্র আকার নিয়েছে। শিবিরগুলিতে ওষুধ নেই,খাবার নেই। রাজ্যের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে রেশন ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। শিবিরগুলিতে সরকারি সাহায্য মিলছে না। বিভিন্ন এনজিও শিবির পরিচালনা করছে।’’ 
কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ বলেন, ‘‘বিজেপি’র উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন মণিপুরের মানুষ। রাজ্যে আগুন ধরিয়েছেন মোদী-শাহ। গত বছর মণিপুরে বিধানসভা নির্বাচনের সময় নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় এক ডজন মন্ত্রী প্রতিদিন মণিপুর সফর করেছেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে এক বছরের মাথায় মণিপুরকে ভুলে গেছেন তাঁরা।’’ গগৈ আরও বলেন, ‘‘মণিপুর নিয়ে গোটা দেশ চিন্তায়। ওখানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ‘ইন্ডিয়া’ সর্বতোভাবে চেষ্টা করবে। সংসদে মণিপুরের বিষয় তুলে ধরব আমরা।’’ সাংসদ কানিমোঝি করুণানিধি বলেন, ‘‘রাজ্যের অসংখ্য মহিলাদের সম্ভ্রমহানি করা হয়েছে। বহু মহিলা এখনও নিখোঁজ। মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার।’’ 
উল্লেখ্য, মণিপুরের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে ‘ইন্ডিয়া’ ২১ জনের সাংসদ প্রতিনিধিদল দু’দিনের সফরে শনিবার মণিপুর যায়। প্রতিনিধিরা চুরাচাঁদপুর, বিষ্ণুপুর ও পূর্ব ইম্ফল জেলার চারটি শিবির পরিদর্শন করেন। এছাড়া চুরাচাঁদপুর ও ইম্ফল শহরে কয়েকটি সংগঠনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গেও কথা বলেন। মণিপুর নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে সোমবার দিল্লিতে বিরোধীরা বৈঠকে বসবে। যা দেখলেন সেকথা তাঁরা সংসদে তুলে ধরবেন বলে এদিন জানিয়েছেন প্রতিনিধিরা।
এদিকে, রাজ্যের দুই গোষ্ঠীই নিরাপত্তা বাহিনীর উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। মেইতেইরা কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। অন্যদিকে, কুকিরা রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। রাজ্য পুলিশে মেইতেই গোষ্ঠীর আধিপত্য বেশি। পুলিশের আধিকারিক পর্যায়ে মেইতেইদের প্রাধান্য রয়েছে। হাতেগোনা কয়েজন কুকি অফিসার থাকলেও তাঁদেরকে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। বিজেপি এটাকেও কাজে লাগাচ্ছে। রাজ্য পুলিশের একটি অংশে কুকি-বিদ্বেষ ঢুকিয়ে দিয়েছে বিজেপি সরকার। ফলে কুকি নিবিড় এলাকা সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ করছে বীরেন সিং-য়ের  পুলিশ। ভুয়ো সংঘর্ষে মেরে ফেলে উগ্রপন্থী দাগিয়ে দিচ্ছে। এতে পুলিশের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন মানুষ। বার্মা সীমান্তবর্তী টেঙনৌপাল জেলায় রাজ্য পুলিশ যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্য অবরোধ  গড়ে তুলেছেন প্রায় তিন হাজার মহিলা। গত বৃহস্পতিবার জেলার মোরে শহরে পুলিশ-জনতা খণ্ডযুদ্ধের পর শুক্রবার থেকে ভারত-বার্মা ১০২ নম্বর আন্তর্জাতিক সড়ক তিনদিন ধরে অবরোধ করে রেখেছেন মহিলারা। দিনরাত এখানে বিক্ষোভ চলছে। মণিপুর সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর একটি দল টেঙনৌপাল জেলায় পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তারা সেখানে ঢুকতে পারছে না। অনেকে ইম্ফল ফিরে এসেছেন। আবার মেইতেই নিবিড় এলাকায় সেনারা অত্যাচার করছে বলে অভিযোগ তুলেছেন মেইতেইরা। তাঁরা সেনাদের সরানোর দাবি জানিয়েছেন। মেইতেই এলাকায় তাদেরকে কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে আসাম রাইফেলস।
এদিকে, অশান্ত মণিপুরে সন্দেহভাজন বিদেশির নামে বায়োমেট্রিক নিতে শুরু করেছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। এটা কুকিদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র মনে করছে কুকি সংগঠনগুলি। ১৯৯৭ সালে আসামের ভোটার তালিকায় আচমকা তিন লক্ষাধিক ভোটারকে সন্দেহভাজন ভোটার হিসেবে দেগে দেয় নির্বাচন কমিশন। এখন মণিপুরে কুকিদেরও একই অবস্থা করার ষড়যন্ত্র করছে বিজেপি সরকার।

 

Comments :0

Login to leave a comment