‘‘হাতে কাজ নেই, টাকা নেই। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে, ছাগল সহ ঘরের গৃহপালিত পশু বেচে টাকা জোগাড় করে কুম্ভে ‘পূণ্য স্নান’ করতে দলে দলে ছুটছেন সাধারণ মানুষ। আরএসএস তলে তলে কী ভয়ঙ্কর প্রচার চালিয়ে ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে গণ হিস্টিরিয়া তৈরি করেছে, তা আমরা আঁচ করতে পারছি মাত্র।’’ ডানকুনির সিপিআই(এম)’র ২৭তম রাজ্য সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে রবিবার প্রতিনিধিদের আলোচনায় এভাবেই বারবার উঠে এসেছে সমাজে সঙ্ঘের কার্যকলাপে মারাত্মক বিপদের কথা।
কুম্ভ নিয়ে কার্যত গণ উন্মাদনার চেহারা দেখে স্তম্ভিত প্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে আলোচনায়। প্রতিনিধিরা বলেছেন, শুধু জায়গার নাম বদলে একই ব্যানার সঙ্ঘ ছড়িয়ে দিয়েছে প্রতিটি জেলায়। কার্যত নীরবে প্রচার চালানো হয়েছে। ধার্মিক হিন্দুকে রাজনৈতিক হিন্দুতে পরিণত করার প্রক্রিয়া চলছে এবং তা এক ভয়াবহ বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে সমাজকে, বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন পার্টির উত্তর দিনাজপুর জেলার প্রতিনিধি। বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা বলেছেন, গত ১৪ বছরে তৃণমূলের মদতে এই রাজ্যের নানা জায়গায় আরএসএস নতুন উদ্যমে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ইসকনের মতো ধর্মীয় সংগঠন ও আরও নানা রকমের ধর্মীয় সংস্থার মাধ্যমে সঙ্ঘ নিজেদের ভাষ্য প্রতিষ্ঠা করছে। কুম্ভের মতোই এরকম একাধিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান, কীর্তনের মতো বিভিন্ন সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করে নিজেদের প্রচার পৌঁছে দিচ্ছে ঘরে ঘরে। জনজীবনে তার ভয়ানক প্রভাব দিনে দিনে বাড়ছে।
নদীয়ার প্রতিনিধি বললেন, ‘‘জেলার দক্ষিণাংশে আরএসএস’র প্রভাব বাড়ছে। একইসঙ্গে জেলার উত্তরে আরএসএস-কে মোকাবিলা করার বদলে আগে থেকেই জমি ছেড়ে দিচ্ছে তৃণমূল। স্বাধীনতার আগে থেকেই এখানে সঙ্ঘের প্রভাব ছিল। কিন্তু রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার এবং বামপন্থীরা শক্তিশালী থাকায় তারা মাথাচাড়া দিতে পারত না। খালি চোখে আমরা বিজেপি-কে দেখি ঠিকই। কিন্তু আরএসএস কত বড় বিপদ, তা সে অর্থে বুঝতে পারছি না। রাজ্যে আরএসএস’র সাড়ে চারশো একলব্য বিদ্যালয় চলে। সেখানেই বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে ভেঙে দিয়ে সঙ্ঘের ভাষ্য তৈরি করা হচ্ছে পুরোদমে, শিশুমনকেও বিষাক্ত ভাবনায় ঘিরে ফেলা হচ্ছে। এই জেলায় ইসকন আরও বড় বিপদ। তারা শুধু কৃষকের জমি কেড়ে নিচ্ছে, তা নয়। ইসকন তাদের নিজস্ব নানারকম সংস্কৃতির মাধ্যমে সঙ্ঘের ভাষ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে মানুষের মধ্যে।’’
২০১১ সালের আগে থেকেই সঙ্গ কীভাবে তৃণমূলকে মদত দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত সাহায্য করে তাদের রাজ্যে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে, সেকথা উল্লেখ করেছেন দার্জিলিঙের প্রতিনিধি। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রতিনিধি আলোচনায় বলেছেন, ‘‘আমাদের বাংলাদেশ লাগোয়া জেলা। রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের পর বামফ্রন্টের ৬৫ শতাংশ ভোট ছিল। ১৭ লক্ষ মানুষের বাস এই জেলায়। তাদের মধ্যে হিন্দু ৭৪ শতাংশ। ফলে তৃণমূলের সঙ্গে বোঝাপড়া করে আরএসএস এখানে স্বাভাবিকভাবেই জমি তৈরি করছে। এই বিপদ প্রাথমিকভাবে বোঝা যায়নি। ২০১৪ সালের ভোটের পর থেকে ধীরে ধীরে টের পাই, রাজবংশী, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন সঙ্ঘের রাজনীতির কারণেই দূরে চলে গিয়েছেন।’’
সম্মেলনে পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম যে খসড়া সাংগঠনিক-রাজনৈতিক রিপোর্ট শনিবার পেশ করেছেন, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘‘রাজ্যের সরকারের মদতেই সঙ্ঘের সংগঠন প্রতিদিন বাড়ছে আমাদের রাজ্যে। আরএসএস পরিচালিত স্কুলের সংখ্যা যেমন বেড়ে হয়েছে কয়েক গুণ, তেমনই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় সংগঠন, সামাজিক সংগঠনের মধ্য দিয়েও আরএসএস আমাদের রাজ্যে তাদের মতাদর্শগত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাবনাকে প্রসারিত করার কাজ করে চলেছে। অজস্র সংগঠন ও সংস্থার আড়ালে নিজেদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার বাড়বাড়ন্ত থেকে স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যালঘু এলাকায় বাড়ছে সংখ্যালঘু মৌলবাদ। আর তৃণমূল লোকদেখানো বিজেপি-বিরোধিতা করলেও আসলে জন্মলগ্ন থেকেই নরম মনোভাব পোষণ করে আসছে।’’ সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মালদহের প্রতিনিধি বলেছেন, ‘‘হিন্দুধর্ম এবং হিন্দুত্ব এক নয়। একথা আগে নিজেদের বুঝতে হবে। না হলে বোঝানো কঠিন হয়ে পড়বে আরও। একইভাবে ধর্মনিরপক্ষতার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে নিজেকে আগে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। এই আত্মঅনুশীলন দরকার।’’ আশার কথা শুনিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘’তৃণমূল এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে টানা আন্দোলনে বাইনারি কিছু ক্ষেত্রে ভাঙা সম্ভব হচ্ছে। এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। রামনবমীকে কেন্দ্র করে বিভাজন রুখতে গেলে নিবিড় আত্মীয়তা গড়ে তুলতে হবে সব অংশের সঙ্গে।’’ খসড়া রিপোর্টে জাতীয় পরিস্থিতিতে সঙ্ঘের বিপদের বিষয়ে বলা রয়েছে, হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের শোভাযাত্রা ঘিরে দেশের নানা প্রান্তে সংখ্যালঘু এলাকায় পরিকল্পিত আক্রমণ চালানো হচ্ছে। বুলডোজার-রাজ চলছে। লাভ জিহাদ, ল্যান্ড জিহাদ, ফুড জিহাদের মতো প্ররোচনামূলক স্লোগান তোলা হয়েছে।
রিপোর্টে রয়েছে মণিপুরের জাতিদাঙ্গার কথাও। বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরএসএস-বিজেপি যে উগ্র প্রচার চালায়, তা ব্যাখ্যা করেছেন উত্তর দিনাজপুরের প্রতিনিধি। তিনি বলেছেন, ‘‘কালিয়াগঞ্জে রাজবংশী খুনকে ঘিরে যে উসকানি তারা দিয়েছে, তার মোকাবিলা আমরা সাময়িকভাবে করতে পারলেও সুদূরপ্রসারী কোনও প্রভাব ফেলতে পারিনি।’’ শিক্ষায় মেরুকরণের প্রবণতাও এসেছে আলোচনায়। একইসঙ্গে বিকল্প ভাষ্যের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার এই বিপদকে প্রতিরোধ করার বার্তা উঠে এসেছে প্রত্যেকের বক্তব্যে। পায়োনিয়র ফ্রন্টের প্রতিনিধি বলেছেন, ‘‘রামনবমীতে সঙ্ঘ কিশোর-কিশোরীদের হাতে অস্ত্র ধরিয়ে মিছিল বের করে। আমরা একই বয়সি ছেলেমেয়েদের হাতে বই তুলে দিই। এটাই আমাদের বিকল্প ভাষ্য। শিক্ষা, চেতনাই আমাদের অস্ত্র।’’
CPI-M STATE CONFERENCE
সঙ্ঘের তৈরি করা গণ হিস্টিরিয়ায় ধার করে, ঘটিও বেচে কুম্ভ-দৌড়

×
Comments :0