পীযূষ ব্যানার্জি: ডানকুনি
প্রায় ২২০০ পরিবারের বাস এই গ্রামে। মধ্যবিত্ত থেকে স্বল্প আয়ের নিম্নবিত্ত পরিবারেরই আধিক্য গ্রামজুড়ে। সমীক্ষায় নেমে এই গ্রামেই সিপিআই(এম) কর্মীরা টের পেয়েছে, পরিবার পিছু কমপক্ষে দুই থেকে তিন জন এখন গ্রামছাড়া।
মালদহের রতুয়া ২ নং ব্লকের চাঁদপাড়া কোনও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের জন্য গ্রামছাড়া হয়েছে যুবকরা এমনটা নয়। বরং এরাজ্যে কর্মসংস্থানের কদর্য চেহারা ফুটিয়ে তুলেছে উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক এলাকার এই গ্রামটি।
গ্রাম ছেড়ে মালদহের একটি গ্রামীণ বুথ এলাকায় সমীক্ষা করার ফল কী?
মধ্যবিত্ত এলাকার সেই বুথে আইসিডিএস, আশাকর্মী সহ অন্যান্য পেশায় চাকরিজীবী ৭২ জনের হদিশ পাওয়া গিয়েছিল। ওই বুথেই পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২৮৭ জন। তারমধ্যে যুবতী ও মহিলা মিলিয়ে ১২জন, মাঝপথে স্কুলছুট হওয়া ১০ জন। এমনকি প্রথম বর্ষে কলেজে ভর্তি হয়েও চলে যেতে হয়েছে কাজের সন্ধানে।
‘‘আগে দক্ষ কারিগররা গ্রাম ছেড়ে কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে চলে যেতেন। এখন নিম্নবিত্ত থেকে স্বল্প আয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরাও গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সবাই এখন বুঝে গেছে, এরাজ্যে থাকলে আর কাজ মিলবে না।’’ সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় গ্রামের কর্মসংস্থানের সঙ্কটের চেহারা কোন পর্যায়ে গিয়েছে তা সিপিআই (এম)’র রাজ্য সম্মেলনের আলোচনায় বলছিলেন মালদহের প্রতিনিধি।
ডোমকল কলেজের পড়ুয়া ছাত্রকে এলাকার এসএফআই’র আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয়েছিল। কলেজ পড়ুয়া সেই ছাত্র সংগঠকও নিজের বাড়িতে থাকতে পারেননি। অভাবী পরিবারের মেধাবী এই পড়ুয়া কলেজের পাঠ মাঝপথে চুকিয়ে চলে গিয়েছেন কেরালায়। গ্রাম জীবনের এ হেন সঙ্কট উঠে এসেছে মুর্শিদাবাদের প্রতিনিধির বক্তব্যেও।
অতীতেও মালদহ, মুর্শিদাবাদের মতো জেলা থেকে কাজের জন্য ভিন রাজ্যে চলে যাওয়ার রেওয়াজ আছে। কিন্তু এখন তা প্রায় সর্বগ্রাসী চেহারা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে গোটা রাজ্যেই। উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গের এমন কোনও জেলার প্রতিনিধি ছিলেন না, যাঁর আলোচনাতে উঠে আসেনি পরিযায়ী হয়ে ভিন রাজ্যে চলে যাওয়া।
‘‘শুধু কলেজ পড়ুয়া নয়। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরই গ্রাম ছেড়ে কেরালা চলে যাচ্ছেন। কেরালায় মজুরি বেশি। তাছাড়া সংখ্যালঘু হওয়ার জন্য বিপদে পড়ার সম্ভাবনা দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে কম। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে যারা যাচ্ছে তারা রেজাল্ট বের হওয়ার পরও কৃতকার্য হয়েও আর গ্রামে ফিরছে না,’’ বলছিলেন মুর্শিদাবাদের প্রতিনিধি।
গ্রামে ১০০ দিনের কাজ নেই। গরিব পাড়াগুলিতে পরিযায়ী হয়ে গ্রামছাড়ার স্রোত ভয়াবহ। কৃষিতে সঙ্কট এতটাই তীব্র আকার নিয়েছে যার পরিণতিতে কৃষক পরিবারের সন্তানরা জীবিকা পরিবর্তনের পথ খুঁজছে। এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা বুঝে নিয়েছেন এরাজ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ আর থাকছে না। তাই দলে দলে বেকারের স্রোত ভিন রাজ্যে আছড়ে পড়ছে।
মুর্শিদাবাদের মতো পরিযায়ী হয়ে ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া অতীত অভিজ্ঞতার জেলাতেও এখন সামাজিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে। কী সেই সঙ্কট? জেলার প্রতিনিধি বলছিলেন, ‘‘যুবক ছেলে বাড়িতে স্ত্রীকে ফেলে রেখে ভিন রাজ্য চলে যাচ্ছে। বছরে একবার থেকে দু’বারের বেশি সাক্ষাত হওয়ার সুযোগ থাকছে না। ফলে পরিবারের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। ডোমকল থাকায় দিনে ১০টি অভিযোগ আসলে তার মধ্যে একটি দুটি অভিযোগ পরিযায়ী স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্কের অবনতির ঘটনা।’’
একদিকে কাজ না পাওয়া যুবকদের গ্রাম ছাড়ার চিত্র। সেই গ্রাম বাংলাতেই আবার নব্য ধনীদের মাথাচাড়া দেওয়া। বৈষম্যের এই ফারাক শ্রেণি আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে কীভাবে বাধার মুখে পড়ছে আলোচনাতে সেকথা বলছিলেন জেলার প্রতিনিধিরা। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রতিনিধি যেমন জানাচ্ছিলেন, ‘‘পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ছে। গ্রামে পড়ে থাকা গরিব মানুষ সরকারি প্রকল্প নির্ভর হয়ে যেমন উঠছে, তেমনই গ্রামে তোলাবাজ, লুটেরা, দুর্নীতির বিপুল টাকায় বড়লোক বনে যাওয়া নব্য ধনীরাই রাজ্যের শাসকদলের রক্ষাকর্তা। এরাই নিয়ন্ত্রণ করছে গ্রামের ভোট। গ্রামে শ্রেণি ভারসাম্যের পরিবর্তনের বড় বাধা এই নব্য ধনীরাই।’’
এক সময় এরাজ্যে গ্রামের ভূমিহীনদের হাতে জমি তুলে দিয়েছিল বামপন্থীরা। জোতদারদের হাত থেকে বেনামী জমি উদ্ধার করে বিলি করার লড়াইয়ের ফসল এরাজ্যের ভূমি সংস্কার আন্দোলন। এখন সেই নব্য ধনীদের হাত ধরে মাথা তুলছে জোতদার-জমিদারদের নয়া প্রজন্ম। ‘‘এরা গ্রামের জোতদারদের তৃতীয় প্রজন্ম। যে জমি উদ্ধার করে ভূমিহীনদের কাছে বণ্টন করা হয়েছিল, সেই জমি এখন নয়া প্রজন্মের জোতদাররা ফেরত চাইছে,’’ বলছিলেন কোচবিহার জেলার প্রতিনিধি।
শুধু গ্রাম নয়, শিল্পাঞ্চলেও কয়লা, বালি, পাথর থেকে অবৈধ টাকায় রাজ্যের শাসকদল তৈরি করেছে তাদের ভাড়াটে বাহিনী। পশ্চিম বর্ধমানের মহিলা প্রতিনিধি বলছিলেন, ‘‘কয়লা চুরির টাকায় তৃণমূল তার কর্মীবাহিনী তৈরি করেছে। ভোটের সময় এরাই বুথে, বুথে লুট চালায়।’’
কাজের এই আকালে পরিযায়ী শ্রমিকদের লাশ হয়ে ঘরে ফেরার একের পর এক ঘটনায় উদ্বিগ্ন প্রতিনিধিরা জানতে চেয়েছেন, ‘‘প্রায়ই গ্রামে মৃত্যুসংবাদ আসে। কোনোদিন গুজরাট কিংবা অন্য রাজ্য থেকে। কাজ করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা। এই পরিযায়ীদের সংগঠিত করার জন্য কিছু কী করা যায় না?’’
এদিনই সম্মেলন থেকে নেওয়া হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিক সহ ভিনরাজ্যে বসবাসকারী মানুষেদের জীবন -জীবিকার নিরাপত্তা ও মর্যাদার সংগ্রামকে জোরদার করার দাবির প্রস্তাব। প্রস্তাব উত্থাপন করেন জামির মোল্লা ও সমর্থন করেন রাহুল ঘোষ।
CPI-M STATE CONFERENCE
সঙ্কটের সর্বগ্রাসী চেহারায় বাড়ছে পরিযায়ী শ্রমিক

×
Comments :0