Coromondal accident

নিঝুম রাতের ‘অপারেশনের’ অপেক্ষায় নয়নজুলিতে পড়ে দুর্গন্ধ ছড়ানো দুই কামরা

জাতীয়

অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়: বাহানাগা

ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার নয়, শুধুই দশ কিলোমিটার বেগে। সোমবার সকালে বাহানাগা দিয়ে সেই বেগেই হাওড়া-পুরী বন্দে ভারত এক্সপ্রেস চালিয়ে মুখরক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করল রেল। বড়াইয়ের এই চেষ্টাটা আসলে মোদী সরকারেরই। এখনও বাহানাগা উত্তর রেল গেটের অদূরে পড়ে রয়েছে যশবন্তপুরের উলটে যাওয়া জেনারেল কম্পার্টমেন্টটি। সেখান থেকে এদিনও বেরোচ্ছে দুর্গন্ধ।
সেই ট্রেন যখন বাহানাগার ভয়ানক দুর্ঘটনাস্থল পেরোলো, তখনও বাহানাগা উত্তর রেল গেটের অদূরে পড়ে রয়েছে যশবন্তপুরের উলটে যাওয়া জেনারেল কম্পার্টমেন্টটি। সেখান থেকে কালকের চেয়েও আজ যেন বেশি দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। কম্পার্টমেন্টের একশো মিটারের মধ্যে গেলেই ওই দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না।
রবিবার রাতে বাহানাগা দিয়ে ট্রেন চালানো যদি রেলের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে সোমবার রাতের মধ্যে ওই জেনারেল কম্পার্টমেন্টকে নিকেশ করাই হয়তো রেলের আশু লক্ষ্য। 
এর জন্য তৈরি রয়েছে দিল্লি থেকে আসা আরপিএফ’র উদ্ধার বাহিনী। ভদ্রক থেকে বালেশ্বরের দিকের ডাউন লাইনের বাঁদিকে পড়ে থাকা ওই কম্পার্টমেন্ট এখন রেলের গলার কাঁটা। সেজন্যই এই পরিকল্পনা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কম্পার্টমেন্টটিকে ঘিরে রেখেছে আরপিএফ-এর দল। কোনভাবে সেখানে যাতে কোনও মিডিয়া সহ কাকপক্ষী পৌঁছাতে না পারে তার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী ২০০ মিটার আগে থেকেই কাউকে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দিচ্ছে না। এলাকার বাসিন্দাদেরও বাইরে বিশেষ বেরনো নিষেধ। 
রাত দশটার পর বাইরের লাইট নিভিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে সোমবারে বাহানাগা লেভেল ক্রশিংয়ের ডানদিকে তৈরি করা হয়েছে বালেশ্বর পুলিশের হেল্প ডেস্ক। উদ্ধার কাজ সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর ফের কেন ওই সহায়তা কেন্দ্রের দরকার পড়ল তা বলতে পারেননি বালেশ্বর জেলার পুলিশ সুপার সাগরিকা নাথ। জীবিত-মৃত সকলেই যখন এখন তালিকাবন্দি, তখন নতুন করে কেন ফের সহায়তা কেন্দ্র।  
রেল লাইনে পাশের নির্জলা নয়নজুলিতে আরপিএফ বিশেষ ক্যাম্প করেছে। সোমবার দুপুর থেকে সেখানে বাড়ছে জওয়ানের সংখ্যা। বিকালে তা ২০০ পার করেছে। ক্যাম্পের বিপরীতে রয়েছে আলাদা একটা খালি প্লাস্টিকের তাঁবু। সেটি এখনও ফাঁকা। ওখানেই হয়ত পচাগলা দেহ রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই তাবুর আর একটু দূরে রয়েছে রেলের আর্থ মুভার মেশিন। যা করার ওই মেশিনই করবে। যত ভারী, ভাঙাচোরা বগিই হোক তা সোজা করতে ওই মেশিনের লাগবে দশ মিনিট সময়। তার পরেই সেই আসল কাজ।
সোমবার সকাল থেকেই রেল লাইনের কাছে কোনও সাধারণ মানুষকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। রেল লাইনের ওপারের লোককেও গ্রামে যেতে হচ্ছে ঘুরে ঘুরে। কোনও কথা শুনতে চাইছে না আরপিএফ রিজার্ভ ফোর্স। বারংবার অনুনয়-বিনয় করলেও সবার মুখে একটা কথা, ‘মানা হ্যায়’। ব্যাস। ওটাই প্রথম, ওটাই শেষ। তাঁদের আর কিছুই বলে হ্যাঁ করানোর উপায় নেই। দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত মিডিয়া প্রতিনিধিদের জোর করে আটকে রাখা হয়েছে বাহানাগা রেলগেটের উত্তর পাশে। চিত্রগ্রাহক প্রতিনিধিরাও নিরূপায়। দূর থেকে টেলিলেন্স দিয়ে ছবি তোলা সোমবার সকাল থেকে বন্ধ। রেল লাইনের পাশ ধরে সবুজ মোটা কাপড় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার প্রথম থেকে যাঁরা আছেন, সে সব সাংবাদিকদের কাছে সোমবারের দিনটা প্রথম থেকেই যেন অন্যরকম ঠেকছে।
উপায় নেই লোকের বাড়ি ডিঙিয়ে জঙ্গল, নির্জলা পুকুর পার হয়ে লাইনের পাশে যাওয়ার। ক্ষণে ক্ষণে সেখানে ওড়ানো হচ্ছে ড্রোন। মাটির কাছ থেকে এলাকার ওপর লাগাতার নজরদারি করে চলেছে সাদা রঙের একটি বড় ড্রোন। কেউ কোনভাবে জঙ্গল পেরিয়ে রেল লাইনে উঠতে গেলেই মারমুখী হয়ে ছুটে আসছে আরপিএফ। এদিন তাঁদের দেহের ভাষা বলে দিচ্ছে, তাঁরাও যেন সাংঘাতিক চাপে রয়েছেন। একে রুমাল মুখে লাগাতার ডিউটি করতে হচ্ছে, তার ওপর বারেবারে বকা শুনতে হচ্ছে ঊর্ধ্বতন আধিকারিকের।
সকলেই যেন দুপুরের পর থেকে মেজাজ হারিয়ে ফেলছেন। অনেকে কাজের চাপে দুপুরের খাবার খেতে পারছেন না। সবার মুখে টেনশন কাজ করছে। সকলেই বুঝতে পারছেন, রাতের দিকে কী হতে চলেছে। কিন্তু উর্দি গায়ে, খোদ রেলমন্ত্রী এলাকায় উপস্থিত। কোনও কথা বলার সাহস কারো নেই। এরই মধ্যে বীভৎস দুর্ঘটনার স্মৃতি দূরে সরিয়ে রেখে রবিবার রাতে ফের ছোটানো শুরু হয় ট্রেন। প্রথমে একটি ছয় বগির মালগাড়ি। আর সোমবার সকালে ফের একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন ছাড়ার পর  সেখান থেকে দিনভর চলেছে আন্তঃ শহরের প্যাসেঞ্জার ট্রেন।
ধীর গতিতেই বাহানাগার দুর্ঘটনাস্থল পার হচ্ছে ওই সব ট্রেন। আর ট্রেন আসা-যাওয়ার আগে বাহানাগা কেবিন থেকে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে আপ-ডাউন লাইনের কোনও দিক থেকে ট্রেন আসছে। লাইনে কাউকে না উঠতে বারেবারে ঘোষণা করা হচ্ছে। এরপর সেই ট্রেন বাহানাগা লেভেল ক্রসিংয়ের একশো মিটারের মধ্যে আসতেই শুরু হয়ে যাচ্ছে লাগাতার হুটার বাজানো।
ট্রেনের ভিতরে থাকা আগ্রহী যাত্রীরা জানলা, দরজা দিয়ে উঁকি মেরে রেল লাইনের আশপাশ দেখছেন। বাচ্চাদের চিৎকার করতে দেখা যাচ্ছে, কোন কোন বগি থেকে মায়েরা মুখ চাপা দিয়ে কাঁদছেন। অন্যের ছেলে হারানো বেদনাই হয়ত সেই সব মায়েরা সহ্য করতে পারছেন না। বাকি যাত্রীদের চোখে মুখে আতঙ্ক মাখানো বেদনা। কেউ আবার সব কিছু ভুলে গিয়ে মোবাইলে এখনও পড়ে থাকা ষশবন্তপুর এক্সপ্রেসের কামরার ছবি তুলছেন। এইভাবে সেই জেনারেল বগির পাশ দিয়ে যেতেই সব কিছু ফেলে মুখে রুমাল দিতে হচ্ছে সবাইকে।


 

Comments :0

Login to leave a comment