DYFI Brigade Rally

ভয় জয় করা জনপ্লাবনে ক্যাপ্টেন ব্রিগেডই

রাজ্য

 ‘‘বামপন্থীরা ভয় পায়? পায় না। আপনারা ভয় পেয়েছেন? পাননি। আজ আপনারা ভয়কে জয় করে এসেছেন।’’ মহম্মদ সেলিম বললেন।
মুহূর্তে সম্মিলিত করতালিতে হৃদয়ের উত্তাপ জানিয়ে দিল নরম রোদের মাঠ। 
মুমূর্ষু, ফ্যাকাসে ঘাসের উপর বসেছিলেন মাতবউদ্দিন আহ্‌মেদ। তিনিও হাততালি দিচ্ছিলেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদকের কথায়। করতালি মিলিয়ে যাওয়ার পর কথা হলো কিছু। রায়গঞ্জের ৯নং অঞ্চলের মাতবউদ্দিন বললেন,‘‘ব্রিগেডে পার্টি সমাবেশ ডাকলেই আমরা আসি।’’ পার্টি ডাকেনি এবার। যুবরা ডেকেছে...কথা শেষ করতে দিলেন না কৃষিজীবী মানুষটি। বললেন,‘‘শুনুন, আমি এখন ভুট্টা আর শশা লাগিয়েছি। ধান উঠে গেছে। একই মাটি তো? আলাদা মাটিতে লাগাইনি তো। ব্রিগেডে আমাদের সমাবেশ মানে তাই। পার্টি ডাকুক আর যুবরা— বামেরা ডেকেছে। তাই তো? ব্যস, ওই হলো। মানে আমাদের ব্রিগেড। আসতেই হবে।’’ 
সোজা কথা— যৌবন ডেকেছে। ভালো করেছে। জনগণ আসবে। আসবেই। ব্রিগেড শেষ পর্যন্ত অখণ্ড আকাশের নিচে ইনসাফের দাবিসনদ পেশের জন্য উত্তাল জনতার আদালত।
সেই জনতার খণ্ড খণ্ড ভৌগোলিক পরিচয়, ঠিকানা, স্থানীয় ইতিহাস, ধর্ম, জাত, উপজাত, উচ্চারণের তফাতের প্রতিটি বিন্দু রবিবার জনসমুদ্র গড়েছিল। এসএফআই-র রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য যখন বললেন,‘‘যার বাছার জোটেনি দুধ, এই মিছিল তার। যার বাছার শুকনো মুখ, এই মিছিল তার। এই মিছিল সব হারার সব পাওয়ার এই মিছিল, হও শামিল হও শামিল হও শামিল’’— সেই জনসমুদ্রে হিল্লোল উঠল। সলিল চৌধুরির গানের তালিকা সাঁটানো থাকত ’৫০-র শহীদ মিনারের গায়ে। সেই সব গান গাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। রবিবার সেই সলিলের কবিতা, তেভাগার ৭৫ উজিয়ে আজকের আকাশে বিছিয়ে ছিল জনকল্লোল— স্লোগানে স্লোগানে। আরাত্রিকার গানে যদি শেকল ভাঙার মন্ত্র থাকে, তবে এদিনের সমাবেশ শুরু হয়েছে সভ্যতার আত্মা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান— ‘বাংলার মাটি বাংলার জল...’-র আবেশে।
এই জনস্রোত ধারণ করেছে কে? কার আছে সেই হিম্মত? আছে সেই ব্রিগেডের।
রবিবার জনপ্লাবনে ইনসাফ চেয়েছে ব্রিগেড। জনস্রোত আর একবার জানিয়ে দিয়েছে মীনাক্ষী মুখার্জির ভাষায়— ‘‘চোখের সামনে এখনও মইদুলকে দেখতে পাই। চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুলিশ কীভাবে ওকে পিটিয়ে মেরেছিল। সুদীপ্ত, সাইফুদ্দিনের লাশ আমরা কাঁধে করে নিয়ে এসেছি। লাশকাটা ঘরের গন্ধটা এখনও নাকে লেগে আছে। যারা ওদের মেরেছে, তাদের কি ছেড়ে দেওয়া যায়? যদি ছেড়ে দিই, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের বেইমান বলবে। বেইমান শুনতে আমরা লড়াইয়ের ময়দানে নামিনি।’’
ব্রিগেড বেইমানদের ধারণ করে না। জনস্রোতে মিশে থাকে তরুণের স্বপ্ন, আবেগ আর প্রবীণের অভিজ্ঞতা। মিশে থাকে কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, বন্ধ কারাখানা খোলা, কর্মসংস্থান, মহিলাদের নিরাপত্তা-কাজের দাবি। চিরুডির বাবলু মাহাতোর কথাই শোনা যাক। বাবলু যুবক— বছর তিরিশ-বত্রিশ। তাঁর স্পষ্ট কথা— ‘‘কাজের অভাবই প্রধান সমস্যা। কাজ চাই।’’ পাশে বছর পঞ্চাশের বুদ্ধেশ্বর কর্মকার এবং দুলাল মাহাতো। দুলালের বয়স আরও বেশি— পরণে গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি। ঘড়িতে তখন পৌনে ১টা। মঞ্চের সামনের তিনদিক ছাড়া ভিড় রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পিছনদিকটি ফাঁকাই লাগছে। বাবলু বললেন, ‘‘কী মনে হয়? ভরে যাবে?’’ বুদ্ধেশ্বরের গলায় আত্মবিশ্বাস—‘‘আরে, হ্যাঁ। দেখ না কিছুক্ষণ। দেখবি ভরে যাবে।’’ দুলাল বললেন,‘‘আমরা বান্দোয়ান থেকে এসেছি। চিরুডি থেকে। রাত দশটায় বাসে উঠেছি। ব্রিগেডে নেমেছি ভোর ছ’টায়।’’ ক’জন এসেছেন। দুলাল বললেন,‘‘আমাদের বাসে ৫৬জন। মহিলারাও আছে।’’ তৃণমূল কিছু বলেনি? বিজেপি? এবার যুবক বাবলু বললেন,‘‘বিজেপি? আরে কোথায় বিজেপি? একটা সিটে জিতেছিল। তৃণমূলে চলে গেছে। আর তৃণমূলের সেই রোয়াব নেই। এত চুরি করেছে, এখন মাতব্বরি কম দেখায়।’’
বদলাচ্ছে বাংলা। বান্দোয়ানের তিন সাথির কথোপকথনে তারই আভাস। এরই মধ্যে সময় গড়িয়ে দেড়টা বাজার পর থেকেই ঢল নামল মাঠে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দু’দিক থেকে লম্বা লম্বা মিছিল ঢুকে পড়তে শুরু করল। আধ ঘণ্টার মধ্যে মৃদু শীতের ব্রিগেডে ভরা জোয়ার— মানুষের।
সোনারপুরের বৈকুণ্ঠপুরের ‘হিটলার’-র সঙ্গে দেখা ব্রিগেডের পিছন দিকেই। ‘হিটলার’ কারও নাম? আর সেই নামের লোক বামপন্থীদের ডাকা সমাবেশে। আনোয়ার হোসেন বললেন, ‘‘কে ছোটবেলায় রেখেছিল, কে জানে? সবাই ওই নামেই চেনে। আমি দেওয়াল লিখতে পারি। দেওয়াল লিখতে যাই দূরে দূরে। আজ কয়েকজন বন্ধু মিলে চলে এসেছি ট্রেনে। আগে ঢুকবো বলে।’’ প্রায় ষাট ছুঁয়েছেন মানুষটি। কেন এলেন? এবার তো যৌবনের ব্রিগেড। মুহূর্তে ভুল ধরিয়ে দিলেন আনোয়ার হোসেন—‘‘উঁহু, আপনি খেয়াল করেননি। ভুল করছেন। কল ছিল যৌবনের ডাকে জনগণের ব্রিগেড। আর যৌবনই ডাকুক, আর বৃদ্ধ— ব্রিগেড ডাকলে আসা আছেই।’’ 
সাদা পতাকায় লাল তারার পতাকা যেমন ছিল, এদিন ব্রিগেডে লাল ঝান্ডা নিয়েও এসেছেন অনেকে। দেখা গেছে এসএফআই, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, এবিটিএ-র মতো অনেক সংগঠনের পতাকা কাঁধেও এসেছিলেন অনেকে। 
 

Comments :0

Login to leave a comment