দিল্লি বিস্ফোরণের ঘটনার পরে ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কারণ নিয়ে সরকারিভাবে কিছু জানানো হয়নি মঙ্গলবারও। তবে ঘটনার তদন্তভার এনআইএ’র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সোমবার লালকেল্লার কাছে গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১২ হয়েছে। এদের মধ্যে ২ জন মহিলাও আছেন। মঙ্গলবার কয়েক দফায় তদন্তকারী সংস্থাগুলির আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। তারপর একটি পোস্ট করে তিনি বলেছেন, দিল্লির গাড়ি বিস্ফোরণের বিষয়ে শীর্ষ আধিকারিকদের সঙ্গে পর্যালোচনা বৈঠক করেছি। এই ঘটনার নেপথ্যে জড়িত প্রত্যেক দোষীকে খুঁজে বার করার নির্দেশ দিয়েছি। তাদের এবার আমাদের সংস্থাগুলির রোষের মুখোমুখি হতে হবে। ফরিদাবাদে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় যে চিকিৎসকদের জড়িত থাকার কথা বলা হচ্ছিলো, তাদের মধ্যে অন্যতম ডাঃ উমর নবিই গাড়ি চালাচ্ছিলেন বলে এদিন এনআইএ ‘সূত্র’ উদ্ধৃত করে জানিয়েছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। সংবাদ সংস্থা পিটিআই-ও তাই বলেছে।
এই সব দাবিতে প্রশ্ন উঠেছে, তদন্তকারী সংস্থাগুলি আনুষ্ঠানিকভাবে জানাচ্ছে না দিল্লি বিস্ফোরণের কারণ বা কারা এরসঙ্গে জড়িত আছে। কেন্দ্রের সরকারের তরফেও জানানো হচ্ছে না। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থার ‘সূত্র’ জানিয়ে দিচ্ছে এটা সন্ত্রাসবাদী হামলা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পোস্ট থেকেও সেটাই স্পষ্ট হচ্ছে। ভূটানের রাজধানী থিম্পুতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বলেছেন, আমাদের তদন্তকারী সংস্থাগুলি এই ষড়যন্ত্রের মূলে পৌঁছাবে এবং যারা এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে আছে তাদের কারোকে ছাড়া হবে না। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংও হুঁশিয়ারির সুরে একই কথা বলেছেন। প্রশ্ন হলো, ইঙ্গিতে কেন? এটা সন্ত্রাসবাদী নাশকতা হলে সে কথা সরাসরি বলছে না কেন সরকার? তার সুযোগে এদিন ফের সংবাদ মাধ্যমের বড় অংশ, যারা ‘গোদী মিডিয়া’ হিসাবে পরিচিত তারা সংগঠিতভাবে মুসলিম এবং কাশ্মীরীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েছে। নানাধরনের ‘সম্ভাব্য’ বিষয়কে ‘প্রকৃত’ ঘটনা হিসাবে উপস্থিত করছে।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই সংবাদ মাধ্যমের বড় অংশ জানিয়েছে, বিস্ফোরণ হওয়া গাড়িতে মাস্ক পরা যে ব্যক্তিকে দেখা গেছে তিনিই ডাঃ উমর নবি। পুলওয়ামার বাসিন্দা নবি, যাকে সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে খোঁজ করা হচ্ছিল। সংবাদ সংস্থা পিটিআই পুলিশ সূত্র থেকে জানিয়েছে, আশপাশের সমস্ত সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা গেছে গাড়িতে উমর একাই ছিলেন। পুলিশ সূত্র পিটিআই-কে জানিয়েছে, বিস্ফোরণের আগে কাছের পার্কিংয়ের জায়গায় গাড়িটি তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়েছিল। অন্যান্য পার্কিয়ের জায়গার সিসিটিভি ফুটেজও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পুলিশ অফিসাররা আরও জানিয়েছে, যত গাড়ি দিল্লিতে ঢোকে, সেটা ব্যক্তিগত বা বাণিজ্যিক যাই হোক, খুঁটিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। পুলিশের এই দাবির পরে স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তা ব্যবস্থার গুরুতর ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কীভাবে তাহলে ওই গাড়িতে বিস্ফোরক নিয়ে আসা হলো? কীভাবে তিন ঘণ্টা ধরে একটি পার্কিং লটে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে রইলো, যার চালক নাকি একবারও গাড়ি থেকে নামেননি। কেন সন্দেহ হলো না? বিশেষ করে যখন জম্মু-কাশ্মীর, দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশে সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদী হামলা নিয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছিল ফরিদাবাদ থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধার হওয়ার পরে।
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে সন্ত্রাসবাদী হামলা হিসাবেই একে বিবেচনা করা হচ্ছে। অর্থাৎ এটা কোনও দুর্ঘটনা নয়। তারপরেই প্রশ্ন উঠেছে, নিরাপত্তার এই গুরুতর ত্রুটির দায় মোদী সরকার এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নিচ্ছেন না কেন? পহেলগামের ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হামলার দায়ও নেননি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বা তাঁর সরকার। তখনও এই একই কথা বলা হয়েছিল যারা নেপথ্যে আছে তাদের ছাড়া হবে না। তারপর অপারেশন সিঁদুর এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের হুঁশিয়ারিতে তা বন্ধ করে পিছু হটে মোদী সরকার। এখন আবারও যখন সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে এবং পিছনে পাকিস্তান থেকে পরিচালিত জৈশ-ই-মহম্মদ আছে বলে ইঙ্গিত করা হচ্ছে, সে কথা সরকার স্বীকার করছে না কেন? বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে একটা প্রচার বড় করে করা হয়— মোদী সরকারের সময়ে দেশে সন্ত্রাসবাদী হামলা বন্ধ হয়ে গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ প্রায়শই বুক বাজিয়ে বলেন, ‘‘এখানে-ওখানে বোম ফোটা এখন বন্ধ হয়ে গেছে’’। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা- মোদী সরকারের বড় সাফল্য হিসাবে দাবি করে বিজেপি। যদিও মোদী সরকারের সময়েই ভারতের সেনা-আধাসেনা বাহিনী এবং প্রতিরক্ষা পরিকাঠামোর উপরে পাঠানকোট, উরি, পুলওয়ামায় ভয়ঙ্কর হামলা হয়েছে। কিন্তু সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রচারে সেই ব্যর্থতাকে চাপা দেওয়া হয়েছে। ‘বম ফোটেনি’-র প্রচারই হয়েছে শতমুখে। অনুমান, সেই কারণেই সম্ভবত বিহার ভোটের শেষ পর্যায়ের আগে সন্ত্রাসবাদী হামলার কথা স্বীকার করতে চায়নি মোদী সরকার।
বিস্ফোরণের নেপথ্যের লোকদের কোনোভাবে ছাড়া হবে না, মোদীর এই হুঁশিয়ারির পরে ‘গোদী মিডিয়া’ ফের পাকিস্তানে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এর মতো অভিযানের কথা প্রচার করেছে মঙ্গলবার। ঘটনাচক্রে এদিনই রাজস্থান সীমান্তে বায়ুসেনার মহড়া হয়েছে। সেটাকেও এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য, কার্যত ট্রাম্পের হুমকিতেই মোদী ‘অপারেশন সিঁদুর’ বন্ধ করেন। তারপর থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প। বিশেষ করে পাক সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সঙ্গে যেরকম সখ্য বেড়েছে মার্কিন রাষ্ট্রপতির, তাতে এখন মোদী সরকার পাকিস্তান বিরোধী কী পদক্ষেপ করে সেটা দেখার বিষয়। সেই কারণেও মোদী সরকার দিল্লি বিস্ফোরণের ঘটনাকে সন্ত্রাসবাদী হামলা বলে মেনে নিতে সময় নিচ্ছে বলে অভিমত কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের।
Delhi Blast
দিল্লি বিস্ফোরণে মৃত বেড়ে ১২
×
Comments :0