ডেঙ্গু মহামারীর আতঙ্কে জেরবার রাজ্যের মানুষ। মৃত্যু মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় একই বাড়িতে কয়েকজন করে জ্বরে ভুগছেন। টেস্ট করলে ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ১৫ জনের ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। তার মধ্যে হঠাৎ করে শারীরিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন অনেকেই। তবে মৃত্যুর তথ্য সরকার গোপন করছে বলে অভিযোগ তীব্র হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ২ জনের মৃত্যু হলো রাজ্যে। একটি মৃত্যুর ঘটনা কলকাতাতে, অপরটি উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসতে।
এক্ষেত্রেও ডেঙ্গুর তথ্য গোপন করা হয়েছে বলে হাসপাতালে বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এই ২টি মৃত্যুর পর রাজ্যে বিভিন্ন বেসরকারি সূত্রে মৃত্যুর সংখ্যা অন্ততপক্ষে ৯০, আক্রান্ত প্রায় ৭০ হাজার। রোজই কয়েকটি করে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের খবর মিলছে। কিন্তু মৃত্যুর কোনও তথ্যই প্রকাশ করছে না রাজ্য সরকার। শুক্রবার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ভারতী প্রবীণ পাওয়ার কলকাতায় এসে অভিযোগ করে বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত বা মৃত্যু নিয়ে কোনও তথ্যই কেন্দ্রকে দিচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গ সরকার। অথচ অন্যান্য রাজ্য থেকে নিয়মিতই মিলছে এই সংক্রান্ত তথ্য। কলকাতা, বিধাননগর, হাওড়া, হুগলী, উত্তর ২৪ পরগনা, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, মুর্শিদাবাদে ভয়ঙ্করভাবে ছড়িয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ।
বৃহস্পতিবার কলকাতায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন বহুজাতিক তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার কর্মী রোহিত দাস (৩০)। জ্বর ও বিভিন্ন উপসর্গে আক্রান্ত হয়েছিলেন সন্তোষপুর সার্ভে পার্ক এলাকার এই যুবক। রোগ বেড়ে যাওয়ায় গত ২২ অক্টোবর তাঁকে নয়াবাদ-পঞ্চসায়র এলাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। শুক্রবার মৃত্যু হয় তাঁর। ডেথ সার্টিফিকেটে ডেঙ্গুর উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গার বাসিন্দা হামিদা বিবি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বারাসত হাসপাতালে। তাঁর মৃত্যুর পর অবশ্য হাসপাতাল ডেঙ্গুতে মৃত্যু বলে অস্বীকার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অথচ পরিবারের বক্তব্য, রোগীর রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়েছিল।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর পর ডেঙ্গুর তথ্য গোপন নিয়ে দেগঙ্গাতে বিস্ফোরক অভিযোগ উঠলো প্রশাসনের বিরুদ্ধে। গত ৭ নভেম্বর জ্বর নিয়ে বারাসত হাসপাতালে ভর্তি হন দেগঙ্গার গিলাবাড়ি পূর্বপাড়ার বাসিন্দা হামিদা বিবি (৫৫)। তাঁর রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। বারাসত হাসপাতালের সিসিইউ-তে ভর্তি করা হয় তাঁকে, এরপর বৃহস্পতিবার রাতে বারাসত হাসপাতালে ওই গৃহবধুর মৃত্যু হয়। সরকারি হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর কারণ হিসাবে ডেঙ্গু লেখা হয়নি। রোগীর পরিবারের অভিযোগ, সরকারি হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর কারণ হিসাবে ডেঙ্গুর কথা বেমালুম চেপে দেওয়া হয়েছে। একই অভিযোগ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই উঠে আসছে।
এরই পাশাপাশি বেড়াচাঁপা দু’নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওই এলাকায় কোনোরকম সচেতনতার প্রচার নেই প্রশাসনের তরফে। তাঁদের অভিযোগ, সারা রাজ্যে সরকারি হাসপাতালগুলি থেকে প্রকৃত সত্য আড়াল করছে স্বাস্থ্যদপ্তর। ডেঙ্গুতে মৃত্যু হলেও রোগীর মৃত্যুর কারণ হিসাবে অন্য কিছু দেখানো হচ্ছে। অনেক সময় অনেক রোগীর কাগজপত্র চেপে দিচ্ছে সরকারি হাসপাতাল। স্বাস্থ্য দপ্তরের গাফিলতি ও উদাসীনতা প্রকট, পঞ্চায়েত এলাকায় কোনও সরকারি পদক্ষেপই নেই ডেঙ্গু প্রতিরোধের। অভিযোগ উড়িয়ে দেগঙ্গা পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি তুষারকান্তি দাস বলেছেন, গিলাবাড়ি এলাকায় পরিবার যে অভিযোগ করছে তা তদন্ত করে দেখা হবে। এলাকায় সচেতনতার প্রচার ঠিকমতো হচ্ছে। যদি কর্মীদের কোনও গাফিলতি থাকে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডেঙ্গু সংক্রমণের শুরু থেকেই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। এমনকি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রককে নিয়মিত ডেঙ্গু ম্যালেরিয়ার তথ্য দেওয়ার কথা রাজ্য সরকারের। তা যে একেবারেই বন্ধ রয়েছে এদিন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে সে কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে। তিনি এদিন বলেছেন, প্রত্যেক রাজ্য থেকে ফিডব্যাক আসে কিন্তু এই রাজ্য কোনও তথ্য দিচ্ছে না। রাজ্যের ডেঙ্গু কবলিত বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রায়শই সরকারি হাসপাতাল ডেঙ্গু মৃত্যু বলে মানতে চাইছে না। টেস্ট রিপোর্টে পর্যন্ত কারচুপি চলছে সরকারি ক্ষেত্রে। রোগীর মৃত্যু হলে মৃত্যুর কারণ অন্য কিছু বলে জানানো হচ্ছে। অন্য কিছুতে মৃত্যু হলে রোগীর প্লেটেলেট কেন হুহু করে নেমে যাচ্ছে আর চারদিকে প্লেটেলেটের চাহিদাই বা হঠাৎ এত কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না প্রশাসনের কাছে।
এদিকে এলাকায় এলাকায় জঞ্জাল বা জমা জল যে এখনো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে রয়েছে তার আভাস মিলেছে এদিন কলকাতায় টক টু মেয়র অনুষ্ঠানে। নয়াবাদ এলাকা থেকে মেয়র ফিরহাদ হাকিমের কাছে ফোন করে এক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, তাঁর বাড়ির সামনে নিকাশি ব্যবস্থা খুবই খারাপ হয়ে রয়েছে, এলাকায় জল জমে আছে। অপরদিকে ১১৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জনৈক ব্যক্তি ফোনে বলেন, এমজি রোড এলাকায় ভয়ঙ্কর ডেঙ্গু প্রকোপ চলছে। এলাকার জঞ্জাল পরিষ্কার হচ্ছে না। ১০১ নম্বর থেকে ফোনে এক ব্যক্তি বলেন তাঁর এলাকায় নির্মীয়মাণ বাড়ির ফাঁক ফোঁকরে জল জমে রয়েছে, ফলে ডেঙ্গু মশা বাড়ছে। মুখ রক্ষা করতে মেয়র তাঁদের বলেন, এই কাজগুলি করা হবে নিশ্চয়ই। অর্থাৎ এতদিন শুধু প্রচারই হয়েছে কর্পোরেশনের তরফে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি এলাকায়। তবে এদিনও সেই সাধারণ মানুষের সচেতনতাহীনকেই দায়ী করেছেন প্রচার সর্বস্য কলকাতার মেয়র। একই কথা তৃণমূল পরিচালিত রাজ্যের বিভিন্ন পৌরবোর্ডেরও। রাজ্য জুড়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন মানুষ।
Comments :0