স্বর্ণেন্দু দত্ত: অযোধ্যা
এত ঠাণ্ডায় নদীতে পয়সা তোলার জন্য ডুব দিলে অসুস্থ হয়ে পড়ব। তখন আড়াইশো টাকা কামানোর চক্করে হাজার টাকা খরচ হয়ে যাবে ওষুধে। দশটা টাকা হাতে নেই হাজার টাকা ওষুধের জন্য কোথা থেকে পাব? রাজঘাটের পাশে কন্ধরপুরে ঘরের সামনে দিনের বেলাতেই আগুন পোহাতে পোহাতে বললেন সুরজ মাঝি।
কন্ধরপুর সহ নদীর ধারের সব বসতিই মাঝি-মাল্লাদের। দিনমজুরি করে পেট চালান সুরজ। ঘরে বাবা-মা, স্ত্রী, দু’টি সন্তান। ‘গত মাসের ১৫ তারিখের পরে কোনও কাজ জোটেনি। আজ পর্যন্ত ধরলে ৩৫ দিনে ৩৫ টাকা কামিয়ে আনতে পারিনি। এখন লোক আসছে বেশি ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ বলে। নিশ্চয়ই সরযুজীতে পয়সা ফেলবে। কিন্তু এত ঠাণ্ডায় কী যে করি।’’ মাঝির ঘরের সন্তান সুরজ ছোট থেকেই জলে থাকে। নদীতে দান হিসেবে যে পয়সা ফেলে দর্শনার্থীরা, ডুব দিয়ে তা কুড়িয়ে আনে সুরজের মতো আরও কেউ কেউ। ছয়-সাত ঘণ্টা জলে থাকলে যে পয়সা মেলে, মেলা-উৎসবের সময়ে এক-দুই ঘণ্টায় সেটা মিলে যায়। তবে ব্যাপারটা এত সহজ নয়। নদীর পয়সার নিয়ন্ত্রকও আছে। নদীর ঘাটের সমস্ত কাজকর্মের দখল পাণ্ডা অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের। সাধারণ সময়ে যত পয়সা সুরজরা তুলে আনবে নদীর থেকে তার অর্ধেক সে পাবে। বাকি ‘মালিক’-এর। আর উৎসবের সময়ে যত তুলবে তার এক ভাগ মাত্র সুরজদের।
এই অবস্থায় রাত আড়াইটে-তিনটে নাগাদ উঠে ফুল বেচতে ঘাটের পাশে যান সুরজের স্ত্রী। ৮০-৯০ টাকা কিলোতে ফুল কিনে এনে শালপাতার বাটিতে ভরে ১০ টাকা করে বিক্রি করেন। ‘নদীতে যাঁরা স্নান করতে আসেন তাদের বলি নিয়ে নিন মাতাজী, সরযুজীতে স্নান করলে দিতে হয়। বিশ্বাস করে নিয়ে কিনে নেয়।’’ সব সময় বিক্রি হয় না। পচে যায়, তখন আমাকেই সরযুজীতে ফেলতে হয়। ঘাটের ধারের জায়গার দখলদার আছে। তাকে পয়সা দিতে হয়।
সুরজ মাঝির স্ত্রীর নাম মীরা মাঝি। অযোধ্যার মীরা মাঝিকে এখন সবাই চেনে। গত মাসের ৩০ তারিখ মোদীজী এসেছিলেন যে গরিব মীরা মাঝির ঘরে। উজ্জ্বলা যোজনায় বানানো গ্যাসে তাঁর বানানো চা পান করে মোদীজী বলেছিলেন, আমিও চাওয়ালা ছিলাম। তাই জানি চা কেমন করে বানাতে হয়। ‘লাভার্থী’ মীরা মাঝিকে মোদী বলেছিলেন, অযোধ্যা এসে শুনলাম আপনি গ্যাস সিলিন্ডার পেয়েছেন উজ্জ্বলা যোজনায়। সারা দেশে ১০ কোটি মহিলা সিলিন্ডার পেয়েছেন। আপনি সেই ১০ কোটিতম মহিলা। তাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। গরিব এবং জাতিতে মাঝি অর্থাৎ দলিত মীরার ঘরে প্রধানমন্ত্রী মোদীর আসা ‘ভগবান রাম’ এর আসার থেকে কিছু কম ছিল না এই মাঝি-মাল্লাদের এলাকায়।
মীরার বয়ানেই শোনা যাক পুরো ঘটনা। ‘‘সাত-আট মাস ধরে টেড়ি বাজারে গ্যাসের দোকানে সিলিন্ডারের জন্য দৌড়াদৌড়ি করেছি। কিছু হয়নি। মোদীজী যেদিন এলেন, তার আগের দিন বিকেলে গ্যাসের সিলিন্ডার পেলাম। দুই ঘণ্টার মধ্যে তিন-চার জন আধিকারিক এসে গেলেন। বললেন, নতুন গ্যাসে কি বানাবে? বললাম, চা। আমাদের নিয়ম হলো নতুন চুলাতে কিছু মিঠা বানাতে হয়। ক্ষীর বানানোর তো সামর্থ্য নেই, তাই চা-ই বললাম। তখন আধিকারিকরা বললেন, কাল এই সময়ে আমরা আসব। একজন ভিআইপি’ও আসবেন। তিনিও খাবেন। খাবার বানিও।’’
সেই অনুযায়ী পরের দিন ভাত, সবজি বানিয়ে রেখেছিলেন মীরা। আটাও মাখা ছিল। শীতের রাত তাই রুটি বানিয়ে রাখেননি। অতিথিরা এলে রুটি বানিয়ে দেবেন এই ছিল ভাবনা। এত বড় বড় আধিকারিক, কত আর খাবেন তাদের সাধারণ খাবার, এই ভেবে বেশি বানাননি। তবুও সেটার জন্যেও টাকা ধার করতে হয়েছে। ‘‘এক ঘণ্টা আগে আধিকারিকরা বললেন, কোন ভিআইপি তোমার ঘরে আসছে জানো? আমি বললাম না। তখন বললেন, পিএম মোদী আসছেন।’’ এখনও সেই কথা বলার সময়ে মীরার চোখ-মুখে উত্তেজনা ফুটে উঠছে। তারপর মোদীজী এলেন এবং কী কী ঘটল তার প্রতি মুহূর্ত ভিডিও’তে ধরা আছে, সারা দুনিয়া তা দেখেছে এবং ধন্য ধন্য করেছে।
-মোদীজী তো আপনাকে ফুল বিক্রি করা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। তখন আপনাদের রোজগারের এই দুর্দশা নিয়ে বলেননি কেন? মীরা মাঝির জবাব, ‘উনি বলেছিলেন এখন তো লোক বেশি আসছে অযোধ্যায়, ফুলের বিক্রিও বেড়ে গেছে। আমার তো কিছু বলার সুযোগ ছিল না।’ তার সঙ্গেই জুড়লেন সুরজ, ‘‘দেখুন একজন বড় ব্যক্তি যদি সামনে চলে আসেন, আমাদের অত তো বুদ্ধি নেই। ভগবানের মতো উনি এসেছিলেন। ওনার মান-সম্মানে, কথায় এতটাই মোহিত হয়ে গেছিলাম যে নিজেদের দুর্দশার কথা বলার ইচ্ছাই মনে আসেনি। ঘরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে দেখে কথা বলার শক্তিই ছিল না। নিজেদের দুঃখ-দুর্দশা, পীড়া-গরিবী এইসব মাথায় আসেনি। উনি তো রোজগারের কথা জিজ্ঞেস করেননি।’’ এতক্ষণ আগুনের পাশে বসেছিলেন মীরার বৃদ্ধ শ্বশুর। জানালেন, মোদীজী ফোটো নিতে বললেন। সবার সঙ্গে ফোটো নেওয়া হলো। কিছু বলার সুযোগ কোথায় ছিল? মীরা বললেন, ‘‘আবার আসলে বলব, এমন কিছু করুন যাতে রোজগারের ব্যবস্থা হয়।’’ মীরার কথায় সায় দিলেন ইতিমধ্যেই আশপাশ থেকে জড়ো হওয়া প্রতিবেশীরা। এখানের কারো কাজ নেই, সবাই দিহাড়ি মজদুর। কিন্তু অযোধ্যায় যে এই বিশাল নির্মাণ কাজ চলছে? ‘‘সেখানে আমাদের কোনো কাজের সুযোগ নেই। সব ঠিকাদার বাইরের। লেবারও আনছে বাইরে থেকেই’’, বললেন সুরজ।
-মোদীজী তারপর খাবার খেয়ে গেলেন? মীরা বললেন, ‘‘না, খাননি। আমি বললাম খাবার বানিয়েছি। বললেন, এখন সময় নেই। তাই খেতে পারব না।’’ কোনও ছুঁয়াছুঁত না রেখে মোদীজী তাদের ঘরে খাবেন এই নিয়ে প্রথমে খুবই উল্লসিত ছিলেন সুরজ-মীরা। কিন্তু পরে এক পণ্ডিতের থেকে শুনেছেন ‘আসল’ কথা।
মীরা বানিয়েছিলেন ‘কাচ্চি’ খাবার। ভাত-ডাল-রুটি। এখানের ব্রাহ্মণদের কাছে এটা ‘কাচ্চি’ অর্থাৎ ‘কাঁচা’ খাবার, যা অপবিত্র। পাকা খাবার হলো পুরি, সবজি। শুকনো করে বানানো তরকারি যেটাতে জল থাকবে না। সেটা পবিত্র। দলিত মীরার হাতে বানানো কাঁচা খাবার যদি খেয়ে নিতেন ‘ভগবান’, তাহলে এখানের সন্ত-মহন্তদের কাছে কী জবাবদিহি করতেন নয়া অবতার? কীভাবেই বা ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করতেন? তাছাড়া উঁচু জাতের লোকেরাই তো বিজেপি’র চিরকালীন স্থায়ী ভোটব্যাঙ্ক। তাই মীরার ঘরে অবতীর্ণ হয়েও আপন হলেন না ‘ভগবান’।
AYODHYA RAM MANDIR
মীরার ঘরে অবতীর্ণ হয়েও আপন হলেন না ভগবান
×
Comments :0