Editorial

বিভাজনের নাগপাশ

সম্পাদকীয় বিভাগ

মাসাধিককাল থেকে বিভাজনের রাজনীতির আড়ালে জাতি দাঙ্গার আগুনে জ্বলতে থাকা মণিপুরে যাবার সময় বার করতে পারলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কর্নাটক বিভানসভা নির্বাচন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিরদের বিক্ষোভ সামাল দেওয়া, নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন ইত্যাদি ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ কাজে তিনি এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে মণিপুর নিয়ে ভাববার ফুরসত পাননি। ইতিমধ্যে অবশ্য মারদাঙ্গা, লুঠতরাজ, গোলাগুলি, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির ফলে শতাধিক নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জখমের সংখ্যার কোনও হিসাব নেই। শত শত ঘরবাড়ি, দোকানপাঠ আগুনে ভস্মীভূত। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশের গুলিতে ৪০জন জঙ্গি নিহত হয়েছে। যদিও স্থানীয় আদিবাসী সমাজের দাবি এদের কেউই উগ্রপন্থী নন। সকলেই সাধারণ আদিবাসী যুবক। বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে খুন করে জঙ্গি বলে চালানো হচ্ছে। গোটা রাজ্যে দিনের পর দিন চলছে কারফিউ। শান্তি-শৃঙ্খলা, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বলে কিছু নেই। বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস গভীর থেকে গভীরতর। এই অবস্থায় শাহ-র উপস্থিতিতেই মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহের অপসারণের দাবি জোরালো হয়ে উঠে‍‌ছে সব জায়গায়।
শাহ ঘনিষ্ঠ বীরেন সিংহ পক্ষপাত দুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী হিসাটবে পরিচিত। অমিত শাহ-র তৈরি করা বিভাজনের রাজনীতি সূত্র মেনেই তিনি রাজ্য শাসন করছেন। একাংশ বিধায়কের অপছন্দের হলেও ধর্মীয় ও জাতি গত বিভাজনের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির স্বার্থেই শাহ দ্বিতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী করেছেন। তারই পরিণতি আজকের এই অশান্তি-অনিশ্চয়তা। মণিপুরের ভৌগোলিক, জাতিগত ও ধর্মীয় বিন্যাসকে সূচতুরভাবে ব্যবহার করে হিন্দুত্ব রাজনীতির জমি তৈরি করতে যে নোংরা খেলা এতদিন চলেছে তার মূল্য চোকাতে হচ্ছে এখন মণিপুরের সাধারণ মানুষকে।
বর্তমান বিরোধ ও সংঘর্ষের দুই দিকে আছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই জাতি। মোট জনসংখ্যার এরা প্রায় ৬০ ভাগ। মেইতেইরা প্রধানত ইম্ফলকে ঘিরে উপত্যকায় বাস করে। রাজ্যের মোট এলাকার দশ-পনেরো শতাংশ এই উপত্যকা। বাকি অঞ্চল পাহাড়ি। সেখানে বাস করে কুকি, চিন, মিজো, যোমি, হামর প্রভৃতি উপজাতিরা। তাদের মধ্যে কুকিরাই প্রধান। এই উপজাতিদের সঙ্গে জাতিগত সম্পর্ক রয়েছে সীমান্তের ওপারে মায়ানমারের আদিবাসীদের। সেখানে সামরিক শাসনের হিংসার বলি হয়ে অনেকে আশ্রয় নিচ্ছে এপারে। বিজেপি এদের অনুপ্রবেশকারী জঙ্গি মনে করে। তাই কেন্দ্রের চাপে বীরেন সিংহ সরকার এদের উচ্ছেদ ও বিতাড়ন অভিযান চালিয়ে অশান্তির আগুন জ্বালিয়েছে। জঙ্গি মোকাবিলার নামে কার্যত আদিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে বিজেপি সরকার। আদিবাসীরা ধর্মীয়ভাবে খ্রিস্টান। রাজ্যে হিন্দু ও  খ্রিস্টান প্রায় সমান সমান। মেরুকরণের জন্য বিজেপি’র স্বাভাবিক পছন্দ হিন্দুপ্রধান মেইতেইরা। অপছন্দের তালিকায় খ্রিস্টান আদিবাসীরা। তাই গত কয়েক বছরে প্রায় ৩০০ গির্জায় হামলা চালানো হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে বনাঞ্চল থেকে। মেইতেইদের সঙ্গে কুকিদের বিরোধ বাধিয়েছে সূক্ষ্মভাবে প্ররোচনা সৃষ্টি করে। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই বিভাজনের কৌশল প্রয়োগ করেই বিজেপি দ্বিতীয়বার জয়ী হয়েছে। মোদী যথারীতি ডাবল ইঞ্জিনের তত্ত্ব আউড়েছিলেন। বিভাজনের রাজনীতি সচল রাখতে তাই বীরেন সিংহকেই বেছে নেন অমিত শাহ। তাই আজকের মণিপুরের দায় শুধু মুখ্যমন্ত্রীর অপদার্থতা নয়, দায়ী মোদী শাহদের ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজনের ষড়যন্ত্র।

Comments :0

Login to leave a comment