Post Editorial

ইতিহাস মাথায় রাখতে হবে

সম্পাদকীয় বিভাগ

Post Editorial

আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা, লোকসভা এই দুটোকেই ভোট বলতে লোকে বুঝতো। এখন তো বামেদের তিনটি রাজ্য সরকারের কল্যাণে পঞ্চায়েত আর পৌরসভার নির্বাচনও রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক দিয়ে কম যায় না। ফলে প্রতি ৫ বছরে ৪টি মেগা রাজনৈতিক ইভেন্ট হচ্ছে ভোটে। রাজীব সরকারের উদ্যোগে কংগ্রেসীদের সংবিধান সংশোধনের ফলে পঞ্চায়েত এবং পৌরসভার নির্বাচনকে বাধ্যতামূলক করতে হয়েছে। 

 

 

 

রাজীব গান্ধী পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতের কাজকর্ম দেখে সংবিধানে এই সংশোধনটি করতে অনুপ্রাণিত হন।
পঞ্চায়েত বা কোনও রকমের বুর্জোয়া নির্বাচনের(সে লোকসভা হোক আর বিধানসভা হোক না কেন) সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে কমিউনিস্টরা কতটা গুরুত্ব দেবে অথবা দেবে না – এই বিষয় নিয়ে কমিউনিস্ট এবং বামপন্থী গণতান্ত্রিক এবং দেশপ্রেমিক জনগণের মধ্যে একসময়ে এদেশে তুমুল বিতর্ক হয়েছে। ভোট নয়, ক্ষমতার উৎস বন্দুক ও সশস্ত্র জনগণ – এই স্লোগান দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হলো সব দেওয়াল। বাম সংকীর্ণতাবাদ নকশালপন্থী নামে পরিচিত হয়ে রাজ্য জুড়ে (দেশের সর্বত্র না হলেও আমাদের রাজ্যে তো বটেই) অনেক খুন খারাবি করল। নিজেরাও খুন হলো। এখন দেশের কোথাও কোথাও গভীর জঙ্গলে ঘাঁটি করে এদের কেউ কেউ লুকিয়ে আছে।
আমাদের ওরা সংশোধনবাদী বলে। আমরা ওদের হটকারী আর সংকীর্ণতাবাদী বলি। আর সাথে সাথে আমাদের অবস্থান বিশেষ করে আম জনতার কাছে পরিষ্কার করি। নির্বাচন ও ভোট আমাদের কাছে চরমতম ও পরমতম লক্ষ্য নয়। শেষ পর্যন্ত শত্রুর হিংসার জবাব ব্যালট পেপারে দেওয়া সম্ভব নয়। ভোটে জেতা যদি বা সম্ভব – একা অথবা কোয়ালিশন গড়ে। 

 

চিলিতে শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি ও বাম আন্দোলন আলেন্দের নেতৃত্বে ভোটে জিতে সরকার গড়তে গিয়ে পালটা প্রতিক্রিয়ার আক্রমণে সমুদ্র রক্তে লাল হয়ে গেল। ভেনেজুয়েলা আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে পরিচিত বামপন্থীরা ভোটে জিতে সরকারে আসছেন। মার্কিন ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি বামপন্থীদের নেতৃত্বে এই সব সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম দিন থেকে ষড়যন্ত্র করছে। 

 

 

 

 

 


অনেক কিছুর মধ্যে বাম, ডান বা রাম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বা মনোভাব এখন পালটাচ্ছে। যিনি বা যে দল কংগ্রেস উত্তর রাজনীতির পালটা পালটির ধার ধারেন না তিনিও কার্যত নতুন কিছু কথা-কাজ শুরু করে দিয়েছেন, নিজের অজান্তেই , অন্যদিকে পুরাতন কিছু দেওয়াল লিখন অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে, রোদে, এবং জলে আর ধুলোর ঝড়ে।

এদেশে আমাদের অভিজ্ঞতা কিছুটা স্বতন্ত্র হলেও আসল নীতিগত প্রশ্ন অন্যরকম। ‘স্বতন্ত্র’ কারণ ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কোথাও কোথাও কমিউনিস্টরা বাধ্য হয়ে ক্ষমতায় আছে। কিন্তু আসল যে সরকার – যাদের চেপে রাখতে গিয়ে রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রীকেও ঘাম মুছতে শাড়ির আঁচল ব্যবহার করতে হয়, সেই কেন্দ্রীয় সরকার এক আমলে ছিল কংগ্রেসের দখলে, আর ১৯৭৭-এর পর কংগ্রেস এবং সোস্যালিস্টরা ভেঙে যে জনতা দল হলো যার ফলে হিন্দু-হিন্দু করা আরএসএস পরিচালিত জনসঙ্ঘ পরে যা বিজেপি হয় – তারাও ছিল। লড়াইয়ে কমিউনিস্টরা থাকলেও সরকারে যোগ দেয়নি। 

 

 

 

 


যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সুবিধা-অসুবিধা দুইই আমরা দেখেছি। বিশেষ করে পার্টির নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার ৩৪বছর একটানা এই গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যটি পরিচালনা করার পর। কেরালা,  ত্রিপুরার এই পথে অভিজ্ঞতা উজ্জ্বল এবং সুদূরপ্রসারী। ঘটনার ক্ষিপ্রতা এবং দ্রুততায় পার্টির বোঝাপড়া উন্নত করতে এবং রাশিয়া ও চীনের মহান বিপ্লবী পার্টিদুটির সব কথাকে নির্দেশের ন্যায় মান্যতা না দিয়ে স্বাধীনভাবে সব দেখা শোনার অধিকার নিয়ে দলীয় অবস্থানকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হন আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ। অনেক দেশে কমিউনিস্ট পার্টি উঠে যায়, অনেক জায়গায় কমিউনিস্ট সাইনবোর্ড খুলে ফেলে। আমরা নিজেরা ভেবে চিন্তে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়কর পতনের কারণগুলি অনুসন্ধান করি এবং পার্টিকে রক্ষা করেছি। 

 

 

 

 


তার মানে এই নয় যে আমরা কোনও শিক্ষা নিইনি। বা আমাদের ঔদ্ধত্য চীনের মহান বিপ্লব বা রাশিয়ার দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনের অক্টোবর থেকে আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে রেড আর্মির অভাবনীয়তায় হিটলার, মুসোলিনি এবং তোজোর সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে  এবং পরবর্তীতে নিজের কোমরের জোরে নিজের নিজের দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করা, বেকারি, ক্ষুধা আর শোষণ শাসন থেকে জনগণের মুক্তির প্রশ্নে তাদের জাজ্বল্যমান অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কিছু শেখার নেই! যা জেনেছি, যা শিখেছি সব ঠিক হ্যায় – বলার ধৃষ্টতা  বা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করা যায় না। 

 

 


পরবর্তী সময়ে আমাদের পার্টি কংগ্রেসে এ বিষয়ে প্রস্তাব “ কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় সম্পর্কে প্রস্তাব’’ গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবনায় মতাদর্শগত প্রশ্ন গভীরভাবে পার্টিতে আলোচনা করা হয়, আত্মসমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। যে মতাদর্শগত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, তাকে কার্যকর করার জন্য পার্টির কর্মসূচিকে সময়োপযোগী করা হয় কয়েক বছরের মধ্যে। মতাদর্শগত দলিলটিও পরবর্তী পার্টি কংগ্রেসে আরও সমৃদ্ধ করা হয়। লেনিনের দেশে সমাজতন্ত্র নেই। এর মানে কি? বিপুল পরিবর্তন। লাইন দিয়ে সোভিয়েতের পশ্চিমে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের পতন ঠেকানো গেল না। বিরাট পার্টি চীনের। তারা সমাজতন্ত্রের পতন রুখে দিল এবং তাদের মতো করে সমাজতন্ত্রের কাজ শুরু করল।

 

 

 


সমাজতন্ত্রের বিরোধী শক্তিকে পরিচালনা করছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। এখন পৃথিবী এক বিশ্বের দেশ অর্থাৎ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অধীনে এক শক্তিধর বিশ্ব। কসোভা, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া বা যুগোস্লাভিয়া দেশ ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল। রাষ্ট্রপ্রধান মিলোশোভিচকে খুন করল। 
সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প এই মহাদেশে কত না রক্তের হোলি খেলল। হিন্দুদের মধ্যে মুসলমানদের সম্পর্কে সন্দেহ, অবিশ্বাস এবং ঘৃণা সৃষ্টি করো। আর মুসলমানদের মধ্যে এটা একইভাবে হিন্দুদের সম্পর্কে গড়ে তোলো। ইস্যু যত ক্ষুদ্রই হোক হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধানো এদেশে খুব কঠিন কাজ নয়। আর রামরাজ্য হবে আর সেই রাজ্য 

 

 

পরিচালনার জন্য হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে উঠলে তো কথাই নেই। ওদের গুরু গোলওয়ালকার বলেছেন যে আরএসএস যখন বলে এই  সমস্ত ধর্মের অন্তর্গত মানুষের বিরুদ্ধে, তখন আবার একদল মানুষ এদেশে আছেন যারা সোচ্চারে বলে ওঠেন যে ওরাও তো ভারতবাসী! গোলওয়ালকার একটু ব্যাখ্যা করে বললেন, যে মুহূর্তে ওরা হিন্দুধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্মে যোগ দিয়েছে সেই মুহূর্ত থেকে ওদের মধ্য থেকে ভারতীয়ত্ব চলে গিয়েছে। ওরা পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ওদের ভগবান খুঁজে বেড়াক।

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি যে মমতা ব্যানার্জি বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেবার উপযুক্ত নন, আর প্রধানমন্ত্রীর তো প্রশ্নই ওঠে না। এর আগে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারে দুবার মন্ত্রী হয়েছেন। একবার তো রেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে। একমাত্র রেল দপ্তরের বাজেট আলাদাভাবে পার্লামেন্টে পেশ হতো। রেলের লভ্যাংশ যা হতো তা থেকে তারা দেশের পূর্ণ সময়ের বাজেটে অনেক টাকা দিত। সব রেলমন্ত্রী এটা করেন। মমতা দেশে জনপ্রিয়তা বাড়াবার জন্য রেলের ভাড়া বাড়ালেন না যতদিন ছিলেন। বরং চালু ট্রেনগুলির নাম পালটিয়ে বা শুরু বা শেষের স্থান একটু পরিবর্তন করে এবং গরিব নাম লাগিয়ে বললেন – আমি কতগুলি ট্রেন করেছি। আর রেলকে কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে আরও অর্থ বরাদ্দ না করায় আমার প্ল্যান কার্যকর হচ্ছে না। দৃষ্টি তার নিবদ্ধ রাইটার্সের দিকে। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে তাকে আহ্বান করছে রাজ্যবাসী।

 


পশ্চিমবাংলা রাজনীতির ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক এবং সজাগ ও সংবেদনশীল একটি রাজ্য। মিছিল, মিটিংয়ে অংশগ্রহণের মধ্যে এবং রাজনীতির ব্যাপারে উৎসাহভরে চেতনা বাড়াতে তারা উৎসাহী। এরকম রাজ্য দেশে কম আছে। ফলে ১৯৬৭-র পর অর্থাৎ প্রথম যুক্তফ্রন্ট হবার পর রাজ্যে শ্রেণিসমূহের ভারসাম্য কিছুটা পরিবর্তিত হয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল জাগে একটু পরে। কমিউনিস্টরা কাজ করতেন কৃষক সমাজের মাঝে। কিন্তু তাঁরাই শেষ কথা বলছেন এরকম হয়নি। তাই কৃষকরা যখন বেআইনি জমি দখলের ডাক পেলেন আর জ্যোতি  বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙাররা ডাক দিলেন কৃষকদের কাছে যে – আপনারা জোতদার-জমিদারদের সিলিং বহির্ভূত যে জমি আছে তা দখল করুন। বাঁধভাঙা জলপ্রপাতের জলরাশির মতো কৃষকরা আছড়ে পড়লেন এবং গ্রামদেশে কমিউনিস্টরা পৌঁছালেন এক অন্য উচ্চতর স্তরে। এর সাথে আছে তেভাগার আন্দোলন আর গ্রামীণ মানুষের ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রামের উজ্জ্বল অধ্যায়—জমির অর্থনৈতিক ইস্যু, ভোট, এমপি, এমএলএ আর সরকার গঠনের রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হলো। 

 

 


শ্রমিক শ্রেণির কাছে যুক্তফ্রন্টের আহ্বান—  কিন্তু শুধুমাত্র শিল্পপতিদের না– শ্রমিকদের ও দায়িত্ব আছে শিল্পকে রক্ষা করার। আর শ্রমিক স্বার্থে বিভিন্ন দাবির আন্দোলনে পুলিশ কারখানার গেটে যাবে না। এক একটা শিল্পে ঐতিহাসিক ধর্মঘট হলো। ধর্মঘট ভাঙা ছিল পুলিশের কাজ। আর মালিকের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে শ্রমিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা। সে সব করাও পুলিশের মুশকিল হলো। কারণ একদিকে বড়লোক আর জোতদারদের জমি নিতে বলছেন জমির মন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোঙার আর কারখানার গেটে পুলিশ যাতে শ্রমিকদের মারতে বা গ্রেপ্তার করতে যেতে না পারে তার জন্য আছেন যুক্তফ্রন্টের নেতা জ্যোতি বসু। বাংলার উত্তরণ হলো নতুন পর্যায়ে। ওরা সরকারটাই ফেলে দিল। রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হলো। কিন্তু ’৬৯-এ আবার জিতে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হলো। লক্ষ লক্ষ বর্গাদারের নাম রেকর্ড করা হলো। এসবের ফলে গ্রামে গ্রামে লাল ঝান্ডার পেছনে হাজার হাজার মানুষ শামিল হলেন। সঠিক নেতৃত্বদানের জন্য পার্টিও বড় হলো। 

 


দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারও দিল্লি থেকে ভেঙে দেওয়া হলো। এরপর সিদ্ধার্থ জমানা। জাল জালিয়াতির নিকৃষ্টতম উদাহরণ ’৭২-এর নির্বাচন। যা টানা ৫ বছর আমরা বয়কট করেছি। এও এক সংগ্রাম। বিধানসভা বয়কট করা কাকে বলে মানুষ দেখলেন। কিন্তু মাঠে ময়দানে আমাদের বর্ধিত শক্তি নিয়ে আমরা লড়াই করে গেলাম আর আমাদের ১১০০ কমরেড খুন হলেন। হাজার হাজার বামপন্থী বিশেষ করে আমাদের পার্টির কর্মী ও সমর্থক বাড়ি থাকতে পারত না। তাও দু-চার মাস নয়, বছরের পর বছর। পার্টি সংগঠনে নতুনত্ব আনতে হলো। গোপনে কাজ করা শিখতে হলো। আজকের স্বেচ্ছাসেবী আগামী দিনের মুক্তিফৌজ। এই আহ্বানে সাড়া দেবার মতো বুকের পাটা পার্টির ছিল। 

 

 


দেশের রাজনীতিতে যদি একটা বড় পরিবর্তন না আনা যায়, তাহলে কি শুধু বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে নয়াদিল্লি থেকে যে দৈত্য দানবরা দেশটা নিংড়ে খাচ্ছে, তাদের দমন করা সম্ভব ? তার জন্য রাজ্যে রাজ্যে শক্তি সমবেত করা এবং ঐক্যবদ্ধ করা প্রয়োজন। অত্যাচারই শেষ কথা বলে না— ইতিহাসের এই শিক্ষা ঘুরে ফিরে এল পশ্চিমবাংলার সচেতন, নির্ভীক কমরেডদের কাছে। নীতিগত অবস্থান ঠিক রেখে পার্টিকে নমনীয় কৌশল নিতে হবে। যাতে নতুন বাঁক ও মোড়ের সামনে সে ঠিকমতো শত্রুকে চিনতে পারে, বুঝতে পারে – এবং লড়াই করে কোণঠাসা করতে পারে। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহৃত হলো। ইন্দিরা সরকারের পতন হলো। নতুন নির্বাচন, স্বাধীনতার পর প্রথম অকংগ্রেসী সরকার গঠিত হলো দিল্লিতে। মোরারজী দেশাইর নেতৃত্বে জনতা সরকারে জয়প্রকাশ নারায়ণ অভিভাবক ছিলেন। দেশে আমাদের পার্টির সম্মান বাড়ল।
নতুন পরিস্থিতি অনুকূল শুধু নয়, খুবই অনুকূল। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় জোতদার, জমিদাররা কমিউনিস্টদের চিনেছে, জেনেছে। তাদের রাজনৈতিক জমি অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে সিপিআই(এম)। তাই বিধানসভায় জোট করল না বাংলা কংগ্রেস। আলাদা আলাদা লড়াই করা হলো কংগ্রেসের সাথে এবং জনতা দল লড়ল আমাদের বিরুদ্ধে। বাংলার মানুষ আর একবার প্রমাণ করলেন তাদের চেতনার সঙ্ঘশক্তির। বামফ্রন্ট সরকার হলো বিপুল সংখ্যাধিক্যে। পথ চলা শুরু হলো বামফ্রন্ট সরকারের। 

 

 


বামফ্রন্ট তাদের নীতিগত ঘোষণা এবং অবস্থান থেকে গ্রামীণ বাংলার স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং মর্যাদা দানের প্রশ্নটা আগে ভাবল। নতুন করে পঞ্চায়েত আইন হলো। গ্রামাঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মানুষ জমি পেয়েছেন, বর্গা রেকর্ড করিয়েছেন। মজুররা মজুরি বাড়িয়েছেন– চাষিদের সাথে একজোট হয়ে। ফসল উৎপাদনে পশ্চিম বাংলা এক নম্বরে চলে গেল। বিশেষ করে ধান, সবজি আর আলুতে। অর্থাৎ গ্রামীণ গরিব মানুষের অবস্থা একটু ভালো হলো। তারা শহরে শিল্পে যা তৈরি হয় সে সব সামগ্রী কিনতে শুরু করলেন। শেষ দিকে প্রায় ৩০ কোটি টাকায় সেটা পৌঁছালো। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ল। কংগ্রেসের ইন্ডোর স্টেডিয়াম দেখিয়ে লোকে বিদ্রুপ করে বলত – বিদ্যুতের খাতের টাকায় ঝকঝকে চকচকে স্টেডিয়াম! যেমন ১০০দিনের টাকায় এখন অনেক দুর্গাপুজো হচ্ছে। ক্লাবে মস্তি হচ্ছে আর পুজোর পরেও সারাদিন ধরে সাধারণতন্ত্র দিবসের মতো করে কার্নিভাল হচ্ছে। 
বক্রেশ্বর দিয়ে এখন ধোঁয়া উড়ছে। শত শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এই বক্রেশ্বরে কেন্দ্র সাহায্য তো করেইনি বরং বিদ্রুপ করে বলেছে যে বাচ্চা কাচ্চাদের রক্ত বেচে জ্যোতি বসু বিদ্যুৎ কেন্দ্র করবেন! সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলো। উৎপাদিত বিদ্যুৎ সবার মাথা ঠান্ডা রাখছে – মমতার নবান্নেও সেই বিদ্যুৎ মেইন লাইন দিয়ে আসছে। 

 

 


হলদিয়াও শেষ পর্যন্ত হলো। ইলেকট্রনিক্স ও অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে হলো। এখন শুধু বিধান নগর আর জ্যোতি বসু নগরে (নিউ টাউন) প্রায় দুই লক্ষের মতো ছেলে মেয়ে এবং এক্সপার্টরা তথ্য প্রযুক্তিতে কাজ করেন। অনেকবার প্রশ্নটা করা হয়ে থাকে। আবার ও প্রশ্নটি করছি। সারা রাজ্যে একজন মানুষ খুঁজে বার করুন যিনি বলবেন যে আমি বামফ্রন্ট সরকার হবার আগে ঐ রাজ্যে তথ্য প্রযুক্তিতে কাজ করতাম। মমতা তো এসব ভাবেই না। ওর ভাষণ নন্দীগ্রামে যা, সিঙ্গুরে তা, সেক্টর ফাইভেও তাই – সিপিএম হটাও। দিল্লি টাকা দিচ্ছে না। ওরা কোটি কোটি টাকা ধার করে গেছে। এখন সেসব আমাদের শোধ করতে হচ্ছে! 


তৃণমূল এবং বিরোধী দলের লোকেরা দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি এঁকেছিল জ্যোতিবাবুর হাতে হ্যারিকেন দিয়ে – ‘জ্যোতিবাবু যেখানে, লোডশেডিং সেখানে’। আজ লোডশেডিং না থাকারই মতো। জ্যোতি বসু সহ নেতৃত্ব বক্রেশ্বর করে ছেড়েছেন। শিল্প, বাণিজ্য, বাড়ি, নতুন উন্নয়নের কাজ করতে গেলে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। আজ মমতা ব্যানার্জি দেশের বিভিন্ন রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে ধ্বনি তুলেছেন যে এবার তাঁরা শিল্পের উপর জোর দেবেন। তখন বিদ্যুতের প্রশ্নটি ইতিবাচকভাবে তিনি উপস্থাপন করেন এবং বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে বিশেষ করে প্রথম ১০/১৫ বছরে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র সহ বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছিল তা লজ্জার সঙ্গে স্মরণ করেন কিন্তু স্বীকার করেন না। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে যে বামফ্রন্ট বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে পথ দেখিয়েছে। লোডশেডিং এর লজ্জা থেকে রাজ্যকে মুক্তি দিয়েছে। আজ শুধুমাত্র লোডশেডিং নেই তা নয় । আজকে কলকারখানাও নেই। কারখানা সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। মমতাকে বলুন একটা কারখানার নাম করতে যেখানে ৬০/৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লাগে নতুন করে ১১/১২ বছরে উনি করে দিয়েছেন।

 

 

 

মরুভূমির বুকে মমতা রাজত্ব চালাচ্ছেন। থানার পুলিশ এফআইআর নেয় না। শহর গ্রামে রাজত্ব চালাচ্ছে হাতকাটা গুন্ডার দল। শটগান, পিস্তল, রিভলভার সবার হাতে হাতে ঘুরছে। মমতার দল থাকবে না। কিছুদিন বাদেই লোকে বুঝবে মমতা অ্যাসেট নন লায়েবিলিটি। মমতাই দায়ী। তা নাহলে জজসাহেব বলেন সিবিআই-কে যে শিক্ষামন্ত্রীর উপরে আর কেউ আছে? না সিঁড়ি ভাঙার অঙ্ক এখানেই শেষ? আমার জীবদ্দশায় মনে হয় সেটা দেখতে পাব না। এখন মানিক এবং পার্থবাবুর হাতে মমতার রাজনৈতিক জীবন। অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের দূর প্রান্তে একটি দ্বীপে যুব তৃণমুল কংগ্রেসের বিনয় মিশ্র আর কতদিন অনন্ত জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকবে? ওর ব্যাপারটা সিবিআই, ইডি ফয়সালা করতে পারলে তারও উপর কে আছে সেটা জানা যাবে। এখন জানলেও বলা যাচ্ছে না। কারণ প্রমাণ আছে যেখানে, সেখানে সিবিআই, ইডি একেবারে নিশ্চুপ।
আজ বিচারালয়ের থেকে সব ক্ষেত্রে পছন্দমতো রায় পাচ্ছেন না । অপ্রচলিত রায় বরং বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের ধারণা কিছুটা পালটে দিচ্ছে। যদিও সামাজিক ব্যবস্থা শুধুমাত্র কয়েকজন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির সাহস এবং নির্লোভ মনোভাবের মধ্যে প্রকাশ পেলেও দেশের এবং রাজ্যের বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে বিচারপতি নিয়োগ থেকে বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে গভীরে গিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে। জনগণ এসব জিনিস খুব আগ্রহ এবং উৎসাহের সঙ্গে আলোচনা করছেন। সারা দেশের বিচার ব্যবস্থার মধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের মাথা উঁচু হচ্ছে।
দেশ, দল,সরকারের কাজ সব কিছুই একা করতে গেলে যা হয় তাই হয়েছে মমতার ক্ষেত্রে। সেটা মমতা ভালো জানেন। কদিন আগে কালীঘাটের বাড়িতেও নেতাদের বৈঠকের পর মমতা বললেন, নতুন নেতৃত্ব হলো। তারা দল চালাবেন অথবা সরকারের কাজকর্ম চেকআপ করবেন। গাইড লাইন অনুযায়ী সব ঠিকঠাক চলছে কিনা দেখবেন। 

 

 

কিন্তু পার্টিতে কোনও শেষ কথা বলার দরকার হলে সেটা বলব আমি – মমতা ব্যানার্জি। এভাবে একটা ক্লাবও চলে না একজনের কথার মাধ্যমে। একাধিক নেতা মিলে পার্টি চালাবেন এটা স্বাভাবিক। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনও নেতা মমতার এই ঘোষণার পর পার্টির কাজের ব্যাপারে আর কোনও প্রশ্ন করবেন? তৃণমূলের দলে একটা তির্যক মন্তব্য চলে,তাও সিনিয়ার নেতাদের কাছ থেকে যে: ‘বাজার করো ঘুরে ঘুরে/ মমতা করো দূরে দূরে’।
যা হয় বিনাশকালে – তৃণমূলের তাই হচ্ছে। 

Comments :0

Login to leave a comment