ভারতের ভাণ্ডারে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। খোদ কেন্দ্রীয় সরকার শনিবার এক বিবৃতিতে তথ্য সহ এই খবর জানিয়েছে। মূলত গম ও চালের মজুত ভাণ্ডারের তথ্য দিয়ে সরকার জানিয়েছে, সারা বছর ধরেই এদেশে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যের মজুত রয়েছে।
কেন্দ্রের এই ঘোষণায় সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি ভাঁড়ারে উপচে পড়া খাদ্যশস্য থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান প্রতি বছর নামছে কেন? কেনই বা প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ কার্যত ভুখা পেটে অথবা অর্ধভুক্ত অবস্থায় রাতে ঘুমোতে যান? তবে যথারীতি এসব প্রশ্নের কোনও জবাব নেই সরকারি বিবৃতিতে!
এদিন কেন্দ্রীয় ক্রেতা বিষয়ক মন্ত্রকের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ‘‘জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন (এনএফএসএ) ও অন্যান্য কল্যাণ প্রকল্পের চাহিদার মেটানো এবং প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা (পিএমজিকেএওয়াই)’য় অতিরিক্ত বরাদ্দের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে কেন্দ্রীয় ভাণ্ডারে।’’
মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, আগামী বছরের ১ জানুয়ারি সরকারি ভাঁড়ারে প্রায় ১৫৯ লক্ষ টন গম এবং ১০৪ লক্ষ টন চাল মজুত থাকবে। অথচ আপৎকালীন মজুতের সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি দেশের ভাণ্ডারে থাকার কথা ১৩৮ লক্ষ টন গম এবং ৭৬ লক্ষ টন চাল। মন্ত্রক জানাচ্ছে, গত ১৫ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ভাণ্ডারে মজুত ছিল প্রায় ১৮০ লক্ষ টন গম এবং ১১১ লক্ষ টন চাল।
উল্লেখ্য, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছরের ১ এপ্রিল, ১ জুলাই, ১ অক্টোবর, এবং ১ জানুয়ারি এই চারটি দিনে আপৎকালীন মজুত ঠিকঠাক রাখতে হয়।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে এদিনের বিবৃতিতে মন্ত্রক জানিয়েছে, এদেশে সবসময় আপৎকালীন মজুত নিয়মের অনেক বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত থাকে। যেমন, এবছরের ১ অক্টোবর দেশের মজুত ভাণ্ডারে ছিল প্রায় ২২৭ লক্ষ টন গম এবং ২০৫ লক্ষ টন চাল। অথচ আপৎকালীন মজুতের নিয়ম হলো, ১ অক্টোবরে অবশ্যই ২০৫ লক্ষ টন গম এবং ১০৩ লক্ষ টন চালের মজুত রাখতে হবে।
মন্ত্রক উল্লেখ করেছে, ‘‘গত মরশুমে গমের সংগ্রহ খানিকটা কম হয়েছিল। কিন্তু ভাণ্ডারে এত গম মজুত রয়েছে যা দেশের প্রয়োজন মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট। এমনকি গম তোলার পরবর্তী সময় পর্যন্ত চাহিদা মেটাতেও কোনও অসুবিধা হবে না।’’ একইসঙ্গে মন্ত্রক মনে করিয়ে দিয়েছে, ‘‘তাও গমের মজুত বাঁচানোর জন্য এনএফএসএ এবং পিএমজি-কেএওয়াই’তে বরাদ্দের নিয়ম বদলে গ্রাহকদের গম কম দেওয়া হচ্ছে। পরিবর্তে চাল বেশি দেওয়া হচ্ছে।’’
প্রসঙ্গত, এনএফএসএ অনুযায়ী পিএমজিকেএওয়াই প্রকল্পে দেশের প্রায় ৮০ কোটি মানুষকে প্রতি মাসে ৫ কেজি করে খাদ্যশস্য বিনামূল্যে দেওয়া হয় বলে দাবি কেন্দ্রের।
এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, দেশে এত খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত হওয়া সত্ত্বেও তা গরিব মানুষকে খাওয়ার জন্য দেওয়া হয় না কেন? বিশেষত বামপন্থীরা বহুদিন ধরেই প্রতি পরিবারে মাসে ৩৫ কেজি করে খাদ্যশস্য বিনামূল্যে বিতরণের জন্য কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে। এই দাবিতে কানই দিচ্ছে না মোদী সরকার। এমনকি করোনার মহামারীর লকডাউনের সময়ে কোটি কোটি মানুষ যখন কাজ হারিয়েছিলেন, তখনও এই দাবি মানেনি কেন্দ্র।
দেশে পর্যাপ্ত সুরক্ষিত গুদামের অভাবে ঝড়-জলে প্রতি বছরই প্রচুর খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে যায়। গুদামের অভাবে খোলা জায়গায় খাদ্যশস্যের বস্তা ফেলে রাখা হয়। বৃষ্টিতে ভিজে সেসব খাদ্যশস্য দ্রুত পচে গিয়েছে অথবা ইঁদুর ইত্যাদিতে খেয়ে গিয়েছে এমন খবরও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে বারবার। এই অবস্থায় এর আগেও একাধিকবার সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে সুপারিশ করেছিলো, খাদ্যশস্য এভাবে নষ্ট না করে তা গরিব মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু তাও কানে তোলেনি সরকার।
এর মধ্যেই ভারতে ক্ষুধার্ত মানুষের ভয়াল সংখ্যা প্রচারিত হওয়ায় বিশ্বজুড়ে দেশের সরকারি ব্যবস্থা সম্পর্কে জোরালো প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (ফাও)’র সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে প্রতি বছর ভারতের স্থান নেমেই চলেছে। দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালের ক্ষুধা সূচকে ১২৩ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয়েছে ১০৭ তম। আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে এই স্থান ছিলো ১১৬ টি দেশের মধ্যে ১০১ তম। ২০২০ সালে ফাও জানিয়েছিলো, ক্ষুধা সূচকে ১০৭ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৯৪ তম। লজ্জাজনকভাবে বছরের পর বছর পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশও ক্ষুধা সূচক তালিকায় ভারতের ওপরে থাকছে!
রাষ্ট্রসঙ্ঘের সমীক্ষা জানিয়েছে, না খেতে পাওয়ার কারণে বর্তমানে অপুষ্টিতে ভুগছেন বিশ্বের ৮২ কোটি মানুষ। এর মধ্যে রয়েছেন ২২.৪৩ কোটি ভারতবাসী। এই সংখ্যা বিশ্বের অপুষ্টি আক্রান্ত জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ। অপুষ্টি জনিত কারণেই ভারতে দ্রুত বেড়ে চলেছে যক্ষ্মার মতো মারণ রোগও।
এমন পরিস্থিতিতে গত ৬ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টও ফের কেন্দ্রকে মনে করিয়ে দিয়েছে, ‘‘দেশে কেউ যেন অভুক্ত না থাকে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।’’ একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি এমআর শাহ এবং হিমা কোহলির বেঞ্চ তাৎপর্যপূর্ণ ভাষায় বলেছিলো, ‘‘কেউ যেন খালি পেটে ঘুমোতে না যায় তা নিশ্চিত করাই আমাদের সংস্কৃতি।’’ বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ ছিল, ‘‘দেশের সর্বশেষ মানুষটিকেও খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় এনে তাঁর কাছে খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কিনা তা দেখা উচিত সরকারের।’’
কিন্তু কোনও সমীক্ষা, কোনও পর্যবেক্ষণ, অনাহার-অর্ধাহারের কোনও ঘটনাই এপর্যন্ত মোদী সরকারকে লজ্জা দিতে পারেনি, বলছেন পর্যবেক্ষকরা।
Comments :0