INSAF JATRA

কোনও শাসকই অপ্রতিরোধ্য নয়

উত্তর সম্পাদকীয়​


মানবেশ চৌধুরি

জয় যাত্রায় যাও গো,  ………..
যাত্রাপথের দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকছেন ভিড় করে মানুষ আর মানুষ।  শিশু-কিশোর-কিশোরী-যুবক-যুবতী, মাঝ বায়সি, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। তাদের কারো হাতে ফুল, তারা দিচ্ছেন উপহার, সামান্য উপহার, প্রাণের ষ্পর্শ লেগে যা হয়েছে মহার্ঘ্য, সেই সামগ্রী উপহার দিচ্ছেন কেউ, কেউ হাত মেলাতে ব্যাগ্র মীনাক্ষী মুখার্জি ও অন্যান্যদের সঙ্গে, কোনও শহীদের জননী কান্নায় আকুল হয়ে মীনাক্ষীর বুকে আশ্রয় খুঁছছেন। জঙ্গলমহল, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম— মাওবাদী ও তৃণমূল জল্লাদ বাহিনী যেখানে সাথিদের নির্বিচারে খুন করেছে, যেখানে যোগ দিয়েছেন শহীদ জননী ছিতামণি সরেন এবং শহীদ পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়জন— সেই এলাকার পথ দিয়ে যখন ইনসাফ যাত্রা চলছে, তখন এক মহৎ বিপ্লবী আবেগ সবার মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে। কোথাও গণসঙ্গীত গাইছেন সাথিরা। কোথাও হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 
আদিবাসী পুরুষ তাঁদের চিরাচরিত পোশাকে ধামসা–মাদল-নাগরা বাজাতে বাজাতে আর নারীরা নাচতে নাচতে চলেছেন, কোথাও নতুন ধানের শীষ সাজিয়ে মাথায় নিয়ে সঙ্গী হয়েছেন কৃষক-খেতমজুর মহিলারা, কোথাও বহুরূপীর নানা বেশে শিল্পীরা হাঁটছেন মিছিলের সঙ্গে, কোথাও কয়লা খনির মজুর, কোথাও জল-জঙ্গল-জমির অধিকারের লড়াই করা আদিবাসী ভাই বোনেরা হাঁটছেন তাঁদের সঙ্গে। হাঁটছেন, করোনাকালে কাজ হারিয়ে, আমেদাবাদ থেকে হাঁটাপথে বাংলায় আসা মজদুরভাই। কোথাও এই ইনসাফ যাত্রার জন্যই এসেছেন  ভিনরাজ্যে থাকা অনেক পরিযায়ী মজদুর। হাটছেন তাঁরা। প্রায় সব জায়গায় শ্রেণি ও গণসংগঠনের পক্ষ থেকে এসে সংবর্ধিত করছেন সাথিরা।   
ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়েও যুব নেতারা সব জায়গায় বক্তব্য বলছেন সভায় সমাবেশে। তাঁরা পদযাত্রা শেষে সন্ধ্যাোয় কোনও গ্রামে বা পাড়ায় কৃষক–খেত মজদুর, জমি থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়া মানুষদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। সেইসব লড়াইয়ের সঙ্গে শেষতক থাকবেন, এ কথা ঘোষণা করে, আরও প্রত্যয়ী হবার আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁদের।  চলতে চলতে নেতৃত্ব নেমে পড়ছেন খেতে। যেখানে নতুন শস্য তুলছেন অন্নদাতারা। কথা বলে লড়াইয়ের বার্তা দিচ্ছেন তাঁদের।
এককথায় ইনসাফ যাত্রা  এক অন্য ধরনের পদযাত্রা। মানুষের ভালোবাসা, প্রীতি, শ্রদ্ধায় আপ্লুত হতে হতে তা এগিয়ে চলেছে।  
কোচবিহার থেকে যখন শুরু হয়েছিল, তখন কিছুটা গরম, এখন শীতকালের ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। আরও ঠান্ডা পড়বে। অঙ্গীকারবদ্ধ যুবরা তা উপেক্ষা করেই হাঁটতে থাকবেন অতঃপর। 
কী খাবেন, কোথায় রাতে থাকার জায়গা হবে, এসব নিয়ে তাঁরা কেউ ব্যতিব্যস্ত হচ্ছেন না। লড়াইয়ের এক অন্যমাত্রা যোগ হচ্ছে বাংলায় এই যাত্রার মধ্যবর্তিতায়।
মীনাক্ষীর ভাষণ শোনার জন্য সব বয়সের মানুষ যেন পাগল। এতো অনায়াস সরলতায়, অথচ রাজনৈতিক কথায় ভরপুর, অথচ চাঁছাঝোলা শব্দে ওজস্বী– যা থেকে মানুষ ‘ঝঞ্ঝা ঝড় মৃত্যু দুর্বিপাক’কে দু’পায়ে ডলে এগিয়ে যাবার প্রেরণা পায়, এরকম তাঁর ভাষণ। মানুষ অনেক দিন পরে যেন এমন ভাষণ শুনতে পেলেন!
মীনাক্ষীর ভাষণের ঐ শব্দটা খুব উৎসাহিত করছে মানুষকে– ভয়ের ঘরে ভয় ঢোকাতে হবে। স্পন্দিত  হচ্ছেন যুবরা, যখন তিনি বলছেন– মইদুল মিদ্দা, আনিস খান, সুদীপ্ত গুপ্তরা যদি হকের দাবি জানাতে গিয়ে জীবন দিতে পারে, তবে তাদের পথে চলতে গিয়ে, যদি জীবনের সর্বোচ্চ সম্পদ চোকাতে  হয়, তাতে কিসের ভয়!
এসব কথায় যুবদের মধ্যে যেন একটা মাতন এসেছে।

দুই
ইস্যু ঘোরানো চলবে না
ইনসাফ যাত্রা। মানুষ কেন হকের প্রাপ্য পাচ্ছেন না, কেন তাদের নানা ষড়যন্ত্রে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে, কেন একই বোঁটার দুই বিষফল বিজেপি আর তৃণমূলের দুর্নীতি আর লাম্পট্যে ভরে গেল রাজ্য, দেশ– তাদের শাস্তি চাই- ইনসাফ চাই – তার জন্য এই জেদি ও তেজি পদযাত্রা। রুটি চাই, রুজি চাই, কারখানা চাই, খেতের ফসলের দাম চাই, যা খেয়ে মানুষ বাঁচে, সেসবের দাম মানুষের সাধ্যের মধ্যে বেঁধে দেওয়া চাই, কর্মচারী, ছোট দোকানির সম্মান চাই, ছাত্রের, নারীর নিরাপত্তা চাই। গণতন্ত্র চাই, নির্বিঘ্নে মত প্রকাশের ব্যবস্থা চাই, ভোটকে ভণ্ডুল করার গুন্ডামির অবসান চাই– কেন পাচ্ছি না এ সব অধিকার, কাদের ষড়যন্ত্রে বঞ্চিত হচ্ছে এসব থেকে তাদের বিচার চাই। ইনসাফ চাই।
মানুষের জীবন আর জীবিকার বিষয়কে আবছা করে দিয়ে রামমন্দির, জগন্নাথ মন্দির, গীতাপাঠ আর চণ্ডীপাঠের নামে ভেদাবাদ শয়তানি চলবে না। ইস্যু ঘুরিয়ে মজা লোটার দিন শেষ করে দেওয়া হবে– এই শপথ নিয়ে চলছে ইনসাফ যাত্রা। বাংলাজুড়ে এই মেজাজ এনেছে ইনসাফ যাত্রা। তাই যুব বয়সের বাইরের জনমণ্ডলীর মধ্যেও উৎসাহ এসেছে। এসেছে উদ্দীপনা। এমন কী বৃদ্ধ সাথিদের মননেও এসেছে তা। তারা সবাই গুছিয়ে বলতে পারছেন না। ইনসাফ যাত্রার মহান দৃশ্যগুলো দেখে অনেকের চোখ ছল ছল করে উঠছে। তারা যেন বলতে চাঐঐইছে-  ‘আমার জীর্ণপাতা ঝরার বেলায় বারে বারে/  ডাক দিয়ে যায় নতুন পাতার দ্বারে দ্বারে’।
কেউ বলছেন, যুবরাই তো পারবে। কেউ সোভিয়েত বিপ্লবের ইতিহাস থেকে বলছেন– ১৯১৭ সালে যখন বিপ্লব সম্পন্ন হলো, তখন কমরেড লেনিনের বয়স ৪৭ বছর। কমরেড স্তালিন, কমরেড জিনোভিয়েভ, কমরেড কামেনোভ, কমরেড ট্রস্কির বয়স তো ৪০’এরও নিচে।  

তিন
এ জীবন, হে যুগসন্ধিকালের চেতনা
দেশের ও রাজ্যের পাপের রাজ্যত্বের এক যুগ পূর্ণ হলো, কোথাও দু’/এক বছর বাকি। দুর্গ পতনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। শত্রু পক্ষে নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। আত্মধ্বংসের সংবাদ আসছে প্রতিদিন। সব অংশের মানুষ নতুন লড়াইয়ের চেতনা নিয়ে এগিয়ে আসছেন। শ্রেণি ও গণসংগঠনগুলির মধ্যে লড়াইয়ের পর লড়াইয়ের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে দেশ ও রাজ্য।
বরিষ্ঠ সাথি হান্নান মোল্লার ঐ কথাটা— কোনও শাসকই অপ্রতিরোধ্য নয়—  মনে প্রতীতি সৃষ্টি করেছে। কারণ তিনি বলেছেন দৃষ্টান্ত দিয়ে। কৃষি সংক্রান্ত কালা কানুনগুলির বিরুদ্ধে শীত-গ্রীষ্ম–বর্ষা উপেক্ষা করে  লক্ষ লক্ষ অন্নদাতা লড়াই করলেন, সাত শতাধিক লড়াকু শহীদ হয়ে গেলেন। হাজার হাজার সংগ্রামীর নামে মিথ্যা মামলা রুজু করল মোদীরা। এত করেও তাঁদের মনোবলে ফাটল ধরাতে পারেনি শত্রুরা। নতুন এক বৈশিষ্ট্য এই ঐতিহাসিক সংগ্রামের, তা হলো– মজদুর ভাইরা শুধু বিবৃতি দিয়ে নয়, দৈহিকভাবে শামিল হয়েছিলেন এই লড়াইয়ে।  শেষ পর্যন্ত মোদীদেরকে কালা কানুন তুলে নিতে হয়েছে। এই যে একটা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কায়েম করতে সব ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি শাসকশক্তি, তা কী পরাজিত হবে না! অবশ্যই হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ইতালি, জার্মানি, স্পেন– সব রাষ্ট্রে অভ্যুত্থান হয়েছে। তাই এ দেশেও হবে। একথা বুঝিয়ে বললেন– প্রখ্যাত চিন্তাবিদ প্রভাত পট্টনায়ক। তাই কোনও শাসক শক্তি, যত বলীয়ানই হোক, তাকে পরাজিত করা যায়– এই চেতনায়, লড়াইয়ের ময়দানে দোনোমোনো করা মানুষও আলোড়িত হচ্ছেন।
এখন এক যুগসন্ধিকাল। পরিস্থিতি দেশ ও রাজ্যের গণমানুষের পক্ষে। লড়াই হচ্ছে দিকে দিকে। আমাদের দেশ– কান্ট্রি অব ইয়ুথ– যুবদের দেশ। দেশের ৭০% মানুষের বয়স ৪০ বৎসরের মধ্যে। এই যুগসন্ধিক্ষণের চেতনাকে মননে সাথি করে রাজ্যের যুব অংশের সবাইকে লড়াইয়ের গণ্ডির মধ্যে আনার জন্যও এই ইনসাফ যাত্রা। আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন ধারার লড়াইয়ে এক মহত্তম সংযোজন যুবদের মরণপণ চলমান এই ইনসাফ যাত্রা। যাত্রীরা অন্যান্য প্রগিতিবাদীদের, সাধরণ মানুষের মননে, কর্মে অগ্নি সঞ্চালন করছেন।  
আমরা যারা মানুষকে ভালোবাসি, চাই মানুষ বিজয়ী হোক, দেখতে চাই পূর্ণ বিজয়ের একটা পর্যায়ে, নির্বাচনে অচিরেই এই বিজয় আসছে, তাদের সবাইকে এখন যুগ সন্ধিকালের চেতনায় উদ্দীপ্ত হতেই হবে। চাই সবাই মিলে আরও আরও আরও বিপুল কর্মকাণ্ড। রাজ্যের কোনও এলাকাতেই হোক, আর কোনও সংগঠনেই হোক, কোথাও কিছু ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করার সময় এখনই এবং এখনই। সমস্ত শ্রেণি ও গণসংগঠনে এবং আমাদের সব কাজকর্মে যুবদের বেশি বেশি অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে দ্রুত।
জয় গণমানুষের অবশ্যম্ভাবী।মাভৈঃ।

 

Comments :0

Login to leave a comment