ELECTORAL BOND and DEMOCRACY

বন্ড: টাকার জোরে ভোটের ব্যবস্থায় বিপদ গণতন্ত্রের

জাতীয়


 

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম সংসদীয় গণতন্ত্র। নির্বাচন ও রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট। রাজনৈতিক দলগুলির সারা বছর কাজকর্মের প্রয়োজনে একটি বড় ব্যয় জড়িত। ব্যয় রয়েছে নির্বাচনেরও। তবুও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছ আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। দেশে রাজনৈতিক তহবিল ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ করতে এবং নগদহীন অর্থনীতিতে যাওয়ার লক্ষ্য জানিয়ে নির্বাচনী বন্ড আইনের বিল ২০১৭ সালে পেশ করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি। 
বাস্তবে নির্বাচনী বন্ড কেবল অস্বচ্ছতাকে বৈধতাই দিয়েছে। সংসদের বিতর্কে ঠিক এ কথাই বলেছিল সিপিআই(এম)। সদ্য সুপ্রিম কোর্টের রায়েও তাই বলা হয়েছে। এই মামলায় পক্ষ ছিল পার্টি।
একদিকে মোদি সরকার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অন্যদিকে রাজনীতিতে কালো টাকার অনুপ্রবেশকে আইনি স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে দ্বিগুণ করেছে। এই নতুন কৌশলটি আরও বৈশিষ্ট হলো এটি ভারতের বহুল আলোচিত শীর্ষ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্কটকে আরও তীব্র করেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধনের পরে 'রামরাজ্য' আনার কথা বলেছিলেন। এখন মোদীর 'রামরাজ্য'-এ সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনী বন্ড স্কিমকে রাজনৈতিক দলগুলিকে কর্পোরেট অনুদানের একটি অস্বচ্ছ, অসাংবিধানিক প্রক্রিয়া আখ্যা দিয়েছে। কর্পোরেট ও অন্যান্য বেআইনি উৎস থেকে রাজনৈতিক দলগুলি কী পরিমাণ অর্থ পাচ্ছে তা নাগরিকদের না জানানো মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন বলে মনে করেছে। 
নির্বাচনী বন্ড ঘিরে অসাধুতা ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি। ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস নামে একটি সংস্থা, কয়েকশো কোটি টাকা মুনাফা করে এবং বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তল্লাশির মুখোমুখি হয়েছিল। তারপরেই ১,৩৬৮ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছিল, যা কোনও একক সংস্থার সবচেয়ে বেশি ক্রয়। 
আরেকটি সংস্থা, মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং, ১,২০০ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে এবং কেন্দ্রীয় পরিবহণ ও সড়ক মন্ত্রী নীতিন গড়করির প্রশংসা কুড়িয়েছে। ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট) অভিযানের পরে এই সংস্থাটি বন্ড কিনেছিল। কেন্দ্রীয় সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক তোলাবাজি চালানো হয়েছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে আয়কর বিভাগ মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে হানা দিয়েছিল। 
এমনও সংস্থা আছে যারা তাদের মুনাফার চেয়ে ১০ এবং এমনকি ১০০ গুণ পর্যন্ত বেশি নির্বাচনী বন্ড কিনেছিল। এটা কীভাবে সম্ভব? অন্য কোনও বড় সংস্থা ঘুরপথে এমন সংস্থাকে ঢাল করে টাকা না দিলে এমন সম্ভব নয়। ন্ড ঘিরে অর্থ পাচার যে হয়েছে তা স্পষ্ট। ভারতের রাজনীতিতে অর্থশক্তির নিয়ন্ত্রণ ফাঁস হয়ে গেছে।
এটাও যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী যে এসবিআইয়ের এই ধরনের পদক্ষেপ, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ উপেক্ষা করেও অস্বচ্ছ নির্বাচনী বন্ড চালিয়ে গেছে বা তাদের বাধ্য করা হয়েছে এবং তাও ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে, যা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনতে চলেছে।
সুপ্রিম কোর্ট বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছে যে কেন নাগরিকদের কাছে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য থাকা দরকার। আদালত বলেছে, ‘আমাদের দৃষ্টিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া, অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোটদান প্রক্রিয়া ছাড়া গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। ‘ক’ বা ‘খ’ প্রার্থীর সম্পর্কে না জানিয়ে ভোট নিলে ভোটারদের দ্বারা প্রদত্ত ভোট অর্থহীন হবে। একপেশে তথ্য, ভুল তথ্য, সব মিলিয়ে অজ্ঞ নাগরিক তৈরি করে। যা গণতন্ত্রকে একটি প্রহসনে পরিণত করে। তাই ভুল তথ্য ও অজ্ঞ ভোটার বা শুধুমাত্র একপেশে তথ্য থাকা ভোটার ভোট দিলে তা গণতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে বাধ্য। বাক্‌ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে তথ্য প্রদান এবং গ্রহণের অধিকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যার মধ্যে মতামত রাখার স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। গণতন্ত্র 'বাক ও মত প্রকাশের' স্বাধীনতার মধ্যে নিহিত এবং গণতন্ত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি পদের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এমন প্রার্থী সম্পর্কে বস্তুগত তথ্য পাওয়ার অধিকারকে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত করবে না বলে মনে করার কোনও কারণ নেই।’
'গোদী মিডিয়া' এই কেলেঙ্কারি নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ। শুধু ২০১৯-২০২০ সালেই রাজনৈতিক দলগুলির প্রাপ্ত ৩,৪২৯ কোটি টাকার মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ২,৬০৬ কোটি টাকা বা মোট নির্বাচনী বন্ডের ৭৬ শতাংশ। ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এসবিআই ১৬,৫০০ কোটি টাকার বন্ড বিক্রি করেছিল, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এসবিআইকে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে পরিসংখ্যান প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়ায় তারা মোট প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকার বন্ড প্রকাশ করেছিল, যার প্রায় অর্ধেক একা বিজেপির কাছে গিয়েছিল। ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে দলগুলির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের এপ্রিলের আগে ৯০ শতাংশেরও বেশি অনুদান বিজেপিতে গিয়েছিল। এখানে আশ্চর্যজনক বিষয় হল তৃণমূলের মতো একটি একক রাজ্যে সীমাবদ্ধ একটি দল, যেখানে অর্থনীতি অধোঃগামী এবং খুব কম কর্পোরেট বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যাপার রয়েছে, তারা কোন যাদুবলে ১,০৯৩ কোটি টাকার বন্ড পেলো?
কারা কিনেছে? প্রথম এবং সর্বাগ্রে, সিইএসসি’-এর সঞ্জীব গোয়েঙ্কা, ফিউচার গেমিং-এর সান্তিয়াগো মার্টিন এবং কেভেনটারের মহেন্দ্র জালান। এই তিনজন মিলে গত কয়েক বছরে তৃণমূলকে এক হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ প্রদান করেছে, এর বেশিরভাগই গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়। অর্থাৎ প্রতি বিধানসভা কেন্দ্র পিছু প্রায় ৩.৫ কোটি টাকা। সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সংস্থা তৃণমূলকে ৪২২ কোটি টাকা দিয়েছে। এবার বলার অপেক্ষা রাখে না কেন পশ্চিমবাংলায় বিদ্যুৎ বিল সবচেয়ে বেশি। 'লটারি কিং' সান্তিয়াগো মার্টিনের কোম্পানি, ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড তৃণমূলকে ৫৪২ কোটি টাকা দিয়েছে। কেভেনটার গ্রুপের মহেন্দ্র জালানের সাথে যুক্ত সংস্থাগুলি তৃণমূলকে প্রায় ৬৬ কোটি টাকা দিয়েছে।
নির্বাচনে বিপুল ব্যয় ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থার অন্যতম জটিল সমস্যা। ন্যাশনাল কমিশন টু রিভিউ দ্য ওয়ার্কিং অফ দ্য কনস্টিটিউশনের রিপোর্ট অনুসারে, নির্বাচনের অতিরিক্ত ব্যয় দুর্নীতির জন্য উচ্চ মাত্রার বাধ্যবাধকতা তৈরি করে।
নির্বাচনী তহবিলের অনৈতিক উৎস সুরক্ষার বা ‘পাইয়ে দেওয়ার’ বিনিময়ে হিসাব বহির্ভূত কালো টাকা ‘চাঁদা’ দেওয়া বিনিয়োগকারীকে ‘রিটার্ন গিফ্ট’এর প্রত্যাশা দেয় সংশ্লিষ্ট দল ক্ষমতাসীন হলে। নির্বাচনের সময় কালো টাকার ব্যবহার কেবল অর্থ পাচারের রাস্তা খোলে না, এর সঙ্গে গুরুতর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবও জড়িত থাকে। টাকার বিনিময়ে রাজনৈতিক স্তরে বোঝাপড়া করে ব্যবসা চালানো বা ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ বন্ডের মতো ব্যবস্থায় আরও উৎসাহ পায়। অপরাধমূলক-রাজনৈতিক আঁতাতের পথ প্রশস্ত করে। কারণ দাঙ্গাবাজ, দুষ্কৃতীরা টাকার জোরে প্রার্থী হয়। সমাজে বৈষম্য, হিংসার বীজ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। সংবিধান ভঙ্গকারীরা আমাদের দেশে আইন প্রণেতা হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, সংসদীয় গণতন্ত্রে কালো টাকার ব্যবহার সৎ, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য একটি অসম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি। কারণ তারা অর্থবলের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে।

Comments :0

Login to leave a comment