PANCHAYAT CENTRAL FORCE

বাহিনী নয়, মানুষের জেদই শেষ কথা

রাজ্য

প্রতীম দে

মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘এত শান্তিপূর্ণ মনোনয়ন আগে কখনও হয়নি।’’ দুষ্কৃতী তাণ্ডবে অসংখ্য অভিযোগে নীরব রাজ্য নির্বাচন কমিশন জবাবদিহি দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করেনি। সুপ্রিম কোর্টের রায় দেখাচ্ছে, অবাধ ও সুষ্ঠু পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে না রাজ্য কমিশন বা রাজ্যের সরকার।

মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টও সারা রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের রায়কে বহাল রেখেছে। আদতে সেই নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট, মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিনে। যে দিন উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় বামপন্থীদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার মিছিলে গুলি চলেছে। ভাঙড়ে নিহত হয়েছেন আইএসএফ কর্মী। সারা রাজ্য দেখেছে ব্লক দপ্তর, যেখানে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে, সেখানেও অবাধে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুষ্কৃতী বাহিনী। আর সব হচ্ছে পুলিশের চোখের সামনে।  

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এদিন স্পষ্ট বলা হয়েছে যে মনোনয়ন জমা দিতেই যদি বাধা দেওয়া হয়, প্রাণনাশ হয়, তা’হলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া চলে কী ক’রে। হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল কমিশন এবং রাজ্য সরকার। দু’পক্ষকেই কড়া ভর্ৎসনা করে বিচারপতিরা বলেছেন, নির্বাচন পরিচালনার অর্থ হিংসার অবাধ লাইসেন্স নয়। 

বামপন্থীরা বলছেন, রাজ্য এবং কমিশন থাপ্পড় খেয়েছে ফের। এবার সুপ্রিম কোর্টে।

রায় যেদিন হলো, ২০ জুন, মঙ্গলবার, সারা রাজ্য দেখছে দাসপুর বা বড়ঞায় প্রার্থীদের মনোনয়ন তুলে নিতে পুলিশ কতটা সক্রিয়। সেই সঙ্গে দেখছে প্রতিরোধও। ঘটনা সামনে আসে কয়েকটি, আরও বহু জায়গায় সমানে হুমকি চলছে। কেউ কেউ মনোনয়ন তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আরও অনেক বেশি জায়গায় এই অসভ্য তাণ্ডব রুখে দেওয়া হয়েছে। হয়েছে জনতাকে নিয়ে তৃণমূল এবং বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলির প্রতিরোধে।

সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম রায়ের আগেই জানিয়েছেন মনোভাব। কেন্দ্রীয় বাহিনীর রায় রাজ্য এবং কমিশনের ভূমিকা বেআব্রু করে দিয়েছে। কিন্তু আল কথা হলো গণপ্রতিরোধ। তিনি বলেছেন‘‘মানুষ গ্রামে গ্রামে ঐক্যবদ্ধঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন পঞ্চায়েত থেকে লুঠেরাদের হঠাতে। মানুষ নিজেদের পঞ্চায়েত তৈরি করতে চাইছেন। তারা নিজেদের হাতে ক্ষমতা চাইছেন। আইনি ক্ষমতা নয়। আইন দেখার দায়িত্ব পুলিশ প্রশাসনের।’’

আর কড়া হুঁশিয়ারির সুরে সেলিম বলেছেন, ‘‘পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে বিরোধী প্রার্থীদের হুমকি দিচ্ছে তৃণমূল। আইনের রক্ষক যদি বেআইনি কাজ করে তবে মানুষ শুধু রুখে দাঁড়াবেন না, তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের বেঁধেও রাখবেন। আর পুলিশকে নিজের জন্য নিরাপত্তারক্ষী রাখতে হবে।’’

কেন্দ্রীয় বাহিনীই একমাত্র সমাধান নয় কেন? বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ মনে করাচ্ছেন এর আগে একাধিক নির্বাচনের অভিজ্ঞতা। পঞ্চায়েতে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে পরিচালনা করবে কমিশন এবং রাজ্য প্রশাসন। যেমন ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন। সে সময়ে নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে সুপ্রিম কোর্টে পর্যন্ত গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জন্য। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই ভোট হয়েছিল। কিন্তু হিংসা হয়েছিল।

২০১৩’ ১১ জুলাই প্রথম দফার পঞ্চায়েত নির্বাচনেই পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়ার একাধিক বুথ নিজেদের দখলে নিয়েছিল তৃণমূলের বাহিনী। বেলা ১২ টার মধ্যে বাঁকুড়া জেলা পরিষদের ১০ আসন দখল করে তৃণমূল। দ্বিতীয় দফায় তিন জেলা মিলিয়ে প্রায় ১৫০০ বুথ দখল করে ছাপ্পার অভিযোগ জানিয়েছিল বামফ্রন্ট। তৃতীয় দফাতেও প্রবণতা বদলায়নি। 

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে কোন কেন্দ্রীয় বাহিনী আসেনি। রাজ্য পুলিশ ভোট পরিচালনা করে। অবস্থা আরও মারাত্মক হয়েছিল। নির্বাচনের দিন ২৫ জনের মৃত্যু হয়। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় ব্যালট বক্স। বস্তুত নির্ধারিত সময়ে ফল প্রকাশ করতে পারছিল না নির্বাচন কমিশন। ব্যালট বাস্ক কেড়ে, ব্যালট পেপার লুটের বহু ঘটনা দেখা গিয়েছিল।  

বামফ্রন্ট বলেছিল এই নির্বাচন ২০১৮’র মতো হবে না। তা বোঝা গিয়েছে মনোনয়ন পর্বেই। কার্যত পাঁচদিন হাতে ছিল মনোনয়নের। তবু বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং আইএসএফ বা তৃণমূল এবং বিজেপি বিরোধী শক্তির ৭৩ হাজার ৭৫০ মনোনয়ন জমা পড়েছে। বিজেপি’র জমা পড়েছে ৫৬ হাজার ৩২১টি মনোনয়ন। ১৫ জুনের হিসেব, তৃণমূলের জমা ৮৫ হাজার মনোনয়ন। আট ঘন্টায় ৭৫ হাজারের বেশি মনোনয়ন জমায় কারচুপির অভিযোগ প্রবল। সিপিআই(এম) বলেছে, তৃণমূলের তালিকায় এমনও নাম আছে যিনি দেশের বাইরে! 

পর্যাপ্ত বাহিনী না এনে নাম কা ওয়াস্তে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়ার রাস্তা নিচ্ছে রাজ্য। এই প্রসঙ্গে সেলিম বলেছেন, ‘‘পর্যাপ্ত আধা সামরিক বাহিনী চাই। টালবাহানা না করে তা মোতায়েন করতে হবে।  তৃণমূলের দলীয় কাজে ব্যস্ত না থেকে পুলিশকে আইন মেনে মানুষের ভরসা ফিরিয়ে আনার কাজ করতে হবে।’’

কমিশন এবং রাজ্য অবাধ সুষ্ঠু ভোটের পক্ষে নয়। বস্তুত পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণার দাবিতেই বামপন্থীরা জেলায় জেলায় পরপর আন্দোলন চালিয়েছেন। কেন্দ্রীয় বাহিনী আসবে, তবে নিয়ন্ত্রণ থাকবে রাজ্য আর কমিশনের হাতে। ৮ জুলাই ভোট বা তারপর গণনা ফল ঘোষণার প্রতিটি পর্বে গণপ্রতিরোধ আর জনজমায়েতই হাতিয়ার, বলছে বামফ্রন্ট। 

Comments :0

Login to leave a comment