পীযুষ ব্যানার্জি : ডানকুনি
এক আশ্চর্য সমাপতন!
ঘড়ির কাঁটায় ঠিক বেলা ১২টা ১ মিনিটে পার্টির ২৭তম রাজ্য সম্মেলনে রক্তপতাকা উত্তোলনের জন্য এগিয়ে গেলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রবীণ নেতা বিমান বসু।
১৪ বছর আগে এই ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদের মৃত্যুবরণ করেছিলেন পার্টির পূর্ব বর্ধমান জেলার নেতা কমরেড প্রদীপ তা ও কমরেড কমল গায়েন। সে বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের মিছিল থেকে আক্রান্ত হয়েছিলেন দুই পার্টিনেতা। পাথর দিয়ে থেঁতলে খুন করার হয়েছিল তাঁদের।
রাজ্যে ঠিক তার এক বছর আগে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। তারপরই ঘটেছিল এই নির্মম হত্যাকাণ্ড। খুনিদের কোনও সাজা হয়নি। গত ১৩ বছরে কমিউনিস্টদের হত্যা করেই থামেনি শাসকদল। হত্যার তালিকা দীর্ঘ হয়েছে। তাতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, কর্মী দরদিদের সঙ্গে শাহাদাত বরণের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন প্রতিবাদী যুবকও। রাষ্ট্র-শাসকের মিলিত নৃশংসতার শেষ বলি আর জি কর হাসপাতালের পড়ুয়া চিকিৎসক। শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সত্তা নিয়ে বাঁচতে চাওয়া যুবককেও খুন হতে হয়েছে এই ফেব্রুয়ারিতেই। আমতায় নিজের বাড়িতে গভীর রাতে পুলিশ হানা দিয়ে খুন করে সংখ্যালঘু পরিবারের মেধাবী সন্তান আনিস খানকেও। এখনও তাঁর বিচারের পথ চেয়ে বসে আছেন সন্তান হারানো পিতা।
২০১২ সালে খুন হয়েছিলেন কমরেড প্রদীপ তা, কমরেড কমল গায়েন। ঠিক এক দশকের মাথায় ২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে আমতার সারদা গ্রামে নিজের বাড়িতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি হতে হয়েছিল আনিস খানকে।
বসন্ত আগমনের মাস ফেব্রুয়ারি। এরাজ্যের প্রতিবাদ, আন্দোলন সংগ্রামে শহিদী বরণের মাস এই ফেব্রুয়ারি। ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়েও তো আত্মবলিদানের মাস ২১ ফেব্রুয়ারি। ফেব্রুয়ারি তাই মায়ের ভাষার মাস।
এই ফেব্রুয়ারিতেই আয়োজিত হচ্ছে সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির ২৭তম রাজ্য সম্মেলন। হুগলীর ডানকুনি কোল কমপ্লেক্স চত্বরে কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি মঞ্চে ও কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নগরে সম্মেলন তাই স্মরণ করেছে এরাজ্যের শোষিত মানুষের সংগ্রামরত শহীদ থেকে এরাজ্যে গণতন্ত্র রক্ষায় প্রাণ হারানো তরতাজা যুবককে।
ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের বর্ষীয়ান শিল্পী শহীদ স্মরণে বেঁধেছেন গান। সূচি মিলিয়েই ঘড়ির কাঁটায় ঠিক যখন বেলা ১২টা, মাইক ধরলেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। ঘোষণা করলেন পার্টি পতাকা উত্তোলন করবেন বিমান বসু।
ঠিক তখন এ দুনিয়ার, এদেশ ও রাজ্যের শহীদদের না ভোলার শপথে গণনাট্যের শিল্পীদের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘‘শহীদ শোনো, আমরা সবাই জেগে আছি। তোমার চোখে নামলো কালঘুম/ আমার রাত্রি নিদ্রাহীন।’’ মার্কসবাদী আদর্শের প্রতি অবিচল প্রত্যয়ে তৈরি হওয়া শহীদ বেদী মঞ্চে একে, একা মাল্যদান করে গেলেন বিমান বসু, প্রকাশ কারাত, মানিক সরকার, বৃন্দা কারাত, সূর্য মিশ্র, এম এ বেবী, তপন সেন, অশোক ধাওয়ালে, নীলোৎপল বসু, হান্নান মোল্লা, অভ্যর্থনা কমিটির সভানেত্রী মিতালী কুমার ও সম্মেলনের সকল প্রতিনিধি, দর্শক ও আমন্ত্রিত প্রতিনিধিদের তরফে মহম্মদ সেলিম। গানের সুর ছড়িয়ে পড়ছে, ‘তোমার খুনে যারা মেটালো তৃষ্ণা/ তাদেরও ঘুম নেই চোখে/ ওদের রাজ্যে সূর্য মৃতপ্রায়/ শ্রমের রাজ্যে সোনালি দিন।’
গত তিন বছরে রাজ্য সম্মেলনের ফারাকে এরাজ্যের কমিউনিস্ট আন্দোলনে শহীদ হয়েছে ১১ জন সিপিআই(এম) কর্মী। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেই প্রাণ দিতে হয়েছে ৮ জন তরতাজা পার্টিকর্মীকে। তাঁদের সেই আত্মত্যাগের কথা অধিবেশনে রিপোর্ট পেশের সময় বলছিলেন মহম্মদ সেলিম। ‘পঞ্চায়েত নির্বাচনে যাঁরা আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন। লড়াই করেছিলেন। প্রার্থী হয়েছিলেন। জানকবুল বাজি করে লড়াই করেছিলেন। কমরেড মনসুর চোপড়াতে, মুর্শিদাবাদে, পূর্ব বর্ধমানে কমরেডরা সব খুন হয়ে গেলেন,’ বলছিলেন মহম্মদ সেলিম। দিন বদলের স্বপ্ন ছাড়া জানকবুল লড়াই যে করা যায় না তা জানে সম্মেলন।
একদিন এই সোনালি দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে এরাজ্য পথ চলতে শুরু করেছিল কমিউনিস্ট আন্দোলন। সেই ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে সম্মেলনের প্রবেশ পথেই। সালটা ছিল ১৯৩৪। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি তখন বেআইনি। মেটিয়াব্রুজে আয়োজিত হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম রাজ্য সম্মেলন।
পার্টি তখনও বেআইনি। তাই ব্রিটিশ সরকারের এলাকার বাইরে গিয়ে ফরাসি অধিকৃত চন্দনগরে বসেছিল দ্বিতীয় রাজ্য সম্মেলন। ১৯৩৮ সালে ৩০০ জন পার্টি সদস্যের উপস্থিতিতে সেই সম্মেলন সম্পাদক পদে নির্বাচিত করেছিলেন কমরেড নৃপেন চক্রবর্তীকে।
অবিভক্ত বাংলার শেষ সম্মেলনে পার্টি সদস্য ছিলেন ১৯ হাজার ২৫০ জন পার্টি সদস্য নিয়ে শেষবারের মতো সম্মেলন থেকে সম্পাদক হয়েছিলেন কমরেড রণেন সেন। তারপর দেশভাগ। মেটিয়াব্রুজ থেকে ডানকুনি— ২৭তম সম্মেলনের চলের পথের এক টুকরো ইতিহাস উঠে এসেছে এ তল্লাটে।
আছেন ঋত্বিক ঘটক। আছেন সলিল চৌধুরি। আছেন নাট্য ব্যক্তিত্ব বাদল সরকার। জন্ম শতবর্ষের সামনে এই তিন কিংবদন্তী শিল্পীর কাজ নিয়ে সংকলন তৈরি হয়েছে। সম্মেলনে ঢোকার পথে।
এদেশে এখন তীব্র আক্রমণের মুখে বহুত্ববাদী সংস্কৃতি। এক দেশ-এক ভোট, এক দেশ-এক রেশন, এক দেশ-এক কর, ক্রমতালিকা আরও দীর্ঘ। এক দেশ-এক ধর্ম গড়ার জন্যই যে এই প্রোপাগান্ডা গত এক দশকে তা এখন শুধু টের পাওয়ার মধ্যে নেই। বরং তা অভিজ্ঞতায় চলে আসছে।
এই বহুত্ববাদকেই রক্ষা করতে চেয়েছে ২৭তম রাজ্য সম্মেলন। হুগলী জেলার ঐতিহ্যের সংকলিত প্রদর্শনীতে তাই আছে তারকেশ্বর মন্দির, মাহেশের রথ, চুঁচুড়ার ইমামবাড়া থেকে ব্যান্ডেল চার্চ। আবার একইসঙ্গে জেলার মনীষীদের তালিকায় সম্মেলন মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন রামকৃষ্ণ পরমহংস, রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। হুগলী জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।
CPI-M MARTYRS
শহিদী বরণের মাসেই ঐতিহ্য, বহুত্ববাদ ধরে রাখার অঙ্গীকার

×
Comments :0