অনির্বাণ দে: বেলডাঙা,
যে রাস্তায় কিছুদিন আগে বিভেদের হুঙ্কার শোনা গিয়েছিল সেই পথে দাঁড়িয়েই বৃহস্পতিবার ঐক্যের জোরালো বার্তা দিল সিপিআই(এম)। জাত ধর্মের বিভেদ মুছে একই টোটোয় করে সমাবেশে এলেন সব পাড়ার মানুষ।
বেলডাঙার জনকল্যাণ ময়দানে সিপিআই(এম)’র আহ্বানে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সমাবেশ থেকে উঠে এল সব ধর্মনিরপেক্ষ, শান্তিপ্রিয় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার আহ্বান। তৃণমূল আর বিজেপি’র বিভেদ বিদ্বেষের রাজনীতির ছক ভেস্তে দিয়ে মানুষের রুটি-রুজি-কাজের দাবিতে লড়াই তীব্রতর করার আহ্বান এল এই সমাবেশ থেকে।
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সাম্প্রায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছিল বেলডাঙায়। সেই ঘটনা নিয়ে এদিন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘মানুষ বিভাজনের রাজনীতিতে জেরবার। আর আদানি আম্বানি কয়েক হাজার কোটি টাকার পাহাড় জমা করে নিয়েছে। নির্বাচনের সময় মোদী আর মমতাকে ইলেক্টোরাল বন্ডের নামে দু’জনেই টাকা দেয়। সেই টাকা ওপর থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে কিছুটা হুমায়ুন কবিরের মতো লোকেরা পায়। কিছু মহারাজ, রাজা আছে। কার্তিক মহারাজ আর গণেশ মহারাজা এসব নাম আছে। তারাও পায়। তারা আসলে সুপারি পায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরির। মুর্শিদাবাদ জেলায় লোকসভা ভোটের সময়েও বিভাজনের রাজনীতি হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে সিপিআই(এম), কংগ্রেসকে হারাতেই ছিল সাম্প্রদায়িকতার প্রচার। যাদের সম্পত্তি, চাকরি লুট হচ্ছে সেই মানুষকে উসকানি দেওয়া হচ্ছে ধর্মের নামে লড়াই করতে। এতে লাভ লুটেরাদের। কোনও ধর্মই অপকর্ম করতে শেখায় না। কিছু লোক ধর্মগুরু সাজে। কিছু লোক ব্যবহার করে ধর্মের তিথি, স্থান, উৎসব। মানুষের বিশ্বাসকে কুৎসিতভাবে ব্যবহার করা হয়। ধর্মস্থানে আক্রমণ করতে যায় কারা? যারা সাম্প্রদায়িক। তা সে বাংলাদেশেই করুক আর সম্ভলেই করুক।’’
কিন্তু কেন এই ধর্মের নামে ভাগাভাগি? মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘আমাদের দেশে ধর্মের নামে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো তার সিঁড়ি। বিজেপি’র ফ্যাসিবাদ নির্মাণের কাজে তৃণমূল ভাড়ায় খাটছে, যাতে বিজেপি’র কাজ সহজ হয়।’’
পার্টির রাজ্য সম্পাদক আরও বলেছেন, ‘‘বেলডাঙার ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। পুলিশের কাজ হচ্ছে চক্রান্তকারীদের ধরে বের করা। পুলিশ সেই কাজ করছে না। তৃণমূলের আমলে অপরাধীদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। পুলিশই এই কাজে মদত দিয়েছে। আমাদের দেশ এবং রাজ্যের প্রশাসন পকেটমার, গুন্ডা, দাঙ্গাবাজ, সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে পড়েছে। তা সে উত্তর প্রদেশে যোগীর রাজত্বই হোক আর পশ্চিমবঙ্গ মমতার রাজত্ব, ছবি একই। রানিগঞ্জ, ধুলাগড় থেকে কোচবিহার, রাজ্যে অনেকগুলি দাঙ্গা হয়েছে মমতা ব্যানার্জির রাজত্বে। একজন দোষীরও সাজা হয়নি। একটিও কমিশন হয়নি। দাঙ্গাবাজরা মনে করেছে যা খুশি করা যায়। তাই আমরা দাবি করছি শাস্তি দিতে হবে।”
পার্টির রাজ্য সম্পাদক আহ্বান জানিয়েছেন, ‘‘দেশ, রাজ্য বাঁচাতে হলে লাল ঝান্ডাকে মজবুত করতে হবে। শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, কর্মচারী, দোকানদার সব মানুষকে এককাট্টা হতে হবে। মানুষ এককাট্টা হলে যারা জাত, ধর্মের নামে মানুষকে ভাগ করছে তারা শুকিয়ে যাবে। তৃণমূল আর বিজেপি’র দালালদের বলব মানুষের আবেগকে নিয়ে, ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করা বন্ধ করতে হবে।”
এদিন সমাবেশে সিপিআই(এম) মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক জামির মোল্লা বলেছেন, ‘‘তৃণমূল আর বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি করছে। এরা হিন্দু, মুসলমান উভয়ের শত্রু। যা ঘটেছে তার চাইতে বেশি রটেছে। ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল। গরিব মানুষের কাজ বন্ধ। প্রশাসন ব্যর্থ। রাজ্যের শান্তি, সম্প্রীতির ঐতিহ্য ভেঙে চুরমার করা হচ্ছে। রাজ্যের ঐতিহ্য, সম্প্রীতি রক্ষা করতে হবে।’’
যুব আন্দোলনের নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি সমাবেশকে শপথের সমাবেশে পরিণত করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘যখন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই সমাবেশ হচ্ছে, তখন কলকাতার রাস্তায় যোগ্য শিক্ষকরা রাত জাগছে। আইসিডিএস সেন্টারগুলি ফাঁকা। ৩ হাজার স্কুল বন্ধ করে দিয়ে ২২ হাজার মদের দোকান খুলে দিয়েছে সরকার। আর জি করের খুনি, ধর্ষকরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আক্রান্ত সংবিধান। সংবিধান বলছে সবাই সমান। এটা ওরা সহ্য করতে পারে না। যে কোনও ধর্মে ধর্মে ঝামেলা করার চেষ্টা হলে সব ধর্মের মানুষকে এক হয়ে রুখে দিতে হবে। পেটে ভাত নেই। জিনিসপত্রের দামে আগুন। সাফ বলতে হবে দালালি কাউকে করতে দেবো না। আগে ভাতের ব্যবস্থা, তারপর হিন্দু মুসলমানের খোঁজ।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বেলডাঙার ঘটনা নিয়ে পুলিশকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। যারা ঐক্যে আঘাত আনছে পুলিশ কেন তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না? বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরে দাঙ্গাবাজদের বাড়াবাড়ি করার সাহস হয়নি।” মীনাক্ষী আরও বলেছেন, ‘‘কার্তিক মহারাজ থেকে অনন্ত মহারাজ- গোটা ভারতবর্ষে দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে নিজেদের ক্ষমতা দখল রাখতে। এদেরকেই বিজেপি তৃণমূল ব্যবহার করছে। আর রয়েছে হুমায়ুন কবীরের মতো বিধায়করা। এদের বিরুদ্ধে মানুষের ঐক্য অটুট রাখতে রাস্তায় থাকবে মানুষ।’’
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পার্টির বেলডাঙা এরিয়া কমিটির সম্পাদক সাজাহান আলি। ছিলেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য শেখ হাসিনা, ধ্রুবজ্যোতি সাহা, সোমনাথ সিংহ রায় প্রমুখ।
Comments :0