Mob Lynching

বিপন্ন অর্থনীতি আর ‘রুল অব ল’, অসহিষ্ণুতা, নৃশংসতার পিছনে প্রবল অনাস্থা

রাজ্য

 



চারদিনে ৫জন নিহত সন্দেহের বশে, নৃশংস মারে। কেন? 

‘‘যে কোনও সভ্য সমাজে যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবেন তাদের অপরাধীরা ভয় পাবে এবং শান্তিপ্রিয় নাগরিক যাঁরা তাদের গভীর বিশ্বাস থাকবে পুলিশের ওপর। এই বোধটা সেখানেই একমাত্র থাকে যেখানে পুরো দস্তুর ‘রুল অফ ল’ (আইনের শাসন) কাজ করে। কিন্তু যেখানে আইনের শাসন কাজ করে না, যেখানে আইন মানুষ নিজের হাতে তুলে নেয়, চটজলদি ফল পাওয়ায় জন্য এবং সেখানে যদি পুলিশের কোনও ভূমিকা না থাকে সেখানে এই ঘটনাগুলিই ঘটবে।’’ এমনটাই মনে করছেন রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন আধিকারিক পঙ্কজ দত্ত।

তাঁর এই বক্তব্যের বাস্তবতা প্রমাণ করছে সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গে। সোমবারও নৃশংসভাবে মারের কারণে নিহত হয়েছে আরও একজনের। সেই ঘটনা হুগলীর তারকেশ্বরের। গত চার দিনে রাজ্যে এমন মারের কারণে নিহত হয়েছেন ৫জন। লক্ষণীয় নিহতরা সবাই গরিব এবং সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষ।  

পরিস্থিতি এমন পৌঁছেছে যে জেলে বন্দি অপরাধী সেখান থেকে ফোন করে পুলিশ আধিকারিদের খুনের হুমকি পর্যন্ত দিতে ছাড়ছে না। গত জুন মাসের উত্তর ২৪পরগনায় ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে একের পর এক দলবদ্ধ পিটিয়ে মারার মানসিক বিকৃতি যেন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা রাজ্যে। পুলিশের অকর্মণ্যতা, আর স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদহীনতার জেরে মারধর করে খুনের ঘটনা বেড়েই চলছে। মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে চোখে সামনে দেখার পরেও প্রতিবাদের বদলে তা মোবাইলে তুলে রাখার প্রবণতাটিও সামজিক চূড়ান্ত অবক্ষয় বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।

মনরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ শ্রীজিৎ ঘোষের পর্যবেক্ষণ কিছুটা এমন,‘‘ এই সব ঘটনা মানুষের অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ। মানুষ যত চারদিক থেকে বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হন, সে চাকরির ক্ষেত্রেই হোক, সামাজিক, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মধ্যে থেকেই হোক, মানুষ ক্রমশ তার স্বাভাবিক আচার আচরণ বদল ঘটাতে থাকে। স্বাভাবিক জীবন বদলাবার বিষয়টি আসতে থাকে, যেহেতু ‘মক সাইকোলজি’, ‘ইন্ডিভিজুয়াল সাইকোলজি’র থেকে আলাদা। এই অবস্থায় মানুষ তার বিচারবুদ্ধি সব সময় ঠিক রাখতে পারে না আর তাই এই ধরনের ঘটনাগুলি ঘটবার সময় মানুষ তার স্বাভাবিক মানসিকতা ক্রমশ হারিয়ে ফেলে। দুর্বৃত্তায়ন মানুষকে কবজা করে। আর তাই পিটুনি থেকে চুরি, পাচার বা কুৎসিত আক্রমণের ঘটনাগুলি ঘটে।’’ তাঁর আহ্বান,‘‘আমাদের স্থিতধী হতে হবে। নিজেদের বিচার বুদ্ধির ওপর আস্থা রাখতে হবে এবং সামাজিক ন্যায়ের জন্য সকলে মিলে লড়াই করতে হবে।’’

এ’ তো ব্যক্তি কিংবা সমষ্টিবদ্ধ মানুষের বিবেচনা, সচেতনার প্রশ্ন। কিন্তু পুলিশ, প্রশানের ভূমিকা? তার উপর মানুষ ভরসা রাখতে পারছেন না।  

‘চোর’ সন্দেহে গত শুক্রবার সকালে মুচিপাড়া থানা এলাকার সরকারি হস্টেলে ‘মোবাইল চোর’ সন্দেহে পিটিয়ে মারা হলো বেলগাছিয়ার বাসিন্দা ২৪বছরের মহম্মদ এরশাদ আলমকে। এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টা না কাটতে কাটতে ফের বিধাননগরে ‘মোবাইল চোর’ সন্দেহে খুন হতে হলো এক পথচলতি যুবক প্রসেন মণ্ডল(২২)।  এখানেই শেষ নয়। ঝাড়গ্রামেও ‘চোর’ সন্দেহে ব্যাপক মারধরের জেরে এক তরতাজা যুবকের মৃত্যু ঘটল রবিবার। নিহত  যুবকের নাম সৌরভ সাউ (২৩)।  সেখানে আক্রমণকারীদের হাতে মার খেয়ে এখনো হাসপাতালে রয়েছেন বন্ধু অক্ষয় মাহাতো। তাঁর অবস্থাও আশঙ্কানজনক। এরপরে বচসার জেরে পিটিয়ে মারা হলো আশিস বাউল দাসকে (২৬)। সামান্য বচসা থেকে তৈরি উত্তেজনায় ওই যুবককে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ঘটনাটি ঘটেছে হুগলীর পাণ্ডুয়ার দ্বারবাসিনী এলাকায়। প্রতিটি ঘটনায় পুলিশকে আসতে দেখা গেছে ঘটনার পরে। অভিযুক্তদের কিছু অংশকে গ্রেপ্তার করা হলেও কিছুতেই অপরাধকে রুখতে পারছে না রাজ্য পুলিশ প্রশাসন। কেন এমন ঘটনা বারবার দেখা যাচ্ছে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে সমাজের ক্ষেত্রে। এই ক্ষেত্রে অর্থনীতির অধ্যাপিকা ঈশিতা মুখার্জির বক্তব্য,‘‘এর পিছনে একটি অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত আছে। এইভাবে আক্রমণ সব সময় মানুষকে আর্থিকভাবে বিপন্ন করে। কারণ সে ভয়ে সন্ত্রাসে ঘরে ঢুকে পড়ে। যারা দূর্বৃত্ত তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না। কম মজুরিতেও বেশি কাজ করতে তারা বাধ্য হবে আর চড়া সুদে মহাজনি কারবার বৃদ্ধি পাবে। অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক শোষণ বাড়বে। এবং এই ঘটনাগুলির বিরুদ্ধ মানুষ চাইবে নির্বাচিত সরকার এগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করুক। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিক। তার নিজের দলের হলেও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিক। মানুষের রুজি রোজগারের স্বার্থে, জীবন জীবীকার স্বার্থে।’’  

পুলিশ প্রশাসনের একাংশকে শাসক দলের লোক হয়ে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিন মানুষ তা দেখতে দেখতে আর পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। টাকার বিনিময়ে অভিযোগকে নস্যা ৎ করে চলা পুলিশের একাংশের জন্য গোটা পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। এটা নিয়েই রীতিমতো চিন্তিত পুলিশ মহল। অপর দিকে কলকাতার কিছু ডাকাবুকো পুলিশ আধিকারিকদের মতে, আইন মেনে কাজ করতে গেলে নিজের পদকে ধরে রাখাটা কঠিন। শাসক দলের মনঃপূত কাজ না হলেও অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়েছে। অকারণে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া পুলিশ আধিকারিককে দেখে অন্যদের শিক্ষা হয়ে যাচ্ছে। তাই শাসকের  ভাষ্যকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজই করতে হচ্ছে পুলিশকে।

চলচ্চিত্র অভিনেতা বাদশা মৈত্রর কথায়,‘‘এটা তো ভয়ঙ্কর ট্রেন্ড। এ নৃশংসভাবে মারছে। মানুষ খুব একটা মানসিকভাবে সুস্থ অবস্থায় নেই। যত দিন যাচ্ছে আমরা খুব এগ্রেসিভ, অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি। একটি মানুষকে পিটিয়ে মারা সেই চরম আগ্রাসী, অসহিষ্ণুতার প্রকাশ।’’

Comments :0

Login to leave a comment