TMC

ব্যালট থাকছে না মেনুতে, মহাদেব আজ আসছেন মাংস-ভাত নিয়ে

রাজ্য

মাংস ভাত নিয়ে ধর্মতলায় আসছেন মহাদেব মাটি। ব্যালট থাকবে মেনুতে? প্রশ্ন শুনে রেগে গেলেন তৃণমূলের এই ‘জেতা’ প্রার্থী। বললেন, ‘‘এই হলো আপনাদের দোষ। এখন এই প্রশ্ন আসছে কেন?’’
শুক্রবার ২১জুলাই। এদিন তৃণমূল সভা করে ধর্মতলায়। বৃহস্পতিবার সভাস্থল ঘুরে দেখেছেন তৃণমূল নেত্রী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সভাস্থলেই এদিন মনিপুরের জঘন্য ঘটনা সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন বিজেপি-র। টুইটারে লিখেছেন, ‘‘মণিপুরের মারাত্মক ভিডিওটি দেখে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। দুই মহিলার উপর উন্মত্ত জনতার নির্মমতা দেখে ক্রোধ তৈরি হয়েছে মনে। বর্বরোচিত এই কাজ সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে, যা মানবতার বোধগম্য নয়।’’
এদিন তাঁর সঙ্গে ছিলেন দলের নেতারা। শুধু নেতারাই নন, কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকেও দেখা গেছে এদিন তৃণমূলের দলীয় সভার প্রস্তুতি দেখতে মমতা ব্যানার্জি এবং তৃণমূল নেতাদের পাশে বসে গল্প করতে। বৃহস্পতিবার থেকেই জেলা এবং শহরে বাসের সংখ্যা কমেছে। শুক্রবার অটোও কম মিলবে। অন্তত ইঙ্গিত তেমনই। কারণ, যানবাহনের বড় অংশ নিয়ে নেবেন তৃণমূল নেতারা। তাতে সমর্থক, কর্মীদের নিয়ে যাওয়া হবে ধর্মতলায় — বাৎসরিক কর্মসূচীতে।
এবারের সভায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলের প্রতীকে জয়ী প্রত্যেককে হাজির থাকার নির্দেশ জেলার নেতাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ ভোট লুট করে, ব্যালট বাক্সে জালিয়াতি করে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতা প্রার্থীরা থাকবেন। যদিও তাঁদের এখনও জয়ী বলা যাচ্ছে না আদালতের নির্দেশের কারণে। সেই দলেই থাকছেন মহাদেব মাটি। উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়া-২ নং ব্লকের ভুরকুন্ডায় তিনি তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন। হারছেন বুঝতে পেরে গণনা কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ মজুমদারের নামের পাশে ছাপ মারা কয়েকটি ব্যালট ছোঁ মেরে তুলে গিলে ফেলেন মহাদেব। গণনা কেন্দ্রে ছিল তৃণমূলের একাধিপত্য। তৃণমূলের এজেন্টরা ছিলেন। প্রশাসনের অফিসার, কর্মীরাও তৃণমূলের কর্মী হিসাবেই কাজ করেছেন। ফলে মহাদেব মাটির এই কান্ডর বিরোধিতা সিপিআই(এম) ছাড়া কেউ করেনি। বিজেপি প্রার্থী ছিলেন ওই কেন্দ্রে। কিন্তু বিজেপি বিশেষ কথা বলেনি। বিডিও মহাদেব মাটিকেই ‘জয়ী’ ঘোষণা করেছেন। 
এদিন সেই মহাদেব জানান, ‘‘ধর্মতলায় কাল যাবো। এখান থেকে স্করপিও হচ্ছে। অন্য গাড়িও হচ্ছে। আমি কোনটায় যাবে, এখনও ঠিক করিনি। দেখা যাক। আলোচনা চলছে।’’ জিজ্ঞাসা করা হয়, দুপুরের খাবার খেয়ে যাবেন? নাকি নিয়ে যাবেন? মহাদেব বলেন, ‘‘দুপুরের খাবার তো সকালে খাওয়া যাবে না। নিয়েই যাবো। গতবারও তাই গেছিলাম। আমাদের এখান থেকে রান্না করে নিয়ে যাওয়া হয়।’’ এবার কী নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? ডিম ভাত? উত্তরে মহাদেব বলেন, ‘‘না, এবার মাংস ভাত নিয়ে যাব।’’ তারপরই আসে ব্যালট প্রসঙ্গ। তাতে খেপে যান মহাদেব।
ভুরকুন্ডায় যাঁর বদলে তৃণমূল এবার ‘ব্যালট খাওয়া’ মহাদেব মাটিকে প্রার্থী করেছিল, সেই দোলা পোদ্দার হালদার কোনও মন্তব্য করতে চাননি। 
যদিও ১৯৯৩-এর ২১জুলাই-র মহাকরণ অভিযানের কারন সম্পর্কে মমতা ব্যানার্জি বরাবর দাবি করেছেন যে, ‘সায়েন্টিফিক রিগিং’য়ের বিরুদ্ধে সেদিন তিনি মহাকরণ অভিযান করেছিলেন। তাঁর সেই কর্মসূচীর বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে গণনা কেন্দ্রে কারচুপি করে জেতা প্রার্থীদের হাজিরা বাধ্যতামূলক।
তিরিশ বছর আগে, ২১জুলাই মহাকরণ দখল করতে আসা মমতা ব্যানার্জির সমর্থক, বাহিনীরা পুলিশকে আক্রমন করেছিল। মমতা ব্যানার্জি তখন যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী। সেদিন পুলিশ গুলি চালালে ১৩জনের মৃত্যু হয়। স্বরাষ্ট্র সচিব হিসাবে মনীশ গুপ্ত সেদিনের ঘটনার বিষয়ে হাইকোর্টে ১৯৯৩-র ২রা আগস্ট একটি হলফনামা জমা দিয়েছিলেন। সেই হলফনামা অনুসারে, ওই দিন জমায়েতে ‘বহু সশস্ত্র দুষ্কৃতী (অ্যান্টিসোস্যাল) নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জড়ো হয়েছিল’। ওই দিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সারা রাজ্যের কয়েক হাজার যুব কংগ্রেসকর্মী স্ট্র্যান্ড রোড, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, রানী রাসমণি অ্যাভিনিউ, এসপ্ল্যানেড রো ইস্ট এবং ব্রেবোর্ন রোডে জমায়েত হয়। তারা মহাকরণের দিকে ছুটতে থাকে। পুলিশ প্রথমে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জনতাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশের সেই চেষ্ঠা ফলপ্রসূ হয়নি। ‘জনতা’ পুলিশকে লক্ষ্য করে পাইপগান থেকে গুলি ছোঁড়ে। ইঁট, পাথর, সোডার বোতলও ছোঁড়া হয় যথেচ্ছ। পুলিশ তখন লাঠি চালায়। ৩৪১ রাউন্ড কাঁদানে গ্যাসের শেলও ফাটায় পুলিশ এবং রাইফেল থেকে ৭৫ রাউন্ড ও রিভলভার থেকে ৪৬ রাউন্ড গুলি চালানো হয়। অর্থাৎ সেদিন ‘আন্দোলনকারীরা’ বোমা, পাইপগান নিয়ে এসেছিল। তারা গুলি ছুঁড়ছিল, বোমা মারছিল। মনীশ গুপ্তর হলফনামা আরও জানিয়েছিল, সেদিন ৩টি বাস পুড়িয়েছিল মমতা ব্যানার্জির ডাকে হাজির বাহিনী। তারা ৩৫টি গাড়িও ভাঙচুর করেছিল। জখম হয়েছিলেন ২১৫ জনের বেশি পুলিশ। তাঁদের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, ডিসি (সদর), ৭জন ডিসি, ১০ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ছিলেন। ৩৪ জন পুলিশকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ হাসপাতালে। তাঁদের অনেকেরই পাইপগানের গুলি এবং বোমার স্প্লিন্টার লেগেছিল। তালতলা থানার সার্জেন্ট ডি কে ঘোষালের গুলি লেগেছিল। এক সাব ইনস্পেক্টর কালাচাঁদ সমাদ্দারের শরীরে আঘাত ছিল বোমার। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাব ইনস্পেক্টর একে গাঙ্গুলিকে এসএসকেএম হাসপাতালের সামনে মেরে মাথা ফাটিয়ে, হাত ভেঙে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। আক্রান্ত, রক্তাক্ত হয়েছিল পুলিশ। তাই গুলি চালিয়েছিল। 
সেদিন সাংবাদিক পিটিয়েছিল মমতা ব্যানার্জির দলবল। দুপুর পৌঁনে তিনটে নাগাদ ধর্মতলায় স্কুটার আরোহী ওই সাংবাদিক, সঈদ আহ্‌মেদকে মমতা ব্যানার্জির কর্মীরা ঘিরে ধরে মেরেছিল। মারাত্মক আহত হন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সেই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি।  ‘২১শে জুলাইয়ের তদন্ত কমিশন’-র সরকারী ঘোষণা হয়েছিল ২০১২-র ১৭ই ফেব্রুয়ারি। ২০১৪-র ডিসেম্বরে কমিশন রিপোর্ট জমা দেয়। কমিশন সাক্ষ্য দিতে ডেকেছিল বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। কিন্তু যিনি সেই ‘অভিযান’-র উদ্যোক্তা, সেই মমতা ব্যানার্জিকে কমিশন ডাকেনি। কমিশন কেমন কাজ করেছে, তা এ’ থেকে কিছুটা বোঝা যায়। তবু কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুশান্ত চ্যাটার্জি তাঁর তদন্ত রিপোর্ট জানাতে বাধ্য হয়েছেন, যে ১৩জনের মৃত্যু হয়েছিল সেদিন, তাদের মধ্যে একজনের গায়ে গুলির কোনও আঘাতই মেলেনি। সেই ব্যক্তির মৃত্যুর কারন ‘সিরোসিস অব লিভার’। সাধারনত এই রোগটি বেপরোয়া মদ্যপানের কারনে হয়। আর বেপরোয়া মদ্যপান দুষ্কৃতীদের পরিচিত বৈশিষ্ট্য।
এখন তৃণমূলের মধ্যে এই বেপরোয়া দুষ্কৃতী, যারা গণনা কেন্দ্রে মহিলা প্রার্থীর গায়ে মদ ঢেলে দেয়, মারাত্মক হামলা চালায়, তারাই প্রধানত আছে।

Comments :0

Login to leave a comment