SCIENCE DAY

জাতীয় বিজ্ঞান দিবসে আমাদের শপথ নিরন্তর বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির অনুশীলন

উত্তর সম্পাদকীয়​

অধ্যাপক গৌতম গাঙ্গুলি

ছিয়ানব্বই বছর আগে ১৯২৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি স্টেটসম্যান কাগজে ছোট্ট একটা খবর বেরিয়েছিল। মূল শিরোনামে লেখা ছিল 'New Theory of Radiation’, তার নিচে একটু ছোট হরফে লেখা 'Prof. Raman’s Discovery'। তার আগের দিন কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এর গবেষণাগারে দীর্ঘদিন অনুসন্ধান চালিয়ে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন  এক নতুন আবিষ্কার করেছিলেন, যাকে আমরা এখন রামন ক্রিয়া বলি। রামন প্রথমেই এই আবিষ্কারের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন, তাই দেরি না করে সংবাদপত্রে জানান এবং ৮ মার্চ বিখ্যাত নেচার পত্রিকাতে প্রকাশের জন্য পাঠান। এই দ্রুততার প্রয়োজন ছিল, কারণ সেই বছরের মে মাসেই দুই সোভিয়েত বিজ্ঞানী মেন্ডেলশাম ও ল্যান্ডসবার্গ এই বিষয়ে তাদের গবেষণা প্রকাশ করেন। রামনের কৃতিত্বের স্বীকৃতিতে তিনি ১৯৩০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বাইরে এর আগে কেউ বিজ্ঞানে সেই পুরস্কার পাননি।

সেই ইতিহাস মনে রেখে ১৯৮৬ সাল থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসাবে পালন করা শুরু হয়েছে। রামনের আবিষ্কারের পরের বছরেই ভারতে এসেছিলেন বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী আর্নল্ড সমারফেল্ড। তিনি রামনের গবেষণাগার পরিদর্শন করেন এবং গবেষকদের সঙ্গে আলোচনা করেন; নিজের ডায়েরিতে ভারতের বিজ্ঞানচর্চার ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি লিখেছিলেন জাপান অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞান গবেষণা করলেও রামন ক্রিয়ার সমতু্ল্য  কোনও আবিষ্কার এখনো করে উঠতে পারেনি। অথচ এক শতাব্দী পরে দেখি বিজ্ঞান গবেষণাতে জাপান চীন সহ এশিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ আমাদের থেকে এগিয়ে। কেন এমন হলো?

গবেষণা পরিকাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রতি অবহেলাকে এর মুখ্য কারণ বলে অনেকেই মনে করেন। স্বাধীনতার আগে বিজ্ঞান গবেষণা হতো মূলত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে; যে সমস্ত আধুনিক আবিষ্কারের জন্য আমরা গর্ব বোধ করি তার প্রায় সবগুলিই তাদের চৌহদ্দির মধ্যে হয়েছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দেশের সামনে মূল সমস্যা ছিল বিপুল সংখ্যক গরিব মানুষের উন্নতি, বিজ্ঞান গবেষণাতে উপযুক্ত অর্থ বিনিয়োগ সেই মুহূর্তে দরিদ্র দেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই নীতি নির্ধারকরা বহু সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়কে আর্থিক সাহায্যের পরিবর্তে সীমিত সংখ্যক কেন্দ্রীয় গবেষণাগারকে অনুদানের নীতি নিয়েছিলেন। প্রতিবাদ করেছিলেন একমাত্র মেঘনাদ সাহা, কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। অবশ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রমথনাথ ব্যানার্জিকে লেখা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর এক চিঠি থেকে আমরা দেখি যে তিনি বিশ্বাস করতেন পরে এই নীতির পরিবর্তন হবে। কিন্তু সেই  আপতকালীন ব্যবস্থাই পরবর্তীকালে হয়ে দাঁড়ালো নিয়ম। ফলে আমাদের সব সেরা মেধাগুলি গবেষণাকেন্দ্রের দিকে আকৃষ্ট হলো, কিন্তু বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে তাদের কোনও যোগ রইল না। পৃথিবীর প্রায় কোনও উন্নত দেশই এই নীতি অনুসরণ করে না।

স্বাধীনতার ষাট বছর পরে পরিবর্তনের কিছুটা চেষ্টা করা হয়। প্রথম ইউপিএ সরকার দেশের সাতটি শহরে তৈরি করে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন এন্ড রিসার্চ, একই সঙ্গে ভুবনেশ্বরে স্থাপিত হয় ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যা ন্ড রিসার্চ। এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে মৌলিক বিজ্ঞানে গবেষণা ও পড়ানোর উপর সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। একই সময় দেশে  আটটি নতুন আইআইটি তৈরি হয়েছিল। এর পরে ২০১৫-১৬ সালে ধানবাদের স্কুল অব মাইন্সকে আইআইটিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং আরও ছটি আইআইটি তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই নতুন প্রতিষ্ঠানগুলিতে গবেষণার পরিকাঠামোর উন্নতিতে বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি,  মূলত প্রযুক্তি শিক্ষার মধ্যেই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ। বিরাট দেশের পক্ষে এই সমস্ত প্রয়াস নিতান্তই অপ্রতুল; তার অন্যতম কারণ হলো বিজ্ঞান গবেষণাখাতে আমাদের দেশে সরকারি বরাদ্দ হাস্যকর রকম কম।
অথচ এখন আর সম্পদের অভাবের অজুহাত দেওয়া যায় না, আমরা বুক ফুলিয়ে বলি আমরা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। চীন জিডিপি’র ২.১%, দক্ষিণ আফ্রিকা ৪.২%, ব্রাজিল ১.৫% গবেষণার জন্য খরচ করে। বিজ্ঞান গবেষণাখাতে সারা পৃথিবী যেখানে খরচ বাড়াচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে তা ক্রমশই কমছে। ২০০৯-১০ সালে যা ছিল জিডিপি’র ০.৮২% , তা ২০২০-২১ সালে আরও কমে হয় মাত্র ০.৬৪%; তার পরে তা আর বিশেষ বাড়েনি। এই কারণেই আমাদের দেশে প্রতি লক্ষ মানুষ পিছু গবেষকের সংখ্যা ২৫; আর এই সংখ্যাটাই চীনে ১১৮, ব্রাজিলে ৮৮, থাইল্যান্ডেও ১৭৯। গবেষণার পরে চাকরির সুযোগ খুবই কম, তাই বাধ্য হয়ে ছাত্রদের পাড়ি দিতে হয় বিদেশে। ২০০৩ সালে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ভারতীয় গবেষকের সংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষ, ২০১৩ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ৯.৫ লক্ষ; এখন তা নিঃসন্দেহে আরও বেড়েছে। এই বিপুল মানবসম্পদকে ফিরিয়ে আনার সরকারি চেষ্টা খুবই সীমিত। ২০০৭ থেকে ২০১২ পাঁচ বছরে সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি দপ্তরের উদ্যোগে মোট ২৪৩ জন দেশে ফিরেছিলেন, পরের পাঁচ বছরে সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয় ৬৪৯ জন। যে সংখ্যক গবেষক বিদেশে যাচ্ছেন, তার এক ভগ্নাংশকেও এভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
গত বছর অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (এনআরএফ) আইন সংসদে অনুমোদিত হয়েছে। পরমাণু গবেষণা, মহাকাশ গবেষণার মতো বিষয়গুলি এই আইনের পরিধির বাইরে, মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ও নানা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের জন্যই এই ফাউন্ডেশন। এই সংস্থা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ করবে এবং কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, রাষ্ট্রীয় সংস্থা, বেসরকারি শিল্পসংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে। অনেক গালভরা কথা লেখা থাকলেও কয়েকটি বিষয় খুব স্পষ্ট। প্রথমত, গবেষণার উপর নিয়ন্ত্রণ আরও কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। এই প্রথম গবেষণা নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সমন্বয়ের কথা বললেও কোনও রাজ্য সরকার বা রাষ্ট্রীয় শিল্প সংস্থার প্রতিনিধি সেখানে নেই। কার্যকরী সমিতিতে তিনজন বিশেষজ্ঞ থাকলেও সেখানে মন্ত্রী ও আমলারাই অনেক বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাঁরাই নিয়ন্ত্রক ভূমিকা নেবেন।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি আসে, তা হলো অর্থবরাদ্দ। এই বছর বিজ্ঞান দিবসের থিম 'বিকশিত ভারতের জন্য দেশীয় প্রযুক্তি।' অর্থ বিনিয়োগ না করে কেমন করে প্রযুক্তির বিকাশ সম্ভব? পাঁচ বছরে এনআরএফ’র বরাদ্দ পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ বছরে দশ হাজার কোটি টাকা। টাকাটা মোটেই খুব একটা বেশি নয়, অনেক উন্নত ও উন্নতিশীল দেশ এর থেকে অনেক বেশি খরচ করে। এর মধ্যে সরকার দেবে মাত্র ২৮০০ কোটি টাকা, যা এখনকার ব্যয়ের থেকে সামান্য বেশি, এবং মূল্যবৃদ্ধির কথা মাথায় রাখলে হয়তো কম। চীনের ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় একাই ২০২১ সালে সেদেশের সরকারের থেকে গবেষণার জন্য পেয়েছে ৩৩০০ কোটি টাকা। এনআরএফ’র বাকি টাকাটা আসার কথা বেসরকারি শিল্প সংস্থা ও দেশি বা আন্তর্জাতিক জনহিতকর প্রতিষ্ঠান থেকে, যদিও কেমনভাবে তা মোটেই স্পষ্ট নয়। দেশের বেসরকারি শিল্প সংস্থাদের গবেষণাতে বিনিয়োগের রেকর্ড খুব একটা ভালো নয়, অথচ সরকার তাদের উপরেই ভরসা করছে। বেসরকারি সংস্থা স্বাভাবিকভাবেই আশু লাভ খুঁজবে। এর ফলে মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বৃহত্তর জনগণের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পরিবর্তে সীমিত সংখ্যক অর্থবান মানুষের স্বার্থেই গবেষণা পরিচালিত হবে। তার থেকেও বড় কথা কোনও সংস্থার ব্যয়ের বাহাত্তর শতাংশ যদি বেসরকারি সংস্থা থেকে আসে, তাহলে সেই সংস্থা তাদের নির্দেশেই পরিচালিত হবে। এর ফলে সরকারি অর্থের উপরে বেসরকারি কর্তৃত্ব কায়েম হবে। সরকার যে শুধু দায়িত্ব ছাড়ছে তা নয়, একই সঙ্গে জনগণের করের টাকার উপর বেসরকারি নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করছে।

এনআরএফ’র ঘোষণাপত্রে বলা আছে যে সমস্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার উন্নতি ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়া হবে। আমাদের দেশে বারোশোর বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রায় চল্লিশ হাজার কলেজ আছে, পরিকাঠামোর অভাবে এর এক শতাংশও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নয়। গবেষণাতে সাহায্য করা হবে প্রকল্পভিত্তিক, তার থেকে পরিকাঠামোর উন্নতি সম্ভব নয়। ফলে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই গবেষণা সুদূরকল্পনা থেকে যাবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ শিক্ষক পদ শূন্য। সেগুলি পূর্ণ করার কোনও চেষ্টা কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের তরফ থেকে হচ্ছে না। পূর্ণ সময়ের শিক্ষকের পরিবর্তে আংশিক সময়ের শিক্ষক, অতিথি শিক্ষক, চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক ইত্যাদি দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে; তাঁদের গবেষণাতে যুক্ত করার প্রশ্নই ওঠে না। বিদেশ থেকে ফিরতে ইচ্ছুকদের জন্য যে সীমিত সংখ্যক ফেলোশিপের ব্যবস্থা আছে, স্বাভাবিকভাবেই তা মাত্র কয়েক বছরের জন্য; তার পরে দেশে কোনোরকম স্থায়ী বা দীর্ঘকালীন কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই বললেই চলে। বিজ্ঞান গবেষণাতে আগ্রহী ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে, কারণ সরকারি ফেলোশিপের সংখ্যা ক্রমশই কমছে, এবং ডক্টরেট করার পরে ভবিষ্যৎ কী হবে তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। আমাদের দেশে এখন বিজ্ঞানে প্রতি বছর ডক্টরেট করেন মোটামুটি পঁচিশ হাজারের মতো ছাত্র-ছাত্রী। এই সংখ্যাটা এমনিতেই কম, তার উপর ডক্টরেটের পরে এনআরএফ-এ মাত্র এক হাজার ফেলোশিপের ব্যবস্থা আছে। এই সমস্ত সমস্যার প্রভাবে বিজ্ঞান বিভাগে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও ক্রমশ কমছে। আমাদের রাজ্যে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, ফলে বিজ্ঞান পাঠে ইচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে কমছে।

প্রশ্ন আসে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার কি আদৌ বিজ্ঞান গবেষণাতে আগ্রহী? নাকি  ইন্টারনেট, স্টেম সেল চিকিৎসা বা এরোপ্লেনের মতো আধুনিক উদ্ভাবন ও আবিষ্কারকে পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার মধ্যেই তার আগ্রহ সীমাবদ্ধ? বিজ্ঞান প্রযুক্তি দপ্তরের মন্ত্রী বিবর্তনবাদের বিরোধিতা করছেন, পাঠ্য পুস্তক থেকে বিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় বাদ পড়ছে, তার জায়গা নিচ্ছে কিছু অবৈজ্ঞানিক গালগল্প এবং পশ্চাৎমুখী ধ্যানধারণা। ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে উপেক্ষা করে সরকারি অনুষ্ঠানে নানা উদ্ভট রীতিনীতি পালিত হচ্ছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ব্যক্তিগত সুযোগসুবিধা ও স্বার্থের জন্য কিছু বিজ্ঞানীও তার সমর্থকদের দলে নাম লেখাচ্ছেন। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির স্বশাসন এখন অতীত, প্রায় সব কটিই এখন সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে; বিরুদ্ধ স্বর নেহাতই মৃদু। দেশের শীর্ষ মহল থেকে বিজ্ঞানের পরিবর্তে উচ্চকণ্ঠে অপবিজ্ঞানের প্রচার চলছে।

বিজ্ঞানের প্রতি অবিশ্বাস অবশ্য এখন সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়ছে। তার কারণ গত কয়েক দশকে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির চোখধাঁধানো বিকাশ সত্ত্বেও গরিব মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়নি, অনেক ক্ষেত্রে আরও খারাপ হয়েছে; অন্যদিকে ধনী আরও ধনী হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি বেশ ব্যয়সাপেক্ষ, ফলে সমাজের উঁচুতলা তার দখল নিচ্ছে। বর্তমান  পরিবেশ সঙ্কটের পিছনে রয়েছে উন্নত রাষ্ট্রের সীমাহীন লোভ, তার দাম চোকাতে হচ্ছে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের গরিব মানুষকে। ব্যবস্থা না পালটালে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। মানুষের মনে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, শাসকরা তাকে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী ধারণার বিরুদ্ধে চালনা করার চেষ্টা করছে এবং অনেক সময়েই সফল হচ্ছে। পুরানো ধ্যানধারণার বাড়বাড়ন্ত ঘটছে, ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে যুক্তিবাদের জায়গা নিচ্ছে কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস ও রহস্যবাদ। এই সমস্ত বিকৃত ধারণাই হলো সাম্প্রদায়িকতার চালিকাশক্তি। চারজন যুক্তিবাদীকে খুন হতে হয়েছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত একজনেরও শাস্তি হয়নি।

এমনিতেই আমাদের দেশে বিজ্ঞানমনস্কতার শিকড় খুব দৃঢ় নয়। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর এ হিস্ট্ররি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি বইতে আমাদের দেশে প্রাচীন যুগে বিজ্ঞানের অধোগতির দুটি কারণ নির্ধারণ করেছিলেন। হাতের কাজকে অবজ্ঞা করে চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণকে অবহেলা করা হয়েছিল যা স্পষ্টতই বিজ্ঞানের পরিপন্থী। মায়াবাদ শিক্ষা দিয়েছিল এই জগৎ মিথ্যা, তাই সেই মিথ্যা সম্পর্কে কষ্ট করে জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন অনুভূত হয়নি। পাশ্চাত্য সমাজও এই দুই আবর্তের মধ্যে পড়েছিল, রেনেশাঁস ও সপ্তদশ শতকের বিজ্ঞানের বিপ্লব সেখান থেকে বিজ্ঞানচর্চাকে উদ্ধার করে। আমাদের দেশে সেইরকম কোনও বিপ্লব হয়নি, ফলে আমাদের বিজ্ঞান অবিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানের সঙ্গে আপস করেই চলছে। তাই অনেক বিজ্ঞানী তাঁর নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের বাইরে নানা অবৈজ্ঞানিক ধারণার শিকার। সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত উপগ্রহ উৎক্ষেপণের আগে সাফল্যকামনাতে মন্দিরে বিজ্ঞানীদের পূজা দেওয়ার মতো নিদর্শনগুলিকে সামনে আনছে, ফলে বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির প্রচার বাধা পাচ্ছে।

এই পরিস্থিতির মোকাবিলাতে প্রয়োজন বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার। সারা ভারত জনবিজ্ঞান নেটওয়ার্ক ২৩টি রাজ্যের চল্লিশটি বিজ্ঞান সংগঠনকে নিয়ে গত বছরের ৭ নভেম্বর থেকে এই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাভারত বিজ্ঞান চেতনা অভিযান সংগঠিত করেছে। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ পাঁচটি সাইকেল র্যারলি ও পদযাত্রা ও নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জীবন ও জীবিকার জন্য বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ ও মুক্তচিন্তার প্রসার এবং জল জমি বন ও বিদ্যুতের অধিকার-এর দাবি আমাদের রাজ্যের নানা প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বিজ্ঞান দিবসে গৃহীত হতে চলেছে বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি বিষয়ে নতুন এক ঘোষণাপত্র, যেখানে ধ্বনিত হবে বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, বহুত্ববাদ এবং মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির চর্চা নাগরিকের মৌলিক কর্তব্যের অন্তর্গত, এ হলো এমন এক জীবন দর্শন যা প্রতিষ্ঠিত ধ্যানধারণা বা আপ্তবাক্যকে পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির কষ্টিপাথরে বিচার করতে শেখায়। আধুনিক যুগের সমস্যাদের সমাধান কোনো প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যাবে না, এই জীবন্ত দর্শনই তার পথ দেখাতে পারে। তাই নিরন্তর বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির অনুশীলনই হোক জাতীয় বিজ্ঞান দিবসে আমাদের শপথ।
 

Comments :0

Login to leave a comment