অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়
তিনি নাকি কথা দিয়েছিলেন সুনীতা উইলিয়ামসদের মহাকাশ থেকে ফিরিয়ে আনবেন। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করেছেন। সুনীতা এবং বুচ উইলমোর পৃথিবীর বুকে নামার পর এমনই প্রতিক্রিয়া সদর্পে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দুই নভোচারীকে পৃথিবীতে ফেরানোর ব্যাপারে কৃতিত্ব নিজের কাঁধে নেওয়ার পাশাপাশি পূর্বসূরি জো বাইডেনকেও খোঁচা দিতে তিনি ছাড়েননি। হোয়াইট হাউসের এক্স হ্যান্ডলে লেখা হয়, ‘‘মহাকাশে নয় মাস ধরে আটকে থাকা সুনীতা উইলিয়ামসদের ফিরিয়ে আনা হলো। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়েছে।’’
বাইডেনকে প্রকাশ্যে কটাক্ষও করেছেন ট্রাম্প। সুনীতাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নাকি উদাসীন ছিলেন বাইডেন, এমন অভিযোগও শোনা গেলো ট্রাম্পের গলায়। তিনি বলেন, ‘‘বাইডেন তাঁদের (সুনীতা এবং বুচ) ফিরিয়ে আনতে পারেননি। ইলন মাস্ককে অনুরোধ করেছিলাম তাঁদের ফিরিয়ে আনতে হবে। সুনীতারা ফিরেছেন। তাদের এখন সুস্থ হতে হবে। সুস্থ হয়ে উঠলে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে আমন্ত্রণ জানানো হবে।’’
ভারতীয় সময়ে ১৯ মার্চ ভোররাতে সুনীতাদের নিয়ে ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেসএক্স-এর মহাকাশযান ফ্লোরিডার সমুদ্রে অবতরণ করে। তার কিছুক্ষণ পর ওই যানের মধ্যে থাকা ক্যাপসুল থেকে একে একে হাসিমুখে বেরিয়ে আসেন সুনীতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোর। ২৮৬ দিন মহাকাশে কাটিয়ে ভালোয় ভালোয় তাঁরা পৃথিবীতে ফিরে আসায় বিশ্বের মানুষ খুশি। প্রকাশ্যে সেই খুশিকে দম্ভের আকারে প্রকাশ করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
২০২৪ সালের ৫ জুন সুনীতাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল বোয়িং স্টার লাইনার। ৮ দিনের সফরে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু মহাকাশযানে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। ফলে সেখানেই আটকে পড়তে হয় সুনীতা ও সহযাত্রী বুচ’কে। তারপর একাধিকবার আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন থেকে তাঁদের পৃথিবীতে ফেরানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বারবার তা যান্ত্রিক সমস্যার কারণে পিছিয়ে গেছে, আট দিনের সেই সফর দীর্ঘায়িত হয়েছে নয় মাসে।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা একাধিকবার আটকে থাকা মহাকাশচারীদের ফিরিয়ে আনার কথা বললেও তা করতে পারেনি। সেই কাজটি করে দেখালো ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেসএক্স। এখন নাসার কার্যনির্বাহী আধিকারিক হিসাবে নামেই রয়েছেন জেনিট পেট্রো। আসল কাজটি চালায় ইলন মাস্কের সংস্থা। গবেষণার জগতে সরকারি সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে বেসরকারি সংস্থা। আমেরিকার ক্ষেত্রে ২০০২ সালে তৈরি ওই বেসরকারি সংস্থা গোটা একটা দেশের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র’কে প্রায় দখল করে নিয়েছে। কোন প্রকল্প কী অবস্থার পাশাপাশি আগামী দিনের নাসা’র প্রকল্প লক্ষ্য, এমনি মঙ্গল অভিযানের রূপরেখাও এখন বাতলে দিচ্ছেন ইলন মাস্ক। প্রযুক্তি দুনিয়ার ‘নয়া অবতার’ মাস্ক এখন গোটা পৃথিবীকে নাকি দিশা দেখাবেন। সেই লক্ষ্যেই মাস্কের কথায় নাসার অ্যাডমিনিস্ট্ররের পদ থেকে বিল নেলসন’কে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে জেনিট পেট্রো’কে।
সুনীতারা ঠিকমতো ফিরে আসায় সব কৃতিত্বটা নিচ্ছে মাস্কের ড্রাগন যান। অথচ নাসা’র দূরসঞ্চারী মহাকাশ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় যে ফিরতি অভিযানটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হলো, তা চলে গেলো পিছনের সারিতে। ভারশূন্য পরিবেশে দীর্ঘদিন থাকার জেরে শারীরিক সমস্যা কাটাতে নভশ্চরদের রাখা হয়েছে হিউস্টন জনসন স্পেস সেন্টারে। সেখানে নিভৃতাবাসে রেখে শারীরিক পরিস্থিতির টানা পর্যবেক্ষণের পর ছাড়া হবে তাঁদের। এই ঘটনা যতটাই আকর্ষণীয় হোক না কেন, এটি বহির্জগত অভিযানের ধারাকে বদলে দিলো।
মহাকাশ গবেষণা আর মানবসভ্যতার জন্য নিবেদিত রইলো না। মহাকাশকে দখলের লক্ষ্যে এখন চলবে গবেষণা। মহাকাশ বিজ্ঞান আগামী দিনের শিল্প। এখানে বিজ্ঞানী বা অনুসন্ধানী হিসাবে নয়, সুনীতারা এখন মহাকাশ শিল্পের কুশীলব পরিণত হয়েছে। তাই তাঁদের আটকে পড়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যতই উৎকণ্ঠা কাজ করুক না কেন, সরকার তার দৃষ্টিভঙ্গিটা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য সীমাবদ্ধ রাখতে চায়।
হয়ত সেই কারণে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বারেবারে মহাকাশ যাত্রা এসেছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে আটকে থাকা অভিযাত্রীদের কেন ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা গেছে প্রতিপক্ষকে। এরই মধ্যে বিশ্বের আপামর মানুষ অভিযাত্রীদের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় রাত জাগেন। আর শিল্প-বাণিজ্যের নিরিখে তাঁদের ফিরে আসাটা মহাকাশ যাত্রী ফেরানোর বিজ্ঞাপন হিসাবে কাজ করে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা’র উর্ধে নিজেদের প্রতিষ্ঠার জায়গা খোঁজে স্পেসএক্স। এই সংস্থার হাত ধরে মহাকাশ গবেষণা আজ বেসরকারিকরণের পথে।
ভারতেও এই উদ্যোগ শুরু হয়েছিলো। তবে সেটা ফুলে ফলে প্রস্ফূটিত হতে পারেনি। এখনো ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা ইসরো’র সহযোগী হিসাবে কাজ করতে হচ্ছে ওই সংস্থা’কে। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসাবে ১৯৯২ সালে ভারতে আত্মপ্রকাশ করেছিলো এনট্রিক্স কর্পোরেশন লিমিটেড। বলা হয়েছিল এই সংস্থাটি ইসরো’র বাণিজ্যিক প্রচার চালাবে। এখন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মহাকাশ গবেষণার লাভদায়ী চুক্তি নিয়ে দামদর করে এই সংস্থা। ভিন দেশের হয়ে উপগ্রহ পাঠানোর চুক্তি সম্পাদনার দায়ও ওই সংস্থার। দেশের কোনও নতুন মহাকাশ অভিযানের দায়িত্ব এখনো এনট্রিক্স’কে দেওয়া হয়নি।
ব্যক্তি মালিকানায় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ভারতে কেন, মহাকাশ গবেষণায় এগিয়ে থাকা আর পাঁচটা দেশ এখনো মানতে পারেনি। সেই রাস্তাটাকে এখন প্রশস্থ করছে স্পেসএক্স। মহাকাশ গবেষণা সংস্থার কর্মী হিসাবে নাম না লেখালেও ভারতের তাবড় তাবড় মহাকাশ বিজ্ঞানীরা আগামী দিনে মহাকাশ শিল্পের কর্মী বলেই বিবেচিত হবেন। দেশের গবেষণা ঔৎকর্ষকে প্রাধান্য না দিয়ে হয়ত মহাকাশ বাজারকে কবজা করতে লক্ষাধিক ডলারের চুক্তিতে অন্যের হয়ে কাজ করে যেতে হবে।
মানব কল্যাণে মহাকাশ অভিযান স্রেফ ডলার কামানোর রাস্তা হয়ে উঠবে। ঠিক যেমনটি ঘটেছে অস্ত্র তৈরির প্রযু্ক্তিতে। তবু সুনীতা’র এই জয় কম কথার নয়। কল্পনা চাওলা’র স্মৃতি এখনো সকলের মনে তাজা থাকায় ফিরতি পথের একটা ভয় ছিলোই। ২০০৩-এর ১ ফেব্রুয়ারি কলম্বিয়া মহাকাশ যানের বিপর্যয় কল্পনা চাওলা সহ ৭ মহাকাশচারীর প্রাণ কেড়েছিল। তাই এবারের ফেরাটা সকলের কাছে একটা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল।
তবুও বিশ্বের এক প্রান্তের মানুষ যখন অন্যদের টেনে হিঁচড়ে বন্দি করার খেলায় মেতেছে, তখন আরেক প্রান্তের এক নারী মহাকাশে কাটিয়ে এলেন টানা ৯ মাস! তেমন কোনও প্রস্তুতি ছাড়া। ৮ দিনের সেই যাত্রা মাসের পর মাস পার করে ৯ মাস চলে গেলেও কখনই ভেঙে পড়েননি। সুনীতা তাঁর সঙ্গী বুচ’কে নিয়ে চালিয়ে গেছেন একের পর এক গবেষণা। এই সময় মহাকাশে চাষ নিয়ে তাঁদের অভিনব গবেষণা আগামী দিনে কাজে আসবে। কেননা সুনীতা-বুচ দেখেছেন, প্রায় শূন্য মহাকর্ষে (মাইক্রো গ্রাভিটি) কী কী ফসল উৎপাদন করা যায়। কোন ফুল ফুটতে পারে? কোন জীবাণু এই ধরনের প্রতিকূল পরিবেশে কাবু হয় ?
উদ্ভিদবিদ্যা সংক্রান্ত এই গবেষণাটির নাম ‘ভেজি’। সুনীতা সেখানে তার প্রিয় জিনিয়া ফুল ফুটিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, মহাকাশের আবহাওয়াতেও লেটুস, গাজর উৎপাদন করা সম্ভব। ভারশূন্য অবস্থায় দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে একজন মহাকাশচারীর শারীরবৃত্তীয় নানা পরিবর্তন ঘটে যায়। হার্ট, কিডনি কিংবা মানুষের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গে কীভাবে কতটা সক্রিয় থাকে, কোন অঙ্গের ওপর প্রভাব বেশি পড়ে, তা নিয়েও গবেষণা করেছেন। আর এই সব করতে করতেই সুনীতা স্বপ্ন দেখেন, ‘‘একদিন মানুষ মঙ্গলে যাবে। লোটা-কম্বল নিয়ে চাঁদে যাবে ঘর বাঁধতে।’’
এর আগেও সুনীতা মহাকাশে গিয়েছেন। এ পর্যন্ত মোট ৩ বার। তিনটি অভিযান ধরলে এখন পর্যন্ত তিনি ৫১৭ দিন মহাকাশে কাটিয়েছেন। এটাই বিশ্ব রেকর্ড। স্পেস স্টেশন থেকে বেরিয়ে মহাকাশে হাঁটাহাঁটি করেছেন মোট ৫১ ঘণ্টা। এটাও বিশ্ব রেকর্ড। কয়েক মিনিটের জন্য লিফটে আটকা পড়লে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে। আর সুনীতা আটকে ছিলেন মহাকাশে, মাসের পর মাস। মহাকাশ থেকে ফিরে আসার আগে শেষ সাক্ষাৎকারে সুনীতা জানিয়েছিলেন, ‘‘যদি পৃথিবীতে ফিরে যাই, তবে এই মহাকাশের সবকিছু মিস করবো।’’ এই কথাই বুঝিয়ে দেয় মহাকাশ গবেষণায় তাঁর অনুরাগের কথা। নিজেকে জয় করায় তাঁর কৃতিত্ব ইতিহাস হয়ে থাকলো।
Comments :0